বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসঃ কিছু ভাবনা
শাহ্
শাহনাজ সুলতানা ॥ মন থেকে মানসিক। কথায় বলি তার মানসিক অবস্থা ভাল না। ঠিক কোন অবস্থায়
এই মানসিক খুঁটিনাটি বিষয়গুলো স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, সাধারণ মানুষ বুঝতে
পারে না। পারলে শারিরীক স্বাস্থ্যের মতো যথাসময়ে
এই সমস্যা সমাধানে তৎপর হতো। অবজ্ঞা আর অবহেলায় ছোটখাটো মামুলি ব্যাপার থেকে একসময়
বিশাল কিছুতে পরিণত হয়। এমন একটা সমস্যার নাম মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা।
১০
অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। সারা বিশ্বে বিভিন্ন প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে এই
দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে এই দিবসটিকে
সামনে রেখে আলোচনা সেমিনার আয়োজন করা হয়ে থাকে।
মানসিক
সমস্যা তারই হয় যার অনভূতি আছে অনুভূতিহীন কাউকে মানুষ বলা যায় না। নিজের অজান্তেই
চারপাশের কিছু ঘটনা, কোন কথা, অথবা চিন্তার বাড়াবাড়ি চাপের সৃষ্টি করে। বেলা রহমান
(আসল নাম নয়) একসময় এতটা মানসিক চাপের মধ্যে থেকেছেন যে, ঘুমানোর সময় বাদে বাকি সময়টা
কেটেছে দুশ্চিন্তায়। রিকশায় উঠলে মনে হতো এই বুঝি গাড়ির সাথে চাকাটা লেগে গেল। ঘরের
বাইরে বেরুতে চাইতেন না। পরিবারের কোন সদস্য কাজের প্রয়োজনে বাইরে অবস্থান করলে সারাক্ষণ
চিন্তা করা, অথবা অযথা মাথা গরম করা ছিল তার নিত্য কাজ। সমীক্ষায় দেখা যায়, অধিকাংশ
মহিলা মানসিক রোগে ভোগে। কোন সুনির্দিষ্ট কারণে
এই সমস্যার সৃষ্টি হয় না। সমষ্টিগত কারণ এক হয়ে ধীরে ধীরে তাকে বা কোন ব্যাক্তিকে রোগীতে
পরিণত করে। যার শিকার হয় পরিবারের সদস্য নিরীহ শিশুরা।
সফল
পিতামাতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে
সন্তানের মনস্তাত্বিক দিকটা বুঝতে পারা। আজকাল পিতা-মাতা দুজনেই ব্যস্ত থাকে। একই সাথে
তাদের অনেক কাজ করতে হয়। কিন্তু এই ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে এমন একটা সময় আসে যখন তারা
দেখতে পায় তাদের প্রিয় সন্তানটি সম্পর্কের বেড়াজালে নামমাত্র জড়িয়ে আছে। আসলে সে কোন
এক দূরের দ্বীপ। কথা হয়, আবার হয়না। দেখা হয়, ভালো করে কথা হয় না। মুক্ত হয়ে কথা বলা,
পারস্পরিক লেনদেন হচ্ছে না। যদি কোন পিতা-মাতা ভাবেন শুধুমাত্র ডাইনিং টেবিলে খাওয়ার
সময় একটু সময় দেয়া, কথা বলা, অথবা গাড়ি চালানোর সময় পাশে বসিয়ে খোঁজখবর নেয়া যথেষ্ট
তবে এটাই বলতে হবে তিনি ভুলের স্বর্গে বাস করছেন। সবসময় সন্তানের পিছনে এটাসেটা নিয়ে
লেগে থাকা, তার জন্য সময় দেয়া বুঝায় না। ঠিক
তেমনি নিজের কাছে প্রশ্ন রেখে বের করতে হবে সারা দিনের একটা সময় শুধুমাত্র তাকে দেয়া
বা তার পিছনে উৎসর্গ করা হয় কিনা। যার নাম কোয়ালিটি টাইম দেয়া। কোয়ালিটি টাইম দেয়া
মানে সবসময় তার সাথে কথা বলা বা কিছু একটা একসাথে করা নয়। মাঝে-মাঝে তাদের সাথে বসে
তাদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করা , তাদের আচরণগত দিক ও অভ্যন্তরিণ বিষয় খতিয়ে দেখা। পর্যবেক্ষণ
করা আর দেখাকে এক করে ফেললে সমস্যা সৃষ্টি হয়। এর জন্য দরকার পরিপূর্ণ মনোযোগ দেয়া
: যখন সময় দেয়া হবে শুধু তাকেই দেয়া হবে। সম্পূর্ণ মনোযোগ পাওয়া শিশুর অধিকার। রান্নার
সময় কথা বলা, ড্রাইভিং এর সময় কথা বলা যথেষ্ট নয়। তার প্রতি অখন্ড ভালবাসা সন্তান বড়
না হওয়া পর্যন্ত নিজেকে নিরাপদ ভাবে এবং নিজেকে মেলে ধরে। আমার জানামতে ১১ বছরের এক
শিশু আছে যে বাসায় গাছের সাথে কথা বলে। কারণ তার সাথে কথা বলার মানুষ নেই। এখানে কথা
বলার মানুষ আছে কিন্তু শোনার মানুষ নেই। কারণ এখন প্রায় প্রত্যেক পরিবারে একটি সন্তানের
বেশী নেয়া হয়না। নিলে বড়জোর দু’টি সন্তান। আমেরিকার লেখক ও গবেষক ড. স্টিফেন কোভ তার
‘দি সেভেন হ্যাবিটস অব হাইলি ইফেক্টিভ পিপল’ বইতে চার ধরণের শোনার কথা উল্লেখ করেছেন।
যা সাধারণ মানুষ করে থাকে। যেমন হেলায়- হেলায় কারও কথা শোনা। ব্যাপারটা এরকম তুমি তোমার
কথা বলে যাও আমি আমার কাজ করি।
আরেকটা
হলো শোনার ইচ্ছা নেই তবু চেষ্টা করি। অনেকটা ভনিতা করা। চুপ করে শুনছে মনে হচ্ছে কিন্তু
সে অন্য কোন চিন্তা করছে। অবচেতন চিন্তার স্তর থেকে শোনা। একটু শোনার পর প্রশ্ন করা
কি বললে? অর্থাৎ কিছুটা শোনা। চার নম্বর হলো মনোযোগ দিয়ে শোনা। মনোযোগ দিয়ে শোনার বিষয়টা
বোধের ব্যাপার। তার মানে এই নয় তার কথা গিলে খাওয়া। দু’জন ব্যাক্তি যে কোন বিষয় নিয়ে
এক হতে পারে না।
এক
হওয়ার নাম যুক্ত হওয়া, যেখানে পারস্পরিক সম্পর্ক দৃঢ় হয়। যদি হাজারটা প্রশ্নের মধ্যে
একটা প্রশ্ন খুঁজে বের করতে বলা হয় তবে এটাই সত্য সেই প্রশ্ন হবে - সম্পর্ক কি ? আমাদের
মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের সমন্বয়হীনতা, উত্তর না জানার কারণেই হয়। একই ছাদের নিচে
অবস্থান করে একটি মানুষের অনুরক্ত হতে পারিনা। কেন? কারণ পাশাপাশি অবস্থান করেও সর্বদা
বর্তমানকে অবজ্ঞা করে সহ-অবস্থান করা হয়। যার শিকার হয় পরিবারের শিশুরা। শিশুদের ব্যক্তিত্ব,
স্বভাব পরিবেশের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। দৃষ্টিভঙ্গিও গড়ে উঠে এই আদলে। পরিবেশ সন্তানের
মনস্তাত্বিক দিক উন্নত করে বা অবদমন করে। অবদমন
প্রক্রিয়া একটি সর্বনাশা দিক যা তাদের মানসিক সমস্যার দিকে ক্রমশ নিয়ে যায়। প্রথমদিকে পুরো ব্যাপার অগোচরে থেকে যায় যতক্ষণ
পর্যন্ত মানসিক সমস্যার লক্ষণগুলো না দেখা
যায়। অনেক পিতা-মাতা সন্তানকে প্রশ্নের খাতিরে প্রশ্ন করে থাকে। যা একবারেই অনুচিত।
তার মতামত পাওয়া বিশেষ করে বয়সের কারণে, হরমোনের পরিবর্তনের কারণে তাদের মুড বুঝা,
বুঝার চেষ্টা খুব কম পিতা-মাতা করে থাকে। একশতে ২০ জন পিতা-মাতা এর ব্যতিক্রম হলে বর্তমান
সমাজে বিরাজ করা তরুণ সমাজ নিয়ে অভিভাবকদের আহাজারি কমবে। এটাই আশার কথা। আশা বুঝতে
হলে নিরাশাকে বুঝতে হয়। আশা-নিরাশা পাল তোলা নৌকা। আবেগ হয় বৈঠা, নৌকার ভারসাম্য রাখতে
হলে আনন্দকে বাতাস হিসেবে নিতে হয়।
তাই
সন্তানের বিভিন্ন ধাপের সাথে পরিচয় রাখা বাঞ্ছনীয়। এজন্য দরকার পিতা-মাতার ইতিবাচক
দৃষ্টিভঙ্গি। দরকার স্ব-শিক্ষা। অন্য সন্তানকে পর্যবেক্ষণ করলে নিজের সন্তানের অনেক
সমস্যার সমাধান আসে। তুলনা নয় শুধু পর্যবেক্ষণ শক্তি দিয়ে বুঝার চেষ্টা করা। সমানুভূতি
বলে একটা শব্দ আছে অভিধানে। সহানুভূতির চেয়ে সমানুভূতি দরকার অন্তত, আজকের প্রযুক্তির
যুগে। কোন কোন পিতা-মাতা ধারণা পুষে রাখেন তার ছেলে অথবা মেয়ে কোন অভিযোগ করেনা চুপচাপ
থাকতে পছন্দ করে। এ ধরণের ধারণা পুষে রাখা সন্তানের জন্য মঙ্গলজনক নয়। চোখ খোলা রেখেও
তারা বন্ধ করে রাখছেন। অভিযোগ না থাকা, বা
কোন কিছু না বলা মানে এই নয় তার কোন চাওয়া-পাওয়া নেই। অযাচিত চাওয়া যেমন ভাল
না ঠিক তেমনি কিছুই না বলা ভাল না। পরিস্কার ভাবে কথা বলে তার সাথে পারস্পরিক সম্পর্কের
বন্ধন দৃঢ় করা প্রয়োজন। হয়না বলেই পরিবারে বেড়ে উঠা একমাত্র মেয়েটি পোষা প্রাণীর সাথে
কথা বলে, একা একা বিড় বিড় করে। পড়াশুনায় কোন মনোযোগ নেই। কোন গতি নেই। সন্তানরা তাদের
কিছু আচরণ আয়ত্ব করে পিতা-মাতার কাছ থেকে, পরিবার থেকে, সমাজ থেকে, পরিবেশ থেকে। যে
আচরণ অস্বাভাবিক, মাত্রাধিক্য তার নাম মানসিক রোগ। দেখা যায় বিষন্নতা, দ্রুত মুড পরিবর্তন,
অস্থিরতা, আবেগ প্রবণতা, হতাশা। এক্ষেত্রে সন্তানরা কোন সময় নিজেদের নিঃসঙ্গ করে ফেলে।
তথাকথিত বড়রা (!) চিন্তাভাবনা করে তাদের দিক থেকে অবস্থান করে। এটা না ভেবে সন্তানের
বয়সের অবস্থানে নিজেদের কিছুটা সময় ভাবতে সক্ষম হলে তখন দেখতে পায় তারা কতটা অধৈর্য।
এই সময়ে এই বয়সে তারা কি ছিল? নিশ্চয় সমাজের
আঙ্গিক পরিবর্তন হয়েছে সময়ের হাত ধরে। শিশু
বিকাশের ধাপ সময়ের সাথে পরিবর্তন হয়নি, হয়েছে কেবল পদ্ধতিগত দিক। আগে আমরা মাইলের
পর মাইল হেঁটে স্কুলে যেতাম এখন আজকের অনেক শিশু তা ভাবতে পারেনা। শিশুদের নিজস্ব পৃথিবীটা
মঙ্গলগ্রহ হয়ে যায়। জনমানবহীন এই গ্রহে তারা মানসিক রোগী হয়ে বসবাস করে যখন পিতামাতা
দু’জনেই কোন না কোন ভাবে মানসিক সমস্যায় ভুগে থাকে। মোহ, পরশ্রীকাতরতা, সংকীর্ণতা,
হিংসা ইত্যাদির জালে পিতামাতারাই একবার ডুবে একবার ভাসে। আমরা যেমন শারীরিক স্বাস্থ্যের
প্রতি লক্ষ্য রাখি তেমনি মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতিও লক্ষ্য রাখা দরকার। বিশ্ব মানসিক
স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় যাই হোক না কেন উপলব্ধির উপরে আর কোন শব্দ থাকতে
পারে না। সচেতনতার সাথে পথ চলায় আনন্দ যোগ হলে আর কি প্রয়োজন পড়ে?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন