বৃহস্পতিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৬

সময়ের সাফ কথা.... সাবধান! আমি সাংবাদিক!!

সময়ের সাফ কথা....
সাবধান! আমি সাংবাদিক!!

অ্যাড. এম. মাফতুন আহমেদ ॥ সাংবাদিকরা এক সময় সমাজের গুণী হিসেবে সমাদর পেতেন। প্রথম শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী হিসেবে সমাজের সবাই তাদের শ্রদ্ধা করতেন। ইদানিং সাংবাদিক পরিচয়টাও কোথাও কোথাও আকর্ষণের বিষয়বস্তু নয় মোটেও। এক শ্রেণীর সাংবাদিক দেখলে কেউ কেউ বলেন, চাপাবাজ-ধান্দাবাজ। কেউ কেউ ভাবেন, বেটা আস্ত একটা টাউট। লেখা নেই, পড়া নেই অথচ মস্তবড় সাংবাদিক। কারও চোখে সাংবাদিক মানে স্বল্প বেতনভুক্ত ছা-পোষা কেরাণী। এক শ্রেণীর হাইবিড রাজনীতিক দেখলে লোকেরা ভাবেন, বেটা বুঝি চাঁদা চাইতে এলো। এদের চোখে রাজনীতিক মানেই ভবঘুরে। কারও কারও দৃষ্টিতে জেলখানার কয়েদি। আর আইনজীবী! আমার পিতা বলতেন- ‘আইন  পেশা লর্ড ফ্যামিলির পেশা। আমাদের মতো হত:দরিদ্র পরিবারের লোকদের চটি পায়ে, যেনতেন কালো স্যুট গায়ে লাগিয়ে এ পেশায় তেমন একটা মানায় না। লর্ড পরিবারের সন্তানরা পেশা হিসেবে যতটুকু না বেছে নিয়েছিলেন তার থেকে সেবাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। এখন এক শ্রেণীর উকিল দেখলে অনেকে ‘লায়ার’ বলেন। আবার এক শ্রেণীর ডাক্তার দেখলে বলেন ‘কসাই’, অনেকে বলেন ‘কমিশনবাজ’।
৩৬ বছর আগের কথা। বিখ্যাত দৈনিক আজাদ পত্রিকায় সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। উপমহাদেশের সাংবাদিকতার দিকপাল মোদাব্বের সাহেব বলতেন, ‘ভাল সাংবাদিক হতে গেলে পেশার শুরুতে একটু প্রেসের কালি মুছতে হয়; সিনিয়রদের সাথে থেকে কাজ শিখতে হয়’। তাই মুরুব্বিদের কথামত সাংবাদিকতায় দক্ষতা অর্জনে মনের বিরুদ্ধে ক’বছর প্রেসের কালি মুছতে হয়েছে। তখন জানতাম সংবাদপত্র রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। সাংবাদিকরা জাতির বিবেক, সাহসী সন্তান ও অতন্দ্র প্রহরী। সোনালি অতীত সাক্ষ্য দেয় যে, এই উপমহাদেশে যত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে সংবাদপত্র-সাংবাদিকরা পালন করেছে অগ্রণী ভূমিকা।
ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ আমলে, এমনকি পাকিস্তান আমলেও সাংবাদিক, রাজনীতিক, আইনজীবী এদের আলাদা একটা মর্যাদা ছিল। লোকে ভয় করতো, শ্রদ্ধা করতো, ভালবাসতো, সম্মান করতো। আজকাল ভয়  করে। তবে হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে ভালবাসেন কিনা সন্দেহ। এ কথা সত্যি যে, সবাই সমাজের কাছে অশ্রদ্বেয় ব্যক্তি নয়। বিশেষ কাউকে কাউকে শ্রদ্ধা অবশ্যই এখনও করেন। আমি সেই বিশেষের দলভুক্ত নই মোটেও।
যুগ, সমাজ, পরিবেশ, পারিপার্শি¦কতা পাল্টে গেছে। সর্বত্রই আমূল পরিবর্তন। হয়েছে নীতি-নৈতিকতার পরিবর্তন। বিশ্ব আজ উন্নয়নের চূড়ান্ত সীমায়। কিন্তু যান্ত্রিক সভ্যতার এই যুগে আমাদের  নৈতিক স্খলন ঘটেছে চরমভাবে? প্রত্যেক মোটর সাইকেলে কিংবা গাড়ির পেছনে নেমপ্লেট থাকে। যেখানে লেখা থাকে গাড়ির রেজিষ্ট্রেশন নম্বর। কর-খাজনার বিনিময়ে সরকার নির্ধারণ করে দেয় একটি গাড়ির রেজিষ্ট্রেশন নম্বর। অনেকের গাড়ির পেছনে নেমপ্লেটে লেখা থাকে ‘সাংবাদিক’! কারণ আমার মতো অনেক সাংবাদিকের গাড়ি কিংবা মোটর সাইকেলের রেজিষ্ট্রেশন নেয়া লাগে না। এসব দেখে অনেকে প্রশ্ন করেন, সাংবাদিকদের জন্য কী আলাদা আইন? আপনারা কী অন্য কোন ভূবনের বাসিন্দা? তখন কী বলি? কী-ই-বা বলার আছে? আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু একটা বলতে হয়। তাই দুরুদুরু কন্ঠে কিছু একটা বলতে ইচ্ছে করে। রকমফের কৌশল করে আমার মতো অনেক সাংবাদিক সংসার চালায়। অর্থ রোজগার করেন। তাই গাড়ির রেজিষ্ট্রেশন সংগত কারণে করেন না। গাড়ির গায়ে সাংবাদিক লেখা দেখলে আইন প্রয়োগকারি সংস্থার লোকেরা (!) ধরেন না। বরং সমীহ করেন।  চা-পান খাওয়ায়ে আপ্যায়ণ করেন। ব্যস, খেল খতম। নিমিষেই চলে যান পর্দার আঁড়ালে। অর্থাৎ এগিয়ে যেতে থাকেন অন্ধকার জগতে। এবার শুরু হয়ে যায় কথিত মাল্টি বিজনেস! অবশ্য সম্প্রতি সরকার গাড়ির রেজিষ্ট্রেশন ও নেমপ্লেট বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে যা অবশ্যই সাধুবাদ পাবার যোগ্য, সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।
এক সময় সাংবাদিকদের সম্মান এমন ছিল যে, কোন সরকারি কর্মকর্তা চাকুরির সুবাদে মফস্বলে এলে আগে সাংবাদিকদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হতেন। অত:পর এলাকার উন্নয়নে পরস্পর মত বিনিময় করতেন। কোন কোন ক্ষেত্রে তারা নিজ নিজ কর্মের জবাবদিহি করতেন। সেদিন পেশাগত কারণে এক মফ:স্বল শহরে গিয়েছিলাম। দেখি কিছু দলবাজ, মোসাহেব, পন্ডিত নামধারি সাংবাদিক ফুল নিয়ে এক কর্তার অফিসে বসে আছেন। আশে-পাশে অনেকে বলছেন সাংবাদিকরা এসেছেন নতুন স্যারকে বরণ করে নিতে। আবার টিপ্পনি কেটে অনেকে বলাবলি করছেন এরা কী সাংবাদিক না সাংঘাতিক? আমিও এক পর্যায়ে এ সাংবাদিকদের সাথে মিশে গেলাম। একটু সময়ক্ষেপণ করলাম। ফুল নিয়ে বসে থাকার কারণ কী আগে-ভাগে তাদের কাছ থেকে জেনে নিলাম। উপস্থিত কেউ কেউ বললেন, নতুন ‘স্যার’ আসছেন তাই সাদরে বরণ করতে এত সব আয়োজন। বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম, কোথায় চলেছে ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এই জাতি? যারা জাতির বিবেক, কেন তাদের এই দূরবস্থা? চাটুকারি, মোসাহেবি আর কাকে বলে? এখনও জানি যে, পদস্থ কেউ মফস্বল শহরে এলে প্রথমে প্রেসক্লাব বা সংশ্লিষ্ট অফিসে আসেন। যেখানে সাংবাদিকরা বসেন। আর উল্টো করে আমার মতো নাদান হলুদ সাংবাদিকরা বাহারি ফুলের তোড়া নিয়ে গিয়ে সেখানে অপেক্ষমান থাকেন, কখন কর্তা আসবেন আর কখন তাকে বরণ করে নেবেন। এসব চাটুকারি, দলদাসি শ্রেণীর সাংবাদিকতা ভিক্ষা বৃত্তির চেয়েও নিকৃষ্ট।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, এসব সাংবাদিকরা কার কাছে দায়বদ্ধ? জনতা না একজন রাষ্ট্রের আমলার কাছে। একজন দায়িত্বশীল সাংবাদিক শুধুমাত্র দেশ-জাতির কাছে, নিজ বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ। কারণ একজন ভাল সাংবাদিকের কোন বন্ধু নেই। বন্ধু গড়ে উঠতে পারে না। তার প্রকৃত বন্ধু শুধুমাত্র দেশ-জাতি। একজন দায়িত্বশীল সাংবাদিক সবার উপরে দেশ-জাতির স্বার্থকে বড় করে দেখেন।
অতীতে জেলা কিংবা উপজেলা শহরে সাংবাদিকরা প্রেসক্লাব করতেন। এখন কথিত সাংবাদিকের সংখ্যা এত বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে যে, এখন গ্রামে-গঞ্জে প্রেসক্লাব গঠন হচ্ছে। গ্রাম বা ওয়ার্ডে ক্লাবের মতো করে প্রেসক্লাব গড়ে উঠেছে। ব্যাঙের ছাতার মতো প্রেসক্লাবের আদলে হরেক রকমের নাম দিয়ে ‘হলুদ সাংবাদিক সিন্ডিকেট’ গড়ে উঠেছে। সম্প্রতি এক গ্রামীণ জনপদে গিয়ে দেখি এক কথিত ‘প্রেসক্লাব’। জিজ্ঞেস করলাম এখানকার প্রেসক্লাবের সদস্য কারা? তারা কী সত্যিকার কোনো সংবাদপত্রসেবি? জানা গেল, নামমাত্র কিছু সাংবাদিক আছে, কিন্তু এলাকার অধিকাংশ ব্যবসায়ী এই প্রেসক্লাবের দাতা সদস্য। পাঠকের প্রশ্ন, দাতা সদস্য আবার কী? এখানে কেউ কী শিক্ষানিবাস খুলে বসেছেন? যিনি ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণে জমি দান করেছেন, বা  নগদ অর্থ সাহায্য দিয়েছেন। তাই তাকে দাতা সদস্য বানাতে হবে? সবাই জানেন সাংবাদিকদের ঠিকানা সাধারণত হয় প্রেসক্লাবে। এখন ব্যবসায়িরা হয়েছে সেই প্রেসক্লাবের দাতা সদস্য। প্রেসক্লাব অন্য কোন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মতো কোন প্রতিষ্ঠান নয়। সেই প্রেস ক্লাবের সদস্য এখন চাল-আটার ব্যবসায়িরা। এসব কি গোটা জাতির জন্য অশনি সংকেত নয়? বিবেকহীনতা ও নৈতিকতার অবক্ষয় সমাজকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? কেউই কোন প্রতিবাদ করছেন না। প্রতিবাদীরা রাজপথে নেমে আসছেন না। শুধু চোখ দিয়ে দেখছেন, কান দিয়ে শুনছেন। নীতিবিরুদ্ধ এসব কাজকে  মৌনভাবে সমর্থন করছেন।
শুধু যে হলুদ সাংবাদিকে দেশ ছেয়ে গেছে তা নয়। সব পেশায় একই দূরাবস্থা। সর্বত্রই ধ্বস নেমেছে; কম আর বেশি।  যে দেশে টাকায় রাজনৈতিক দলের পদ-পদবি মেলে, ভোটের নমিনেশন জোটে, দুর্নীতিমুক্ত সার্টিফিকেট মেলে, ডিগবাজির রাজনীতি যেখানে প্রকট, গোটা জাতির মাথায় যেখানে পচন ধরেছে, নীতি- নৈতিকতা যেখানে বিবর্জিত, নগদ টাকা, আলু-কচু উপঢৌকন দিলে সব মেলে। মেধাবীরা টাকার কাছে হেরে যাচ্ছে। নিরপেক্ষতা এবং সৎ বচন এখন আপেক্ষিক কথা। আমরা শুধু টাকার পেছনে ছুঁটছি। লোভের আশায় কালোবাজারি, মুনাফাখোর, সুদখোর হচ্ছি। চাঁদাবাজ, ধান্দাবাজ, দালাল, মোসাহেবির খাতায় নাম লেখাচ্ছি। এসব এখন নেশায় নয়, পেশায় পেয়েছে। রুটি-রুজির হাতিয়ার হিসেবে বেঁছে নিয়েছে। সামান্য স্বার্থে জ্বী-হুজুর, জ্বী-হুজুর বলে মুখে ফেনা তুলছি। মেট্রিক পাশ করে এমবিবিএস ডাক্তার সেজে প্রতারণা করছি। আদালত আঙ্গিনায় ভূয়া উকিল সেজে জনগণকে ধোঁকা দিচ্ছি। দেশ বাজিকরে ছেয়ে গেছে। যে যেভাবে পারছে লুট-পুটে খাচ্ছে।
গোটা দেশ-জাতি এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। সুদ-ঘুষ রন্ধ্রে রন্ধ্রে জেকে বসেছে। তবুও নিঃশঙ্ক চিত্তে সম্মুখ সমরে এগিয়ে যেতে হবে। প্রতিটি কাজকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে বেছে নিতে হবে। শুধু সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে নয়, সমস্ত সৃজনশীল, সৃষ্টিশীল ও বনেদি পেশায় মেধাবীদের জন্য আগের মতো জৌলুস নেই। অথচ এ সব পেশা জাতির অহংকার যা একটি জনগোষ্ঠীর ভাগ্য বিনির্মাণে পালন করে অগ্রণী ভূমিকা। ভুলে গেলে চলবে না যে, প্রতিটি পেশায় জবাবদিহিতা রয়েছে। পাশাপাশি পেশার উৎকর্ষতা সাধনে সরকারি উদ্যোগ রয়েছে। আইন পেশার মান উন্নয়নে বা আইনজীবীদের জবাবদিহিতার জন্য বার কাউন্সিল রয়েছে। চিকিৎসকদের বা সাংবাদিকদের পেশার উৎকর্ষ সাধনে অনেক  প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
সব ঠিক আছে। কিন্তু সাংবাদিকতা জগতের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে আসল সমস্যাটি কোথায় এ নিয়ে ভাবেন কত জন? সময়ের প্রেক্ষাপটে হলুদ সাংবাদিকদের কেন এত উপদ্রব এটাকে সর্বাগ্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে। রোগকে চিহ্নিত করতে হবে। অত:পর সমস্ত শরীরে মলম লাগাতে হবে। হলুদ সাংবাদিকতাকে পরিহার করতে হবে।

প্রকৃত অর্থে কারা সাংবাদিক হবেন? কী কী যোগ্যতা তাদের থাকতে হবে? কে সাংবাদিক নিয়োগ দেবেন, কোন যোগ্যতা বলে নিয়োগ পাবেন? এ সব কোন কোন প্রতিষ্ঠান তদারকি করবেন তা আগে ঠিক করতে হবে। সংবাদপত্রের ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুভার ছেড়ে না দিয়ে গোটা দেশে সাংবাদিক নিয়োগে একটি সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে। সরকার এবং পত্রিকা কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। গুটি কয়েক সাংবাদিককে শুধু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে চলবে না, দেশব্যাপি সাংবাদিক নিয়োগে সরকার নিয়ন্ত্রিত একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে যোগ্যতা সাপেক্ষে নিয়োগ দানের ব্যবস্থা করতে হবে। সততাকে সামনে রেখে পরিকল্পিত জীবনের সূচনা এখনই করতে হবে। গোটা জাতিকে নিয়মের মধ্যে আনতে হবে। তখন হলুদ সাংবাদিকদেরকে সমাজে খুব একটা দেখা যাবে না। সাংবাদিক, রাজনীতিক দেখলে কেউ ভয় পাবে না। আন্তরিক শ্রদ্ধায় তাদের প্রতি মাথা নুয়ে আসবে। ফিরে আসবে আবার সেই অতীত সোনালী ঐতিহ্য।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন