বুধবার, ২৫ মার্চ, ২০১৫

জলালাপ



তারিফ হোসেনের সত্য....
জলালাপ

তেষ্টা মিটলে সাধারণ মানুষ জল নিয়ে ভাবার তেমন চেষ্টা করে না। ভাবখানা এমন যে, মিটেছে তেষ্টা তো দেখে কী হবে শেষটা? কিন্তু অসাধারণ মানুষ পিপাসার্ত থাকে জলের রহস্য উন্মোচনে। একজন রসায়নবিদের কাছে জল মানে অনন্য ও ব্যতিক্রমী পদার্থ। জীববিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে অপরিহার্য বস্তুটির নাম জল। খাদ্য ছাড়া মানুষ ৬০/৬৫ দিন চলতে পারে, কিন্তু জলাভাবে কয়েকদিনের বেশি মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তাই জলের অপর নাম জীবন-এমনকী অমৃতও বলা হয়। কারণ মৃত্যুকেও সে অতিক্রম করে। তবে জল যেমন প্রাণদায়ী তেমন প্রাণঘাতী। অশুদ্ধ জল বাধায় ব্যামো। ভারীজল বানায় বোমা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তি অক্ষশক্তির ভারীজলের গবেষণাগার ধ্বংস করতে ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করেছিল।
প্রাচীন থেকে অর্বাচীন সব সভ্যতা বিকাশ লাভ করে মূলত জলের সহজলভ্যতা ও প্রাপ্যতার উপর। সিন্ধু, চীন, ব্যাবিলন প্রভৃতি প্রাচীন সভ্যতায় নগরায়ণ ছিল নদীকেন্দ্রিক। মধ্যযুগে মোগল সম্রাজ্যের মধ্যগগনে অর্থাৎ সম্রাট আকবরের শাসনামলে তিনি তার রাজধানী ফতেপুর সিক্রি থেকে আগ্রায় স্থানান-রে বাধ্য হয়েছিলেন জলসংকটের কারণে। ফতেপুর সিক্রির জলাধারে জলের বিষম টান পড়াতে আকবর যমুনাকূলে রাজার ধানী সরিয়ে নেবার টান অনুভব করেছিলেন।
মানব ও মানবেতর প্রাণীর কণ্ঠনিঃসৃত আওয়াজ কোলাহল-কলরোল, আর জলপ্রবাহের শব্দ কল্লোল। জল ভরার সময় এতে কলকল করে শব্দ হয়। কলসের একটি প্রতিশব্দ গাগরি এটিও ধ্বনির অনুকরণে তৈরী। কারণ এখানেও গরগর শব্দে জল প্রবেশ করে। জলের প্রবাহ মধুর হতে পারে। হতে পারে বিধুর। সমুদ্র জলের শ্বাস প্রাশ্বাস নিয়ন্ত্রিত ও পরিমিত হলে উপকূল থাকে অনুকূল। ঘটনাচক্রে সমুদ্রস্রোত সর্দি গরমিতে আক্রান্ত হলে জলোচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা জলের এই উচ্ছ্বাসকে কখনও সিডর কখনও নার্গিস, আইলা, লাইলা প্রভৃতি নামে অভিহতি করেন। নাম যাই হোক না কেন - ধ্বংসযজ্ঞে সিডর রীতিমত ‘ডর দ্যাহায়’ আর নার্গিস আইলা সম্পর্কে বলা যায় ‘তোমরা দ্যাশটারে এভাবে খাইলা।”
যে জলসীমায় মাছের রাজা ইলিশের বিচরণ জেলেদের অভিজ্ঞ চোখ সেই জলের  বর্ণ দেখে বুঝতে পারে কোন জায়গা  ইলিশশূন্য বা ইলিশপূর্ণ। ডাবজল, গাবজল, মাছধোয়া জল, কাঁচঘোলা জলে ইলিশের হদিস তেমনটি না মিললেও চোখাজল যে ইলিশে সয়লাব থাকে তো চোখাজেলেরা বিলক্ষণ বোঝে।
ল্যাংড়া-চ্যাংড়া সবার কাছেই চিংড়ি বেশ পছন্দের মাছ। মিষ্টি জলে বেড়ে ওঠা এই জলবিচ্ছুর নাম গলদা আর নোনাজলেরটি হল বাগদা। ভেজালের যুগে গলদার মধ্যে গলদ তো থাকেই উপরন্তু মহার্ঘ হওয়ায় গলদা কিনতে অনেকেই গলদঘর্ম হয়। হাতেগোণা জনাকয়েক বাগদাকে বাগে আনতে পারে।
জলের ব্যবহার ও অপব্যবহার যেমন বিস্ময়কর তেমন বিস্তৃত। রোজগোসল, শেষগোসল করতে জল, ছল করতেও জল; নজরুলের গানেই তার আভাস মেলে- ‘একেলা গোরী জলকে চলে গঙ্গাতীর।’ বল প্রয়োগ করতে জল ইদানিং দাঙ্গাপুলিশ বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে জলকামান ব্যবহার করে। কৌশল বা প্রকৌশল তথা শিল্পক্ষেত্রেও জলের কৌশলী ব্যবহার আছে। চিকিৎসায় জল অর্থাৎ হাইড্রোথেরাপি। অ্যালোপ্যাথি হোমিও প্যাথির মতো হাইড্রোপ্যাথি এক ধরনের প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতি। অজীর্ণ পিত্তপাথুরী অম্বলের চিকিৎসায় জলই সম্বল। হাঁপানি, গনোরিয়া, সিফিলিসের চিকিৎসায় বাষ্পস্নান হার্টের চিকিৎসায় উষ্ণপদস্নান, ঘর্ষণস্নান, বরফস্নান উপকারী।
জলের প্রতিশব্দ পানির আঞ্চলিক ব্যবহারঃ অঞ্চল বিশেষে মুড়কির অপর নাম জলপান, এক ধরনের শাককে বলা হয় পানি এলাচ, লাউকে পানিকদু, একজাতের আমন ধানকে পানিতারা, পানিশাইল বলে। তালের শাঁসকে পানিতাল, নাস্তাকে পানিটানি বলা হয়। পানিতে কোনো জিনিস রেখে তাকে শক্তপোক্ত করাকে বলে পানিট।
জল সর্বকালীন সার্বজনীনঃ জল আছে আবাদে - ধান, গম, ইত্যাদি ফসল উৎপাদনে। জল আছে বিবাদে - ফারাক্কা বাঁধ, টিপাইমুখ বাঁধ, তিস্তা বাঁধ নিয়ে দ্বিপাক্ষিক সমস্যাই তার জলজ্যান্তু প্রমাণ। জল আছে সংবাদে - ওয়াসার গাড়ির সামনে হাজার হাজার মানুষের লাইন। জল আছে প্রবাদে- জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ। জল আছে ধাঁধায়-উলুবনে তুলোর বাসা / সরসরিয়ে যায় / গায়ে নেই হাড়গোড়/ সর্বজাতি খায়। স্থাননামে জল-দহযুক্ত জনপদগুলোয় একদা বিশাল জলাধার থাকায় এইরূপ নামকরণ হয়েছে। যেমন পোড়াদহ, শিলাইদহ ইত্যাদি।
সাঁতার, নৌকাবাইচ ইত্যাদি ক্রীড়া জলে খেলা হয়। আবার ছিনিমিনিও খেলা হয় জলেই। জলে - ছুঁড়ে দেওয়া খোলামকুচির ভাসমান ব্যাঙের মতো দ্রুত লাফিয়ে যাওয়াটাই ছিনিমিনি খেলা। ছিনিমিনি শুধু মিনিমিনি ছেলেমেয়েরাই খেলে না সিনিয়ররাও ছিনিমিনি খেলে থাকে এবং তার ফল হয় অত্যন্ত ভয়াবহ। প্রসঙ্গত অন্নদা শংকর রায়ের ছড়াটি স্মরণীয়।
তেলের শিশি ভাঙল বলে
খুকুর পরে রাগ করো;
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা
ভারত ভেঙে ভাগ করো।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন