থাকবে শিশু সবার মাঝে ভালো,
দেশ-সমাজ, পরিবারে জ্বলবে আশার আলো
ফরিদা
॥ আজকের শিশু আগামী দিনের কর্ণধার। শিশুদের সঠিক বিকাশেই রয়েছে ভবিষ্যতের সুন্দর শান্তিময়
বিশ্ব। একথা নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না যে বড়দের মতো শিশুদেরও রয়েছে অধিকার। যেহেতু
তারা অপ্রাপ্ত বয়স্ক সেহেতু তাদের জন্য বিশেষ রক্ষাব্যবস্থা আবশ্যক। আর তাই জাতিসংঘ
সাধারণ পরিষদের ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ২০ নভেম্বর তারিখে গৃহীত হয় শিশু অধিকার সনদ। সনদটি
একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি বা কনভেনশন। শিশুদের অধিকার সম্পর্কে জনগণকে ব্যাপকভাবে সচেতন
করে তোলা এবং শিশুদের অধিকার কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ব্যাপক প্রচারণার জন্য
জাতিসংঘের আহ্বানে প্রতিবছর ২৯ সেপ্টেম্বর হতে সপ্তাহব্যাপী পালিত হয় শিশু অধিকার সপ্তাহ।
সপ্তাহের প্রথম দিনটি অর্থাৎ ২৯ সেপ্টেম্বর গুরুত্ব পায় শিশু অধিকার দিবস হিসেবে। ১৯৮৯
খ্রিষ্টাব্দের ২০ নভেম্বর শিশু অধিকার সনদ গৃহীত হলেও এটির কার্যকারিতা শুরু হয় ১৯৯০
সালের ২ সেপ্টেম্বর হতে। বাংলাদেশ সনদ অনুসাক্ষরকারী প্রথম ২২টি দেশের অন্যতম। ১৯৯০
সালের ৩ আগস্ট বাংলাদেশ শিশু অধিকার সনদে সাক্ষর করে।
প্রতিটি
শিশুর রয়েছে স্বাস্থ্যকর ও শান্তিময় পরিবেশে বেঁচে থাকা ও বেড়ে উঠার অধিকার; সমাজের
একজন প্রয়োজনীয় ও যোগ্য সদস্য হবার অধিকার। দুর্ভাগ্যক্রমে দারিদ্র, রোগবালাই, যুদ্ধ
ও নিপীড়নের কারণে প্রতি বছর মারা যাচ্ছে হাজার হাজার শিশু। জন্মসূত্রে একটি নাম ও একটি
জাতীয়তার অধিকার রয়েছে প্রতিটি শিশুর। পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ আছে যেখানে শিশুর জন্মমৃত্যুর
রেকর্ড রাখা হয় না। শরণার্থী ও শিশুরা কোন্ দেশীয় জনগোষ্ঠী থেকে এসেছে তা প্রায়ই নিবন্ধন
করা হয় না। প্রায়ই শিশুরা ক্রয়-বিক্রয়ের পণ্যে পরিণত হয়। নাম বা পরিচয়হীন শিশু বৈষম্য
ও দাসত্বের শিকার হয়। এসব লংঘিত মানবাধিকার বিশ্বে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
জাতিসংঘ
সাধারণ পরিষদ ১৯৪৬ সালে তার প্রথম অধিবেশনকালেই যুদ্ধপরবর্তীকালীন ইউরোপ ও চীনের শিশুদের
খাদ্য ঔষধ ও বস্ত্রের প্রয়োজনীয়তার দিকে লক্ষ্য রেখে গঠন করে ইউনিসেফ। বিশ্বের শিশুদের
মৌলিক প্রয়োজনীয়তা ও বিকাশ মনিটরিং যা ছিল এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। আজ বিশ্বের অধিকাংশ
দেশে ইউনিসেফ মর্যাদার সঙ্গে শিশুদের শারীরিক-মানসিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশে বাস্তবায়ন
করছে অসংখ্য কর্মসূচী। ১৯৫৯ সালে সাধারণ পরিষদ গ্রহণ করে শিশু সংক্রান্ত অধিকার ঘোষণা-এই
ঘোষণার উদ্দেশ্য ছিল প্রতিটি শিশুর মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা। আর সেই সাথে শিশুদেরকে
তাদের নিজ নিজ দেশের উন্নয়নের জন্য গড়ে তোলা। শিশুদের অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণার ২০তম
বর্ষ ১৯৭৯-কে সাধারণ পরিষদ ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক শিশু বর্ষ।
জাতিসংঘ
সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত শিশু অধিকার সনদে বিশ্ব মানবতা শিশুর জন্য যা কামনা করে
তা সবচেয়ে স্পষ্ট ও পরিপূর্ণভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এই সনদ সর্বাধিক স্বীকৃত মানবাধিকার
চুক্তিসমূহের অন্যতম বটে। সকল শিশুর কল্যাণ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সনদে বর্ণিত নীতিমালা
অনুসরণের জন্য সনদে স্বাক্ষরকারী হিসেবে বাংলাদেশ আইনগত ও নৈতিকভাবে দায়বদ্ধ। শিশু
অধিকার রক্ষায় মা-বাবার ভূমিকা, শিশুর মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন। শিশু অধিকার
সনদ অনুযায়ী শিশুর বয়স ১৮ বছর পর্যন্ত। সনদের ৫৪টি ধারা আছে।
শিশুদের
জীবনযাত্রা উন্নয়নে এই সনদটি বিশ্বের সর্বত্র রাষ্ট্রগুলোকে সুনির্দিষ্ট পথনির্দেশনা
দেয়। তবে শিশু অধিকারের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া বা না নেয়ার বিষয়টা সংশ্লিষ্ট
রাষ্ট্র কিংবা তার জনগণের উপরই নির্ভর করে। আর তাই জনগণ ও রাষ্ট্রকে শিশু অধিকার সনদ
বাস্তবায়নের উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে এবারও পালিত হলো শিশু অধিকার সপ্তাহ ও দিবস।
‘বিশ্ব
শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ-২০১৬’ উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক
মন্ত্রণালয় গত সোমবার সকালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি মিলনায়তনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
এ বছরের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘থাকবে শিশু সবার মাঝে ভালো, দেশ-সমাজ, পরিবারে জ্বলবে আশার
আলো’ । অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী
বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কোন
শিশুই যেন না খেয়ে কষ্ট না পায় এবং শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, তা নিশ্চিত করতে
সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী
বিত্তবানদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনাদের বাড়ির আশপাশে যারা দরিদ্র শিশু আছে তারা কেমন আছে,
তার গায়ে কাপড় আছে কি না, তারা পেটভরে খেতে পারছে কি না, সে লেখাপড়া করতে পারছে কি না- তা দেখবেন এবং দয়া
করে এইসব শিশুর দিকে একটু নজর দেবেন।’ তিনি শিশুদের ঝরে পড়া রোধে বিদ্যালয়ে শিশু-বান্ধব
পরিবেশ সৃষ্টি ও ‘মিড ডে মিল’ চালুর উল্লেখ করে এই কাজে সরকারের পাশাপাশি স্ব-স্ব এলাকার
বিত্তবান এবং জনপ্রতিনিধিদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। এ সময় ৭৫’ এর ১৫ আগস্ট ঘাতকদের
হাতে নির্মমভাবে নিহত বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী
বলেন, ‘তোমাদের মতো আমারও একটি ছোট্ট ভাই ছিল। আমি তোমাদের মাঝে আমার সেই ছোটভাই রাসেলকে
খুঁজে ফিরি।’ তিনি শিশুদের উদ্দেশে বলেন, ‘তোমাদের জন্য জাতির পিতা এই সুন্দর দেশ দিয়ে
গেছেন। আমার প্রত্যাশা, তোমরা বড় হয়ে জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে তাঁর স্বপ্নের
‘সোনার বাংলা’ গড়ে তুলবে। বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে মর্যাদাপূর্ণ আসনে তুলে ধরবে।’
প্রধানমন্ত্রী
বলেন, আমাদের শিশুরা যেন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে সেজন্য তাঁর সরকার নানা
কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বইয়ের বোঝা বইতে যেন না হয় সেজন্য সরকার ই-বুক করে দেবে। বাচ্চারা
ট্যাব নিয়ে স্কুলে যাবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত করতে কম্পিউটার
ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছি। কোনো ছেলে-মেয়ে যেন স্কুল থেকে ঝরে না পড়ে সেদিকে আমরা
বিশেষ নজর দিচ্ছি। আমাদের সরকার বই কেনার দায়িত্ব নিয়েছে, দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা
করেছে। হাওর এলাকা, পাহাড়ি এলাকায় শিশুদের দূর থেকে স্কুলে আসতে কষ্ট হয়। তাই আবাসিক
স্কুল, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম এবং আইসিটি ল্যাব প্রতিষ্ঠা, বিদ্যালয়বিহীন প্রতিটি গ্রামে
বিদ্যালয় স্থাপন, প্রাথমিক স্কুল পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ এবং বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা
মুজিব গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট চালু, দেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের
অংশগ্রহণে আন্তঃপ্রাথমিক বিদ্যালয় ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন, পথশিশু,
ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ও বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া শিশুদের কল্যাণে আর্থিক সহায়তা দেয়া
ইত্যাদি সরকারি উদ্যোগের বিবরণ তুলে ধরেন।
মহিলা
ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ
অতিথির বক্তৃতা করেন বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক সেলিনা
হোসেন, ইউনিসেফের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ এডওয়ার্ড বেইগবেডার এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক
মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিমা বেগম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন