বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৩

'দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ'



'দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ'

সংলাপ ॥ বাংলাদেশের যেকোনো রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রধান হাতিয়ার এখন হরতাল-অবরোধ। অতীতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে হরতাল দেয়া হতো। আর এখন শুরুতে হরতাল, মাঝখানে হরতাল, শেষেও হরতাল। ২৪ অক্টোবরের পর থেকে বিরোধী দলের অবরোধ-হরতালে হত্যা করা হয়েছে ১৭০ জন মানুষ। আহত হয়েছে শত শত। নিহতদের অধিকাংশই নিরীহ নিরস্ত্র মানুষ। শুধু কি মানুষ মরেছে? চলমান হরতাল-অবরোধের কারণে  দেশের অর্থনীতি ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। গত ২ দশকের অর্থনৈতিক অর্জন ২ মাসে মলিন হয়ে যাচ্ছে। আমদানি-রপ্তানি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কমে যাচ্ছে বিনিয়োগ ও ঋণ প্রবাহ। গার্মেন্টস সামগ্রী রপ্তানি ও রেমিট্যান্স হ্রাস পেয়েছে আশংকাজনকভাবে। প্রত্যন্ত অঞ্চল হতে উৎপাদনের উপকরণ সরবরাহ ও উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণ উভয়ই বিঘ্নিত হচ্ছে। সহিংস আন্দোলনের কারণে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও স্বল্প আয়ের মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। ঝুঁকির মধ্যে আছেন দেশের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী সমাজ।
আইএমএফ-এর চলতি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়াবে সাড়ে ৫ শতাংশে। গত ২০১২-১৩ অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ১ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম এ ধরনের পতন এর ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল্‌স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) হিসেবে গত জানুয়ারি  থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে ২ হাজার ২০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়েছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, সেই বিনিয়োগ এখন তাদের গলার ফাঁস হয়ে গেছে। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করা যাচ্ছে না। আবার উৎপাদনও বন্ধ করা যাচ্ছে না। কিছু দিন আগে ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআইর জরিপে প্রতিদিনের হরতালে ২ হাজার  কোটি টাকার ক্ষতি হয় বলে জানানো হয়। বিটিএমএর  হিসেবে, প্রতি মাসে ১২ হাজার ট্রাক লাগে শুধু বস্ত্র খাতের তুলা ও সুতা পরিবহনে। অথচ এখন ট্রাকের মালিকেরা ভাড়ায় যেতে চান না। হরতাল অবরোধের সময় সরকার রপ্তানি পণ্য বোঝাই ট্রাক বন্দর পর্যন্ত যেতে পুলিশি পাহারার ব্যবস্থা করলেও তাকে ঝুঁকিমুক্ত মনে করেন না ট্রাক মালিকেরা। অবরোধের মধ্যে অনেক পণ্যবাহী ট্রাক জ্বালিয়ে  দেয়া হয়েছে। প্রতিদিনই তা অব্যাহত রয়েছে। ফলে কোন কোন মালিক ঝুঁকিতে ট্রাক চালালেও ১৫ হাজার টাকার ট্রাক ভাড়া এখন এক লাখ টাকা হাঁকছেন। ফলে তুলা আনা যাচ্ছে না। উৎপাদিত সুতাও এখন তৈরি  পোশাক কারখানায় পৌঁছানো যাচ্ছে না। কীভাবে এর সমাধান হবে জানা নেই কারোরই। এ অবস্থা আর কিছুদিন চললে অনেক শিল্প-কারখানাতেই তালা ঝুলবে।  বেকার হবে লাখ লাখ শ্রমিক।
রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব পড়ছে ব্যাংকের শিল্পঋণে। আগের সব রেকর্ড ভেঙে এবারই প্রথমবারের মতো ব্যাংকের শিল্পঋণের পরিমাণ কমেছে। অন্যদিকে এ খাতে বেড়েছে  খেলাপি ঋণের পরিমাণ। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে শিল্প খাতে মোট ৩৩ হাজার ৪১ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। আগের বছরের একই সময়ে বিতরণ হয়েছিল ৩৪ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। একই সময়ের তুলনায় এ খাতে ঋণ কমেছে ১ হাজার ৫১৩  কোটি টাকা, যা শতকরা হিসেবে ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। আর একই সময়ের তুলনায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫১ দশমিক ৫৫ শতাংশ। রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবে সামপ্রতিক সময়ে শিল্প খাতে বড় ঋণের চাহিদা কমেছে। এর প্রভাবে সামগ্রিকভাবে শিল্প ঋণের পরিমাণ কমে গেছে। এ কারণে ব্যাংকগুলোর মুনাফায়ও  লেগেছে চরম আঘাত।
রাজনৈতিক অস্থিরতায় সবচেয়ে বড় সমস্যার মুখোমুখি ব্যবসায়ীরা। তিল তিল করে গড়ে  তোলা সম্পদ যেমন পুড়ছে, সেই সঙ্গে ব্যবসা না হওয়ার কারণে সুদ  বেড়ে ঋণের বোঝাতে পরিণত হচ্ছে। রাজনীতির নামে এখন দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। দেশের পোশাক শিল্প এখন অগ্নিকুন্ডে ওপর দাঁড়িয়ে আছে। হরতাল ও অবরোধসহ রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশের অর্থনীতি জ্বলছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের মানুষ না খেয়ে মরবে। কী নিয়ে রাজনীতি করবেন রাজনীতিকরা?
৭১'র পরাজিত শক্তি দানবরূপে আবির্ভূত হয়ে পাল্টে দিয়েছে হরতাল-অবরোধের সংজ্ঞা। হরতাল-অবরোধ মানেই এখন দানবীয় তা-ব, অগ্নিসংযোগ, বীভৎস হত্যা-খুন, নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞ ও ব্যভিচারী নৈরাজ্য সৃষ্টি। আন্দোলনের নামে এখন যা ঘটছে তা সভ্যতার ইতিহাসে নিষ্ঠুরতম বর্বরতা। আতঙ্কে ঘরবন্দী হয়ে বসে থাকা মানুষের অসহায়ত্বকেই রাজনৈতিক দলগুলো বলছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনগণ হরতাল পালন করেছে।
সামপ্রতিক হরতালরোধে বর্বরতার যে চিত্র দেখা যায়, কোন সভ্য দেশে এর নজির নেই। হরতালকারীরা বর্বরতার চরম মাত্রাও ছাড়িয়ে গেছে। কিশোর মুনিরকে গান পাউডার দিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে তার বাবার সামনে।  শাহবাগে বাসে আগুন দিয়ে পোড়ানো হয়েছে ১৯ জনকে। কোন মানব সন্তান কি এমন পৈশাচিক কাজ করতে পারে? অথচ এসব পশু একের পর এক নির্বিঘ্নে ঘটিয়ে চলছে এমন নারকীয় কা-। নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা কখনই একটি সভ্য  দেশের কোন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি হতে পারে না।
৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তার এ দেশীয়  দোসর জামাত, রাজাকার-আল বদর, আল শামসসহ অন্যরা যে পৈশাচিকতা এ দেশে চালিয়েছিল ঠিক একই নারকীয় তান্ডব আজ হরতালের নামে চালানো হচ্ছে সারা দেশে। তাদের একমাত্র লক্ষ্য স্বাধীনতার পক্ষশক্তিকে ধ্বংস করা। হরতাল-অবরোধ, আগুন দিয়ে যারা মানুষ হত্যা করছে, গাছ কাটছে, জাতীয় অর্থনীতি ধ্বংস করছে, তারা আসলে পাকিস্তানের এজেন্ট।  দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া সাধারণ মানুষের গত্যন্তর থাকে না। যারা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও সর্বস্বান্ত হচ্ছেন, তারা আজ হোক আর কাল হোক জেগে উঠবেনই। কবির ভাষায়, 'দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ'। এই ঋণ একদিন কড়ায়-গন্ডায় অবশ্যই শোধ করিতে হইবে। ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডের জন্য কঠিন মূল্য দিতে হবে।
সরকারের উচিত হরতাল-অবরোধ  প্রতিরোধের জন্য সর্বস্তরের মানুষকে রাস্তায় নামার আহ্বান জানানো। নিশ্চয়ই সরকারের আহ্বানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিবে এদেশের ছাত্র শিক্ষক ও অভিভাবকসহ সর্বস্তরের জনগণ। এখনই সময় হরতালের বিরুদ্ধে গণভোট অনুষ্ঠানের এবং একটি আইন পাস করার। আইন অমান্যকারীদের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে এতে। বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির রাজনীতির কবর দিতেই হবে, নইলে ঋণ শোধ হবে না। আর এ কাজটি যত দ্রুত সম্ভব সম্পন্ন করা সময়ের দাবী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন