সোমবার, ১৪ জুলাই, ২০১৪

দুঃখ মুক্তির আন্দোলন



দুঃখ মুক্তির আন্দোলন

সিদ্ধার্থ ॥ জীবন মানেই দুঃখের সমষ্টি। সারাজীবন মানুষ দুঃখ থেকে মুক্তিলাভের আন্দোলন করে। দুঃখ মুক্তির এই আন্দোলন থেকেই উৎপত্তি হয়েছে ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানের নানা শাখা-প্রশাখা। মানুষের সকল উদ্ভাবনই দুঃখ মুক্তির আন্দোলনের ফসল।
জন্ম থেকেই জীবকূল নানা প্রকারের দুঃখতাপে দগ্ধ হয়। শুধু যে বিচিত্র দৈহিক জরা ও যন্ত্রণা ভোগ করে তাই নয়। যুদ্ধ, মহামারী, ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগও জীবনকে দূর্বিষহ করে তোলে। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এই তিন কালে স্থিত অসংখ্য প্রাণীর অসংখ্য দুঃখ। প্রাচীন সাধকগণ দুঃখকে তিনভাগে ভাগ করেছেন - আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক। শরীরের ভেতর থেকে উৎপন্ন রোগ জরাদি বা কাঙ্খিত বিষয়ের অপ্রাপ্তি হেতু দুঃখ হলো আধ্যাত্মিক দুঃখ। শারীরিক ও মানসিক উভয় প্রকারের দুঃখই আধ্যাত্মিক। শারীরিক দুঃখ শরীরের নানাবিধ ত্রুটির কারণে উৎপন্ন হয়। মানসিক দুঃখ উৎপন্ন হয় - কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, ভয়, ঈর্ষা, বিষাদ এবং কাঙ্খিত বিষয় না পাওয়ার ফলে। আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক দুঃখ শরীরের বাইরের কোন কারণ থেকে উৎপন্ন হয়। বাহ্যজগত থেকে যে দুঃখ উৎপন্ন হয় তা আধিভৌতিক। প্রাকৃতিক কারণে যে সব দুঃখের উৎপত্তি হয় তা আধিদৈবিক। বন্যা, খরা, মহামারী, ভূমিকম্প ইত্যাদি আধিবৈদিক দুঃখ। জন্ম থেকেই জীব এই দুঃখত্রয়ের ত্রিতাপ জ্বালায় জর্জরিত। এই ত্রিতাপ দুঃখ থেকে মুক্তির জন্যই মানুষের জীবন সংগ্রাম। দুঃখ নিবারণের তিন প্রকার উপায় আছে। যথা - লৌকিক উপায়, আনুশ্রবিক উপায় এবং তত্ত্বজ্ঞান।
দুঃখ নিবৃত্তির লৌকিক উপায় সর্বাপেক্ষা সহজ। তিন প্রকার দুঃখ নিবৃত্তির তিন প্রকার লৌকিক উপায় রয়েছে। আধ্যাত্মিক শরীর দুঃখ নিবারণের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শে ঔষধ ও পথ্য সেবন ও আধ্যাত্মিক মানস দুঃখ নিবৃত্তির জন্য সঙ্গ, পানীয়, সুস্বাদু খাদ্য সামগ্রী, প্রসাধন সামগ্রী, বস্ত্র, অলঙ্কার ইত্যাদি ভোগ্য বিষয় রয়েছে। আধিভৌতিক দুঃখ নিরাকরণের জন্য শাস্ত্রপাঠ, নিরাপদ স্থানে বাস ইত্যাদি বিবিধ সহজ উপায় আছে। অনুরূপভাবে আধিদৈবিক দুঃখ নিবৃত্তির জন্য সমসাময়িক প্রযুক্তির ব্যবহারসহ অন্যান্য লৌকিক সহজ উপায় আছে। দুঃখ নিবৃত্তির লৌকিক উপায় সহজ, অধিকাংশ মানুষ সহজ পথই অনুসরণ করে কিন্তু সহজ ও লৌকিক পদ্ধতিতে কিছুক্ষণের জন্য দুঃখের নিবৃত্তি হয় মাত্র, মূল থেকে দুঃখের নিবৃত্তি হয় না।
দুঃখ নিবৃত্তির আনুশ্রবিক উপায় হলো এক এ ডুবে থাকা। প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত্রি, প্রতিটি মাস এবং প্রতিটি বৎসরাদি কাল এক এ মগ্ন থাকা দুঃখত্রয়কে নিবৃত্ত করতে সমর্থ্য। এর ফল আনন্দলাভ। যে অনুভূতি দুঃখের সঙ্গে মিশ্রিত নয়, যে অনুভূতি পরবর্তীতে দুঃখের দ্বারা অভিভূত হয় না এবং যে অনুভূতি ইচ্ছামাত্র উপস্থিত হয়, সেই অনুভূতিকে আনন্দ বলে।
ব্যক্ত, অব্যক্ত ও জ্ঞ-এ ভেদজ্ঞানকে বলে তত্ত্বজ্ঞান। তত্ত্বজ্ঞানের দ্বারাও দুঃখ থেকে নিবৃত্তি লাভ করা সম্ভব। ব্যক্ত জগৎ, অব্যক্ত প্রকৃতি এবং জ্ঞ বা স্ব-রূপ অনুধাবনের মাধ্যমে দুঃখের হাত থেকে মানবের নিবৃত্তি লাভ হতে পারে।
দুঃখ মুক্তির আন্দোলনেও দুঃখ আছে। যে উপায়ই অবলম্বন করি না কেন সহজে দুঃখের নিবৃত্তি হবে না এটা মেনে নিয়েই দুঃখ নিবৃত্তির প্রচেষ্টা করতে হয়। কেবল চাইলেই দুঃখের নিবৃত্তি হয় না। সংগ্রামের মাধ্যমেই মানুষ দুঃখকে জয় করতে পারে তাই দুঃখ জয়ে আনন্দ মেলে। দুঃখ থেকে মুক্তির জন্য আন্দোলন করতেই হবে। দুঃখের কাছে হার মানলে চলবে না। মানুষ এত দুর্বল নয় যে, দুঃখের তাপ তাকে ভস্ম করবে। যার জীবনে যে দুঃখ আসে, সে দঃখকে জয় করার শক্তিও তার কাছে থাকে। দুঃখের তাপ সহ্য করে দুঃখমুক্তির আন্দোলন যিনি করেন তিনিই তাপস। জীবনে দুঃখ এসেছে বলে নিজেকে অবজ্ঞা না করা বরং দুঃখ আসলে নিজেকে সম্মানিত বোধ করতে হবে যে আর একটা দুঃখকে অতিক্রম করার সুযোগ পাওয়া গেলে। দুঃখকে পরাজিত না করে নিজের বীরত্ব ও সম্মান উপলব্ধির অন্য কোন পথ নেই। জীবনে দুঃখ না আসলে আমরা জানতেই পারি না যে দুঃখকে মোকাবেলা করার শক্তি আমাদের আছে।
মানুষ এখন পর্যন্ত যা কিছু সৃষ্টি করেছে তা দুঃখ তাপকে সহ্য করে, ত্যাগের দ্বারা, তপস্যা ও গবেষণা বা উপাসনার দ্বারাই সৃষ্টি করেছে। মানুষের মনুষ্যত্ব, উদারতা, মহানুভবতা, সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে ওঠেছে দুঃখ দ্বারা দুঃখকে জয় করার মাধ্যমে। বিষে বিষ ক্ষয় - এটাই প্রাকৃতিক বিধি।
জীবনে যদি দুঃখ না আসে তবে গর্ব করার কিছু থাকে না, অর্জন করারও কিছু থাকে না। জমি কর্ষণ করে কৃষককে ফসল উৎপাদন করতে হয় এটা কৃষকের অসম্মান নয়। বরং দুঃখকে মোকাবেলা করে ফসল উৎপাদন করতে হয় বলেই ফসলের মূল্য আছে। দুঃখের অভাবই জীবনে সবচেয়ে বড় অভাব - এই বোধ যার মধ্যে জাগ্রত হয়েছে তার আর কোন দুঃখ নাই। বিধাতার কাছে দয়া নয় বরং দুঃখকে মোকাবেলা করার শক্তি, সাহস ও দৃঢ়তাই কাম্য।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন