বৃহস্পতিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৬

সময়ের সাফ কথা.... রাজনীতির সুখ-অসুখ

সময়ের সাফ কথা....

রাজনীতির সুখ-অসুখ

নজরুল ইশতিয়াক ॥ রাজনীতির সুখ-অসুখ সমীকরণটা সহজ নয়। এটি জানতে হলে প্রত্যেক ব্যক্তির রাজনীতি সচেতন হওয়া খুব জরুরি। রাজনীতি বিমুখ জাতি মুখ থুবড়ে পড়ে। রাজনীতি সচেতন জাতি সময়, বাস্তবতাকে অনুধাবন করে এগুতে পারে। জাতিস্বত্ত্বার পরিচয় সূত্র সোপানে সংযুক্ত থাকার অন্যতম প্রধান অনুসঙ্গ রাজনীতি। রাজনৈতিক দল জাতি চরিত্রের পরম্পরা স্রোতধারা বহন করে চলে। একটি জাতিকে চিনতে সেখানকার রাজনীতিকে দেখতে হয়। একটি জনপদের মানুষকে জানতেও সেই জনপদের রাজনীতি কিংবা দেশ পরিচালনায় ক্ষমতার উৎস দেখতে ও জানতে হয়। রাজনীতির রূপ দেখে চিহ্নিত করা যায় সেই সমাজ কতটা কার্যকর, কতটা পশ্চাৎপদ কতটা অসুস্থ। রাজনৈতিক দল গঠন মানেই রাজনীতি করা নয়। নানা অদ্ভুত কাল্পনিক গোষ্ঠীগতস্বার্থেই রাজনৈতিক দল গঠন হতে পারে। সময় বাস্তবতাও সাময়িকভাবে রাজনৈতিক দলের জন্ম দিতে পারে। তার অর্থ এই নয় যে রাজনীতিতে অন্তর্ভুক্তি মানেই সেটি রাজনৈতিক দল। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যাবে আমাদের দেশে নাম স্বর্বস্ব বহু রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব ছিল। সেগুলো রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত হয়ে উঠেনি। কোন কোনটি কিছু সময়ের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন ও জনগণের আস্থা অর্জন করলেও নেতৃত্বের অভাবে তা মুখ থুবড়ে পড়েছে। আবার কেউ কেউ সামান্য দিনের জন্য রাজনৈতিক ঐক্যের ভিত্তিত্বে পুরোনো দল ছেড়ে এসে নয়া রাজনৈতিক দল গঠন করলেও তা গঠনের চেয়ে বেশি দ্রুত ভেঙে গেছে। রাজনৈতিক দল গঠন যতটা সহজ তার নেতৃত্ব দেয়া ততটা সহজ নয়। লক্ষ্য ও নেতৃত্বের উপর নির্ভর করে রাজনৈতিক দলের অগ্রযাত্রা। রাজনৈতিক দলের অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব ও সামাজিক বাস্তবতার গভীর যোগসূত্র রয়েছে। নেতৃত্ব নির্বাচনে দক্ষতা দেখাতে ব্যর্থ হলে চরম খেসারত দিতে হয়। ঘরের শত্রুকে না চিনলে সমূহ বিপদ আসে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আশেপাশে ঘাতক নেতাদের উপস্থিতি ছিল। ফলে ১৫ আগষ্টের কিছু সময় পরই ভোলপাল্টে ঘাতকের অট্রহাসি পুরো জাতিকে দেখতে হয়েছে। যাদের হাসি দেখতে হয়েছে তারা দীর্ঘদিন আওয়ামীলীগ নামক রাজনৈতিক দলের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিল। কি ছিল তাদের আদর্শ তা অনুসন্ধান করলে রাজনীতির অসুখ বের হয়ে আসবে। ’৭৫ এর পর বেচা বিক্রির হাটে দেদারসে অনেক আওয়ামীলীগার নিজেকে বিক্রি করেছে। পুরো মাত্রায় দেশ ও জাতি বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছে। এসবই রাজনীতির অসুখ। 
রাজনীতি রাজার নীতি নয়, রাজনীতি হচ্ছে রাজ যুক্ত নীতি যা উচ্চ নীতি বোধকে নির্দেশ করে। এই উচ্চতা প্রথমত ব্যক্তির সামাজিক দার্শনিক দায়িত্বশীলতার উচ্চতা। এই উচ্চতা পরিবর্তনের পথ ধরে চলে। সেই বিচারে রাজনৈতিক দলের যে কেউ রাজনীতিক নয় আবার যত গুরুত্বপূর্ণ পদবীতে থাকুক না কেন রাজনীতিবীদও নয়। নীতি বোধের উচ্চতা না থাকলে রাজনীতিবীদ হতে পারেন না। লক্ষ্য ও আদর্শের পথে একনিষ্ঠ না হলে দলের বড় বড় পদধারীও নেতা তবে রাজনীতিবিদ নন। রাজনৈতিক দল একটি বৃহত্তর সামাজিক সংগঠন যা জনগণের সম্মিলিত সামাজিক সঞ্চিত শক্তিকে ধারণ-লালন-পালন করে সেবা ও সৃজনশীলতার ধারা প্রবাহমান রাখে। মানুষ মাত্রই সুযোগ ও সহায়ক পরিবেশ পেলে নিজেদেরকে যোগ্য করে তোলার প্রয়াসী। এই প্রচেষ্টা তার অভ্যন্তরীন। জন্মগতভাবেই স্বীয় শক্তি নিয়েই তার আগমন। যথাযথ পরিবেশ পেলে তার জাগরণ ঘটে।
কিন্তু আমাদের দেশে নানান কিছিমের রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছে। কারো কাছে ধর্মকে আশ্রয় করে, কারো কাছে কোন দেশের বিপ্লবী ঘটনাকে আশ্রয় করে আবার কাছে কাছে বিশেষ কোন গোষ্ঠীর ইচ্ছা পূরণ প্রবল হয়ে উঠেছে। একটি পক্ষ আরেকটি পক্ষকে ঘায়েল করতে সদা মরিয়া। ন্যূনতম মূল্যবোধ মানবতাও কখনো কখনো উপেক্ষিত হয়ে পড়ে। রাজনীতির নামে বহুমুখী চরম সাংঘর্ষিক অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে। যার রুগ্ন প্রকাশ অতীতে বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে। বিশেষ করে স্বাধীনতার প্রশ্নে বড় ধরনের ক্ষত, জাতির জনকের হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করতে বাধা প্রদান সেই রুগ্ন ক্ষতকেই তুলে ধরে।

গবেষণা বলছে রাজনীতি একটি অগ্রসরমান নীতিকৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষমতার ধারক। আবার হাল আমলে রাজনীতির সংজ্ঞায় বলা হচ্ছে রাজনীতি এমন একটি ক্ষমতা যা সেবা ও সৃজনশীলতার ধারাকে গতিশীল রাখে। রাজনীতির সুখ হচ্ছে এটি দেশ-জাতিকে নির্মাণ করে। প্রকৃষ্ট গতি সৃষ্টি করা যাতে সেবা ও সৃজনশীলতার ধারা চলমান থাকে। অসুখ হচ্ছে বিকাশের ধারাকে বাধা দেয়া, নিজেদের মতো করে চলতে না দেয়া, সব জায়গায় অন্ধ কর্তৃত্ব আরোপের অপচেষ্টা করা। অসুখ হচ্ছে যখন এটি লুটপাট ধ্বংসের হাতিয়ার হয়ে উঠে। ’৭৫ ছিল বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য অসুখ। রাজনীতির কারণেই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র স্বীয় অস্তিত্বকে আদায়ের পথে সামর্থ্যরে প্রমাণ দিয়েছে। বাঙালির অন্তরে স্বাধিকারের যে বীজ শিল্পী সাহিত্যিক সাধক কৃত্বিমান ব্যক্তিত্বরা জাগ্রত করেছেন তা বাঙালির রাজনৈতিক শক্তির উৎস। সমাজে নিরবে-নিভৃতে মহান ব্যক্তিত্বদের সব বুননই এক সময় মহীরূহে পরিণত ও উদ্ভাসিত হয়। পুরো আঠারো শতাব্দীতে অসংখ্য সৃষ্টিশীল বাঙালীকে খুঁজে পাওয়া যাবে যারা নিরবে-নিভৃতে কাজ করেছেন। সে সব কৃত্বিমান সত্য মানুষদের কর্মের ফলেই  বিট্রিশ বেনিয়াদের বিভাজন সৃষ্টির চক্রান্ত রুখে দেয়া ও জাতি সনাক্তের বীজমন্ত্র খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়েছে। তারই ফল স্বদেশী আন্দোলনের বুৎপত্তি। রাজনৈতিক শক্তির উন্মেষপর্ব। অনুসন্ধানে দেখা যায় পুরো উনিশ শত সাল বাঙালির রাজনৈতিক উত্থানের সময়। তীব্র রাজনৈতিক জাগরণ বাঙালির প্রাণপ্রাচুর্যে বিপুল শক্তি সৌন্দর্যের স্বাক্ষর বহন করে। কালোত্তীর্ণ রাজনৈতিক উত্থান পর্বের অপরূপ জাগানিয়া মাহেন্দ্রক্ষণ। বাঙালি করেছে রাজনীতি আর শোষক পাকিস্তান বিট্রিশরা করেছে শোষণ।  ৫২, ৬২, ৬৪, ৬৯,৭১। এগুলো সবই রাজনীতির সুখ। একদিকে সত্যেন সেন, বিপ্লবী বিনোদ বিহারী, সুভাস বোস, ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা, কাজী নজরুল ইসলাম, মণিসিংহ , ফজলুল হক,  ভাসানী, বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর, কামরুজ্জামান, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, শেখ হাসিনা এসব মহান ব্যক্তিত্ব দেশের রাজনীতির সুখ সমৃদ্ধি বন্ধুত্বের দৃষ্টান্ত। রাজনীতি করে এরা কেউই কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাননি। এদের নামে বিদেশে টাকা পাচারের কোন অভিযোগ নেই। দেশের জেলা শহরে অসংখ্য নেতার নাম পাওয়া যাবে যারা আমৃত্যু আদর্শিক রাজনীতি করেছেন। ৭১’ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে, নব্বই এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে যারা প্রাণ দিয়েছেন তারা সবাই রাজনীতির সুখ হিসেবে অম্লান থাকবে। পরিবর্তিত সময়ের চাহিদা ও বাস্তবতায় রাজনীতির রূপ গতি পাল্টাবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সৌন্দর্যহানী অসুখও কি পাল্টা দিয়ে বেড়ে যাবে। রাজনীতির নামে দখল জিম্মির অসুখের জ্বলজ্বলমান ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে পুরো জাতি। বাঙালির অমিত শক্তি সৌন্দর্যের উপর আজও ছুরি চালানো হচ্ছে। সৃষ্টিশীল মানুষের অবদানকে খাটো করে দেখার অসুখের রাজনীতিই তো সব কিছু ছাপিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। দমিয়ে রাখা, মিথ্যা প্রতারণা ছলা-কলা অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে সাধারণ কর্মী সমর্থক দেশের মানুষের সাথে ছিনিমিনি খেলা রাজনীতির মহা অসুখ। যে রাজনীতি নেতাদের আচরণে চিন্তায় পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়নি সে রাজনৈতিক দলের ফলাফল হচ্ছে অসুখ। রাজনীতির অসুখই বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমান বাংলাদেশে।  এই অসুখ থেকে কি বাঙালি জাতি মুক্তি পাবে না!!! 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন