সুশীল
নয়
প্রয়োজন
বুদ্ধিজীবী সমাজ
শেখ উল্লাস ॥ বাংলা একাডেমীর
সহজ বাংলা অভিধান অনুযায়ী বুদ্ধি শব্দটির অর্থ ধী-শক্তি, বোধ, জ্ঞান, পরামর্শ, মন্ত্রণা
(বুদ্ধি দেয়া)। বুদ্ধিজীবী হচ্ছে, যিনি বুদ্ধির দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করেন। যিনি জ্ঞান
ও বুদ্ধির চর্চা করেন। অপরদিকে, অভিধানে সুশীল শব্দের অর্থ হিসেবে বলা হয়েছে, সুবোধ,
সচ্চরিত্র, ভদ্র, স্বভাব-চরিত্র ভালো এমন। বাংলাদেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক
প্রেক্ষাপটে বুদ্ধিজীবী শব্দটির পরিবর্তে সুশীল সমাজ শব্দটির ব্যবহার দেখা যাচ্ছে এদেশের
স্বাধীকার ও স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, বুদ্ধিজীবী
শব্দটির যে ধরনের ঐতিহাসিক যোগসূত্র রয়েছে তার তুলনায় সুশীল সমাজ শব্দটি একেবারেই নতুন।
গভীর বিশ্লেষণে দেখা যায়, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ তথা দেশের স্বাধীনতা অর্জনের
পেছনে এমনকি এদেশের পশ্চাদপদ সমাজে মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোতে আনার বন্ধুর পথে বুদ্ধিজীবীদের
যে বিরাট অবদান রয়েছে, সেখানে সুশীল সমাজ শব্দ দু’টির আমদানীর মধ্য দিয়ে বুদ্ধিজীবী
শব্দটি ভুলিয়ে দেয়ার একটি সূক্ষ্ম কৌশল রয়েছে যা দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণের পথে
বিঘ্ন সৃষ্টির অপচেষ্টা ছাড়া কিছুই নয়।
বস্তুতপক্ষে, দেশ ও সমাজের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ
যেকোন রাজনীতি বা সমাজকর্মী, মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতা সংগ্রামী, সমাজ সংস্কারক তথা
রাজনীতিবিদ সকলেই বুদ্ধিজীবী। উঁচু মানের ধী-শক্তিসম্পন্ন না হলে একজন মানুষ কখনো রাজনীতিবিদ
হতে পারেন না। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
৭১’এর ৭ই মার্চে ভাষণ দিয়ে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে যেভাবে আস্বস্ত, সন্তুষ্ট
ও মুগ্ধ করে স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন এবং এর মধ্য দিয়ে মহান নেতার কী মানের
ধী-শক্তি ফুটে উঠেছিল তা সমকালীন বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসেরই এক অনবদ্য ঘটনা। এই ভাষণের
পর তিনি আন্তর্জাতিকভাবে ‘পয়েট অব পলিটিক্স (‘রাজনীতির কবি’) হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছিলেন।
তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, বঙ্গবন্ধুও একজন অত্যন্ত উঁচু মানের বুদ্ধিজীবী। স্বাধীনতার
জন্য একাত্তরে সারা এদেশে যে সব খ্যাতিমান শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক ও আইনজীবীকে
পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের এদেশীয় দালালদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল তাঁদেরকে বুদ্ধিজীবী
হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও তাঁদেরও বেশির ভাগ ছিলেন রাজনৈতিক কর্মী। তাঁদের একটি আদর্শ
ছিল, তাঁরা জনগণের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন, দেশ ও জাতির কল্যাণ সাধন ছিল তাঁদের জীবনের
ব্রত। এর জন্য তাঁরা দেশ ও বিদেশের কোনো শক্তি বা অপশক্তির কাছ থেকে কোনো দান বা প্রতিদান
আশা করেননি। জনগণ, দেশ ও সমাজই ছিলো তাঁদের কাছে সবকিছু। তাঁদের স্মরণে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে
লেখা আছে, ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই, নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান,
ক্ষয় নাই তার, ক্ষয় নাই’।
কবিগুরু এই কথাগুলো লিখেছিলেন, ঔপনিবেশিক
ব্রিটিশ শাসন থেকে দেশ মাতৃকাকে মুক্ত করতে গিয়ে যে সব সন্তান আত্মাহুতি দিয়েছিলেন
তাদের স্মরণে। তাই বুদ্ধিজীবী শব্দটি একজন সচেতন ও বিবেকবান বাঙালির কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আজকে যারা স্ব-ঘোষিত সুশীল সমাজ বা তাদের প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরছেন তাদের
মধ্যে নিবেদিতপ্রাণ কয় জন আছেন? তাদের বেশির ভাগই অবসরপ্রাপ্ত আমলা, ভোল পাল্টানো রাজনীতিজীবী,
বড় কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বা এনজিও কর্মী বা সংগঠক। তারা তাদের জীবনের মূল্যবান
সময় এবং দেশ বা বিদেশ থেকে পাওয়া আর্থ-সামাজিক সুবিধাগুলো নিয়ে ভোগ-বিলাসে ব্যয় করছেন,
চাকুরি করছেন নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থে, বাড়িয়ে যাচ্ছেন ব্যক্তিগত সম্পদ। তারা এখন
নিজেদেরকেই স্ব-ঘোষিত সুশীল বলে নিজেকে নিজেই অপমানিত করে যাচ্ছেন। এছাড়া, সাম্প্রতিক
বছরগুলোতে দেশে উচ্চ শিক্ষার সার্টিফিকেটধারী মানুষের সংখ্যা আগের তুলনায় প্রায় শত
গুণে বেড়েছে এবং সমাজের বিভিন্ন অংশে অবস্তুান করে এদের অনেকেও নিজেদেরকে সুশীল সমাজের
অংশ হিসেবে দাবি করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। মূলতঃ এরা সুবিধাভোগী, সুযোগ-সন্ধানী,
সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার ছাড়া আর কিছুই চায় না। এই অবস্তুায় সবচেয়ে বেশি সংকটে
পড়ছে সমাজ ও দেশ।
যে বুদ্ধিজীবী সমাজ এক সময় সাধারণ মানুষকে
অন্ধকার থেকে আলোর পথে আনার সংগ্রামে দিক নির্দেশক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে আজ তারা স্বার্থান্ধ,
সংকীর্ণ। এরা ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে কথা বলে না, পেট্রোল বোমা দিয়ে নিরীহ মানুষকে যারা
পুড়িয়ে মারছে, তাদের বিরুদ্ধে তারা নির্বাক। ফলে সমাজ ও দেশকে অস্বচ্ছ পথে চালিত করার
জন্য এরাই সবচেয়ে বেশি দায়ী। তাই জাতি ও সমাজকে সঠিক পথে আনতে হলে জাতির জন্য দেশপ্রেমিক
বুদ্ধিজীবীদের বেশি প্রয়োজন, স্বঘোষিত সুশীল সমাজ নয়। এই কথাটা সব সময় স্মরণ রাখা প্রয়োজন
যে, এই দেশ যতটুকু উন্নতি লাভ করেছে তার পেছনে ছিল দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবী সমাজ-এঁদের
কেউ নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিক কর্মী, কেউ বা সমাজকর্মী, শিক্ষক, সাংবাদিক, বা মুক্তিযোদ্ধা
- এঁরা কখনো নিজেদেরকে তথাকথিত সুশীল সমাজের সদস্য হিসেবে দাবি করে সাধারণ মানুষের
কাছে হেয় হননি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন