বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই, ২০১৪

সংসার ও আধ্যাত্মিকতার সমন্বয়

সংসার ও আধ্যাত্মিকতার সমন্বয়

দিগন্ত ॥ আত্মার চেয়ে সংসারকে অগ্রাধিকার দিয়ে সংসার করা যায় না। কারণ সংসার তাকে রাক্ষসের মত গ্রাস করে। মক্ষিকা কেয়া'র রূপে আকর্ষিত হয়ে ভোগ করতে আসে কিন্তু কেয়া ফুলের আঠায় আবদ্ধ হয়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করে কিন্তু মুক্তি পায় না। আমাদের অবস্থাও তাই। সুখ লাভের প্রত্যাশা নিয়ে আমরা সংসার শুরু করি কিন্তু যখন আত্মার চেয়ে সংসারকে অধিক গুরুত্ব দেই তখন এমনভাবে ধৃত হই যে সুখ লাভ তো হয়ই না বরং জীবন দুঃখে ভরে ওঠে। খেতে এসে আমরা নিজেরা খাদ্যে পরিণত হই, ভোগ করতে এসে নিজেই পরিণত হই ভোগ্যবস্তুতে, যেখানে সুখ পেতে এসেছিলাম সেখান থেকেই দুঃখ প্রাপ্ত হই। এই দুঃখের মূল কারণ হলো আসক্তি। আমরা ধরতে পারি কিন্তু ছাড়তে পারি না। যা ধরি তাতেই ধৃত হই। ধরতে গিয়ে ধরা পড়ি আসক্তিরই কারণে। আমরা রাজহাঁসের মতো এক ঝাঁকিতে পানি ঝড়িয়ে দিতে পারি না বরং নাইতে এসে পানিতেই ডুবে মরি। সংসারে যে ভবিষ্যৎ সুখের কল্পনা আমরা করি তার উৎস যাবতীয় ইন্দ্রিয়-সুখ। আমরা সে সব  বাহ্যবস্তুতেই আসক্ত হই যার মাধ্যমে ইন্দ্রিয়সুখ  লাভ করতে পারি। কিন্তু এই আসক্তি ছাড়া আর কিছু নাই যা থেকে আমাদের দুঃখ উৎপন্ন হয়।
ইন্দ্রিয় সুখ লাভ করা খারাপ কিছু নয়। বরং তা জীবনের জন্য অত্যাবশ্যক। সংসার থেকে আমরা ইন্দ্রিয় সুখ লাভ
করতে পারতাম শুধু যদি আসক্তি ত্যাগ করতে পারতাম। ইচ্ছামাত্র অনাসক্ত হওয়ার সামর্থ্য যদি আমাদের থাকত, তবে ধরতে এসে ধৃত হতাম না আর আমাদের দুঃখও থাকত না। সংসার থেকে সুখ লাভ করতে কেবল সেই ব্যক্তিই সমর্থ্য হন যিনি ধরতে পারেন আবার ছাড়তেও পারেন। যে ধরার সময় একনিষ্ঠভাবে ধরতে পারে আবার ছাড়ার সময় একনিষ্ঠভাবে সমগ্র শক্তি প্রয়োগ করে ছেড়ে দিতে সুখ তার জন্য। সমস্যা হলো এই যে, অধিকাংশ মানুষই দুর্বল, ধরতে পারে কিন্তু ছাড়তে পারে না। ধরার জন্য খুব শক্তির প্রয়োজন হয় না, এজন্য জৈবিক তাড়নাই যথেষ্ট। কিন্তু ছাড়ার জন্য অনেক শক্তির প্রয়োজন হয়, যা অধিকাংশ মানুষ একত্রিত করতে পারে না।
সংসারে এমন মানুষও বিরল নয় যারা ধরেও না ছাড়েও না। তারা ভালোবাসতে পারে না। কোনকিছুর দ্বারা আকৃষ্ট হয় না। তারা আহার, নিদ্রা, মৈথুন নিয়ে ব্যস্ত থাকে সুখ-দুঃখের অনুভূতি থাকলেও কোন গভীরতা নাই। অনেকটা জড়বস্তুর মতো। জড়বস্তু কাউকে ভালোবাসে না আবার ঘৃণাও করে না, সুখ পায় না, দুঃখও পায় না। জড়বস্তু আসক্তও হয় না নিরাসক্তও হয় না। জড়বস্তুর মত না হয়ে বরং কোন কিছুতে আসক্ত হওয়া অধিক মানবীয়। যে ব্যক্তি গভীরভাবে কাউকে ভালোবাসে না সে দুঃখ পায় না ঠিকই কিন্তু আনন্দ থেকেও বঞ্চিত হয়। আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়া যেমন আমাদের কাম্য নয়, তেমনি কাম্য নয় ধৃত হয়ে ছটফট করা।
আধ্যাত্মিকতা সহজ অর্থে আত্মিক উন্নতির প্রচেষ্টা। আত্মিক উন্নতি কেবল আত্মার আনন্দ লাভের জন্য নয় সংসার থেকে সুখ লাভের জন্যও প্রয়োজনীয়। যে ব্যক্তি আত্মাকে অনুভব করে সংসার তার একমাত্র বস্তু নহে। সে সংসারের সাথে সাথে আত্মাকেও চায়। সে পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করে কিন্তু পাশাপাশি যা আছে তাতে সে সন্তুষ্ট থাকে। সে ভোগ করে কিন্তু সীমালঙ্ঘন করে না, নিজের ভোগে মত্ত হয়ে সে অপরকে পীড়া দেয় না, তুচ্ছ বস্তুর জন্য সে হানাহানি, কাড়াকাড়ি করে না। আত্মাকে লালন করে, ভালোবাসাকে লালন করেই সে সংসার করে।
সংসার করতে হবে কিন্তু আত্মাকে উপেক্ষা করে নয়। আত্মিক উন্নয়নের প্রচেষ্টাও করতে হবে কিন্তু সংসারকে উপেক্ষা করে নয়। সংসারের দায়িত্ব ও কর্ত্তব্য পরিত্যাগ করে আত্মিক উন্নতির প্রচেষ্টা কেবল অন্ধকারের দিকেই পতন ঘটাবে। কারণ, প্রকৃতি মানুষকে ক্ষুধা দিয়ে দায়িত্ব ও কর্ত্তব্য পালনের পরিবেশে অস্তিত্বময় করেছেন। এই দায়িত্ব ও কর্ত্তব্য পালন করা প্রাকৃতিক। প্রকৃতিকে অস্বীকার করে আত্মিক উন্নতির প্রচেষ্টা করা যায় না। আত্মাকে জাগ্রত রেখে আসক্ত না হয়ে দায়িত্ব ও কর্ত্তব্য পালনের সাধনা ব্যতীত আধ্যাত্মিক সাধনা কথার মারপ্যাচ মাত্র। নিরাসক্ত হয়ে সংসারের কর্ত্তব্য পালন করলে সংসারের সংঘর্ষেই পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটে।
সংসার ত্যাগ করে আধ্যাত্মিক সাধনা চরম মুর্খতা। পিতা আমাদিগকে বিদ্যালয়ে পাঠিয়েছেন, বিদ্যালয়ের নিয়ম এবং কর্ত্তব্য পালন সুখকর হয় না। তাই বলে বিদ্যালয় ত্যাগ করে সুখের অন্বেষণ করা চরম মূর্খতা বৈ কি! বিদ্যালয় থেকে সম্মানের সাথে মুক্ত তিনিই হতে পারেন যিনি বিদ্যালয়ে যথাযথভাবে কর্তব্য পালন করেন এবং এই কর্তব্য পালনকে দুঃখ হিসেবে গ্রহণ করেন না। সংসার থেকে আত্মাকে এবং আত্মা থেকে সংসারকে পৃথক জ্ঞান করলেই বিপত্তি ঘটে। সংসার হতে আত্মাকে দূরে রাখার ফলেই আমরা ভোগে নিমগ্ন  হয়ে জীবনের পূর্ণতাভ্রষ্ট হই।
আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য সংসার ত্যাগ চূড়ান্ত স্বার্থপরতাও বটে। যারা ঠিকমত সংসারের কর্তব্য পালন করে তারা সংসার ত্যাগী সাধকদের মত স্বার্থপর হয় না। কারণ সংসারের নিয়মই হলো স্বার্থত্যাগ করা। সংসারী ব্যক্তির স্বার্থ ক্রমেই সন্তানের স্বার্থ, পরিবারের স্বার্থ, প্রতিবেশীর স্বার্থ, স্বদেশের স্বার্থ এবং সর্ব্বজনের স্বার্থে অবশ্যম্ভাবীরূপে ব্যাপ্ত হতে থাকে। কিন্তু যারা সংসারের দুঃখ শোক দারিদ্র্য হতে পরিত্রাণ লাভের প্রলোভনে আধ্যাত্মিক সাধনা করে তারা চরম হতাশায় নিমজ্জিত হয়।

বৃক্ষে যে ফল থাকে সে ফল বৃক্ষ হতে রস আকর্ষণ করে পরিপক্ক হয়ে উঠে। যতই সে পরিপক্ক হতে থাকে ততই বৃক্ষের সাথে তার বৃন্তবন্ধন শিথিল হয়ে আসে। অবশেষে তার অভ্যন্তরস্থ বীজ সুপরিণত হয়ে উঠলে বৃক্ষ হতে সে সহজেই বিচ্ছিন্ন হয়ে বীজকে সার্থক করে তোলে। আমরাও সংসারবৃক্ষ হতে বিচিত্র রস আকর্ষণ করি মনে হতে পারে তাতে সংসারের সাথে আমাদের সম্বন্ধ ক্রমেই দৃঢ় হবে, কিন্তু তা নয়, আত্মার যথার্থ পরিণতি হলে বন্ধন আপনি শিথিল হয়ে আসে। ফলের সাথে আমাদের প্রভেদ এই যে, আত্মা সচেতন; রস-নির্র্বাচন ও আকর্ষণ বহুল পরিমাণে আমাদের স্বায়ত্ত। আত্মার পরিণতির প্রতি লক্ষ্য করে বিচারপূর্ব্বক সংসার হতে রস গ্রহণ ও বর্জ্জন করতে পারলেই সংসারের উদ্দেশ্য সফল হয় এবং সে সঙ্গে আত্মারও।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন