নারী মানব জাতির সম অংশ
* বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন ব্যবস্থা
নারী অবমাননার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
* অধিকার কেউ দিতে পারে না, এটি অর্জনের বিষয়। দায়িত্ব
ও কর্তব্য থেকেই আসে অধিকার।
* মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া নারীর ন্যায়সঙ্গত
অধিকার।
ফরিদা
॥ সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও গুরুত্বসহকারে
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন
করা হয়েছে। প্রশ্ন হল- আমরা কি আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে নারীকে ভাগ করে দিয়েছি?
মানুষ জাতির একটা অংশ ভাবছিনা? বিশ্বব্যাপী কিংবা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নারীর অবস্থান
আলাদা করে মূল্যায়ন করা কতটা যুক্তিসঙ্গত? নারী ও পুরুষ মিলে একটি মানব প্রজাতি হলে
শুধু নারীকে নিয়ে জাতিসংঘ ঘোষিত ৭টিরও অধিক বিশ্ব দিবসের অবতারণা হওয়া মানুষ জাতির
জন্যই লজ্জাকর।
দিবসগুলোর
মধ্যে রয়েছে- ২৫ নভেম্বর নারী নির্যাতন বিলোপ দিবস। নামেই বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে নারী দুর্বলতার
প্রতীক বলে নির্যাতিত হয়, সুতরাং এ অবস্থার বিলোপ প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক নারী দিবস থাকা
সত্ত্বেও জাতিসংঘ কর্তৃক নারী নির্যাতন বিলোপ দিবসের স্বীকৃতি দেয়ার কারণ দেখানো হয়েছে-
এ দিবসে নারীর উপর সমগ্র বিশ্বে কত ভাবে, কি
কি মাত্রায় নির্যাতন হয় তার বিস্তারিত তুলে ধরা। কিন্তু আগের সেই গোত্র প্রথা, দাস
প্রথা যুগের ন্যায় নারীর উপর প্রকাশ্যে নির্যাতনের মাত্রা এখন একেবারেই কমে গেছে। ঘরে
বাইরে নারী মার খেলেও আর আগের মত হজম করে না, নিজ যোগ্যতা বলেই প্রতিহত করে। রাষ্ট্র
ও সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনের কারণেই এখন সে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ খুঁজে নিতে পারছে।
সুতরাং নারী নির্যাতন বিলোপ দিবস বর্তমান প্রেক্ষাপটে কতটা যুক্তিসঙ্গত ভেবে দেখার
অবকাশ রয়েছে।
নার্সিং
জগতের এক মহিয়সী নারী ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল স্মরণে ১২ মে আন্তর্জাতিক নার্সেস দিবস পালন
করা হচ্ছে। ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনার অন্তরালেই নারীর অবদান খুঁজে পাওয়া যাবে, তাবলে
কি ওই নারীকে কেন্দ্র করে বিশ্ব দিবসের অবতারণা করতে হবে?
২৪
সেপ্টেম্বর মিনা দিবস। আমাদের সমাজে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ, বালিকা শিশুর সচেতনতা বৃদ্ধি
এবং সার্বিক অঙ্গনে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এক কাল্পনিক চরিত্র মিনা। মিনা
আমাদের সমাজ ব্যবস্থা ও অবহেলিত নারী সমাজেরই এক সচেতন প্রতিনিধি। ১ আগস্ট বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ
দিবস। এ দিবসের কথা শুনলে এখন অনেক সচেতন মা’ই অবাক হয়ে বলেন-শিশুকে মাতৃদুগ্ধ পান
করানো মা’র সহজাত কর্তব্য। মা অন্তত এটুকুতো জানেন। প্রাকৃতিক এই নিয়মেই বড় হয়েছে মানব
শিশু। অবশ্য যে ২টি মূল বিষয় নিয়ে এ দিবসের অবতারণা তাহলো - সদ্য জন্ম হওয়া শিশুকে
শাল দুধ খাওয়ানো এবং শিশুর সর্বোচ্চ ২ বৎসর বয়স পর্যন্ত মাতৃদুগ্ধ পান করানো-এ বিষয়গুলোর
ব্যাপারে বলা হয়ে থাকে অনেক অশিক্ষিত মা এগুলো জানেন না, আবার শিক্ষিত কিন্তু অতি স্বাস্থ্য
সচেতন মা তা মানেন না। কিন' বিষয়গুলো তাদের বুঝানোর জন্য একটি পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ
সদস্যই যথেষ্ঠ, উপরন্তু পাড়া-মহল্লার ধাত্রী, সেবিকা কিংবা ডাক্তারগণতো রয়েছেনই। সুতরাং
বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ দিবসের অবতারণা করে বিশ্বব্যাপী মা তথা নারীকে অসচেতন ও দায়িত্বহীন
হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে বলে সচেতন নারীমহলের ধারণা। এরই সুযোগে অনেক সন্তানের পিতা এখন
বলার সুযোগ পাচ্ছেন - আমার বাচ্চাকে ঠিকমত বুকের দুধ খাওয়াচ্ছতো? এ ধরনের প্রশ্নও নারীর
জন্য বিব্রতকর। মার চেয়ে মাসীর দরদ তো বেশি হতে পারেনা।
১৫
অক্টোবর বিশ্ব গ্রামীণ নারী দিবস। বর্তমানে
শহুরে পোশাকী রাজনীতির মারপ্যাচে পড়ে খাবি খাচ্ছেন গ্রামীণ নারীরা। গ্রামীণ নারী উন্নয়ন
কার্যক্রম এখন ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য’ জাতীয় কর্মসূচীতে আবদ্ধ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা
গেছে গ্রামীণ সহজ সরলাদের ফাঁকি দিয়ে উন্নয়ন কর্মসূচীর নামে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের
সিংহভাগ স্বার্থবাদীদের পকেটে পুরে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে বিশ্ব গ্রামীণ নারী দিবস। এছাড়াও রয়েছে মে মাসের ২য় রোববার মা দিবস।
উল্লেখ্য
১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো নগরীর শ্রমিকদের ৮ ঘন্টা কাজের দাবিতে
অনুষ্ঠিত আন্দোলন ও আত্মাহুতি দানকারী শ্রমিকদের স্মরণে বিশ্ব শ্রমিক দিবসের অবতারনা
হয়। এখানে বলা হয়নি ওই শ্রমিকরা নারী ও পুরুষ উভয়ই ছিল কিনা। অথচ ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের
৮ মার্চ আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে ১টি সূচ কারখানায় মহিলা শ্রমিকদের কারখানার মানবেতর
পরিবেশ, অসম মজুরী ও ১২ ঘন্টা কর্ম দিবসের বিরুদ্ধে করা প্রতিবাদ ও তাদের শান্তিপূর্ণ
মিছিলে পুলিশের গুলি ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগঠিত মহিলা শ্রমিকদের আন্দোলনকে পুঁজি
করে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের অবতারণা করা হলো। শ্রমিক নারী কিংবা পুরুষ যেই হোক সে
শ্রমিক এবং মানুষ। সুতরাং আমেরিকার নারী শ্রমিকদের আন্দোলনও বিশ্ব শ্রমিক দিবসের সাথে
একাত্ম হতে পারতো। কিন' আন্তর্জাতিক (নারী দিবস) শব্দটি যুক্ত হয়ে মানব জাতি (অর্ধাংশ)
থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন বৈকি!
এতো
সব বিশ্ব নারী দিবসের গোলকধাঁধায় পড়ে সচেতন নারী মহল এখন প্রশ্ন তুলেছেন-বিশ্ব পুরুষ
দিবস হলো না কেন? স্মিত হেসে পুরুষরাই জবাব দিচ্ছেন-এটি পুরুষদের পৌরষত্বের বিরোধী,
তাছাড়া নারী কর্তৃক পুরুষরা ব্যাপকভাবে কখনই নির্যাতিত হননি কিংবা হলেও সে খবর প্রকাশ্যে
আসেনি বলে পুরুষরা বিশ্ব পুরুষ দিবস কখনই দাবি করেননি। তবে ফরাসী বিপ্লব থেকে শুরু
করে শিকাগো শহরে শ্রমিক নির্যাতন, নাৎসী বাহিনী কর্তৃক নির্যাতন সহ অসংখ্য যুদ্ধ বিগ্রহে
পুরুষরাও ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং এখনও হয়ে আসছেন তবুও কবি নিরব, কারণ স্বজাতির
মার খেলে হজম হয়ে যায়! আবার নারীর হাতে মার খেয়ে চুপ হয়ে থাকলে নাকি পুরুষের হাতে চুড়ি
পরা হয়, নির্যাতন হয় না। উল্টো দু’ঘা বসিয়ে দিতে পারছেন তারা। নারী যা পারেনা কিংবা
পারলেও করে না। একারণেই কি তাদের পুরুষ দিবস করার প্রয়োজন হচ্ছে না!
আজ
সময় বদলেছে, বিশ্বায়নের যুগে নারী পুরুষ বৈষম্য এমনভাবে কমে এসেছে যে খোদ পুরুষরা এখন
দাবি করছেন - শুধুমাত্র পুরুষরাই একতরফা নারী নির্যাতনকারী এটি তাদের বিরুদ্ধে একটি
অপবাদ বরং একটি পরিবারে মা-খালা, শাশুড়ি, ভাবী, ননদ কিংবা বান্ধবী, সহপাঠী নাম্নী নারী
কর্তৃক নারীরা যতটা নির্যাতিত হয়, পিতা, ভ্রাতা কিংবা বন্ধু কর্তৃক তার অর্ধেকও নয়।
আসলে
নারীদের শত্রু নারীরাই, পুরুষ না। এদেশে এমন কোন পরিবার কি আছে যেখানে মা-মেয়ে, শাশুড়ি-ছেলের
বৌ, ভাবী-ননদ, প্রভৃতি সম্পর্কের ক্ষেত্রে ১ শতাংশও পাওয়া যাবে উভয়ে উভয়ের জীবনের জন্য
আশীর্বাদ হয়ে এসেছেন? কিংবা একজন অন্যজনের প্রকৃত বন্ধু হয়ে উঠেছেন? বরং একজন আরেকজনের
পেছনে ঈর্ষা, হিংসা বশত লেগেই আছেন যুগ যুগ ধরে। একারণেই আজ ন্যানো টেকনোলজির যুগে
দাঁড়িয়েও এদেশে নারী জাগরণ ঘটছে না। সামগ্রিক
আঙ্গিকে নিজেদের মধ্যে ক্লেশ বেড়েই চলেছে! ফলশ্রুতিতে নারীরাই এখন নারীদের বোঝা। এরই
সুযোগে মাথা থেকে বোঝা নামাতে ব্যসৱ নারী বিরোধীরাও। সমস্যা সমাধানে তারা যতটা না তটস্থ উসকে দিতে ততোধিক পটু। খোদ জাতিসংঘই নারী বিষয়ের
উপর ৭টিরও অধিক বিশ্ব দিবসের অবতারণা করে নারী অবমাননার বিশ্ব রেকর্ড করেছেন, ফলে মানুষ
জাতির অর্ধেককে এক শ্রেনীতে আবদ্ধ রেখে উন্নয়নের নামে আনুষ্ঠানিক সময় পার করার সুযোগ
পেয়েছেন নারী, পুরুষ ও নারীবাদী সংগঠনগুলো। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না-বিতর্ক ছাড়া।
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন ব্যবস্থা নারী অবমাননার এমন একটি উৎকৃষ্ট
উদাহরণ।
সুতরাং
সময় এসেছে নারীকেই আজ সাবধান হতে হবে। নারী উন্নয়নের নামে পুরুষের চোখে দেখা প্রহসনমূলক
ব্যবস্থায় পর্যুদস্ত না হয়ে নিজেদের সমস্যা নিরসনে নিজেদেরকেই যোগ্য ও অভিজ্ঞ হয়ে উঠতে হবে। অধিকার কেউ দিতে পারে না, এটি অর্জনের
বিষয়। দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকেই আসে অধিকার। আবহমানকাল থেকেই পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করণে
নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন পরীক্ষিত। সুতরাং মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া নারীর
ন্যায়সঙ্গত অধিকার। প্রতিটি পরিবার থেকে নারী জাগরণ শুরু হয়ে সমাজের সর্বত্র তাদের
অবস্থান সুদৃঢ় হওয়া পর্যন্ত নারী দিবস পালন তাদের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে কিন্তু নারী
পুরুষ উভয়ে মান ও হুঁশ সম্পন্ন মানুষ হলেই কেবল বিশ্ব হয়ে উঠতে পারে শান্তিময়। নারীকে
মানব জাতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হতে বিচ্ছিন্ন করে
নয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন