মঙ্গলবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

স্বাক্ষরতার সঠিক চিত্র নেই



স্বাক্ষরতার সঠিক চিত্র নেই

শামসুর রহমান ॥ নিজের নাম লিখতে পারলেই কি স্বাক্ষর মানুষ হিসেবে পরিসংখ্যানে জায়গা করে নেবে! এমন প্রশ্ন করতেই পারে সাধারণ মানুষ। স্বাক্ষরতা একটি গতিশীল বিষয় যা প্রতিনিয়ত চর্চা আর প্রশিক্ষণ দেয়ার মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়। সম্প্রতি এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী গণমাধ্যমের কাছে তুলে ধরেন বর্তমান পরিস্থিতি। তবে তার বিস্তারিত বিবরণ না দিয়ে আপেক্ষিক অবস্থা তুলে ধরে বলেছেন, দেশে স্বাক্ষরতার হার ৭১ শতাংশে পৌঁছেছে। সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে। গণস্বাক্ষরতায় এগিয়ে যাওয়ার মূল কারণ হলো ধারাবাহিক পরিচর্যা চলেছে।
সর্বশেষ আদমশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী, ২০১১ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৫ কোটি ২৫ লাখ ১৮ হাজার ১৫ জন। স্বাক্ষরতার হার ৬৫ শতাংশ ধরলে নিরক্ষর মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫  কোটি ৩৩ লাখ ৪১ হাজার; যা মন্ত্রীর দাবির থেকে প্রায় তিন কোটি বেশি। তবে গত বছর প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) স্বাক্ষরতা মূল্যায়ন জরিপ অনুযায়ী দেশে বর্তমানে স্বাক্ষরতার হার ৫৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এর মধ্যে নারী স্বাক্ষরতার হার ৫০ দশমিক ২ শতাংশ ও পুরুষ ৫৬ দশমিক ৯ শতাংশ। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের (আইইআর) তথ্য মতে, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর স্বাক্ষরতার আনুমানিক গড় হার ৭০.৩০ শতাংশ। সেদিক  থেকে  বেশ পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সার্বিক স্বাক্ষরতা সঠিক তথ্য নিয়ে যে লুকোচুরি চলছে, সেখানে আসল পরিসংখ্যান মাত্রায় আনার জন্য কোনো একক ব্যাবহৃত হচ্ছে না। অর্থাৎ আদম সুমারী অনুযায়ী স্বাক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন লোকের হিসেবে মোট কত শতাংশ লোক গণনায় আনা হয়েছে তার হিসেবে গরমিল থাকছেই। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর  দেয়া তথ্যনুযায়ী,  দেশে স্বাক্ষরতার হার ৫৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। আবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যে সাক্ষরতার হার ৭১ শতাংশ দেখানো হয়েছে। দেশে সঠিক সাক্ষরতার হার নিয়ে রয়েছে বিভ্রান্তি। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দেয়া তথ্যেও রয়েছে বড় ধরনের ফারাক। এই গরমিলের কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ দেখায়নি কেউ। তবে, বর্তমান সময়ের উন্নয়ন প্রসারতার জন্য শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বিনিয়োগ ও শিল্পোন্নয়নের সহায়ক হতে অথবা যে কোনো বিষয়ে এগিয়ে নিতে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর খুবই জরুরি।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধুরীর মতে, ইতোপূর্বে শুধু নাম লিখতে পারাকেই  'স্বাক্ষর' হিসেবে গণ্য করা হতো। তবে এখন সেটি পরিবর্তন হয়েছে। এখন স্বাক্ষরতায় পড়তে এবং লিখতে পারতেও হবে। ৪ ধরনের নির্ণয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই স্বাক্ষর হিসেবে সার্টিফাইড করা যাবে। ইউনেস্কোর মতে, স্বাক্ষরতা বলতে - পড়তে, লিখতে এবং বলতে পারাকে বোঝায়। শুধু শিক্ষিতকেই স্বাক্ষরতা জ্ঞান সম্পন্ন বোঝায় এ হিসেবে পরিসংখ্যানের গননায় আনছে ইউনেসকো। আর উন্নত বিশ্বে এ ধারাকে মেনেই গণনা করা হয়ে থাকে। ইউনেসকোর মাপকাঠি অনুযায়ী এ স্বাক্ষরতার হার নির্ণয় করা হয়। জরিপে ১১ থেকে ৪৫ বছর বয়সের জনসংখ্যার স্বাক্ষরতা পরিমাপ করা হয়। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, এ বয়সের মধ্যে শিক্ষাগ্রহন করলে তাকে সময়োপযোগী করে কাজে লাগানো যায়। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকের মতে, অব্যাহত শিক্ষার ক্ষেত্রে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদফতর এখন স্বাক্ষরতার পাশাপাশি অর্জিত স্বাক্ষরতার স্থায়ীত্ব নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছে। মৌলিক স্বাক্ষরতা কর্মসূচির শেষে বিভিন্ন মেয়াদের কর্মসূচির মাধ্যমে যাতে নব্য স্বাক্ষরগণ অর্জিত স্বাক্ষরতার চর্চা ধরে রাখা সহ স্বীয় প্রয়োজনে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারের সুযোগ করে দিতে উপানুষ্ঠানিক অধিদফতরের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আশার কথা হলো এত গড়মিলের পরেও সাধারণ নিরক্ষর মানুষের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রচেষ্টা অব্যহত আছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারি একনেকে মৌলিক স্বাক্ষরতা নামে একটা প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের ৪৫ লাখ নিরক্ষর মানুষ সাক্ষরতা পাবে। ২০১৮ সালের জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষ হবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর অধীনে ৬৪ জেলায় প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। ৪৫২ কোটি ৬২ হাজার টাকা ব্যয় মৌলিক স্বাক্ষরতা দেয়া হবে। এর আগে ১৯৯৬-২০০১ সময়ে সরকার টোটাল লিটারেসি মুভমেন্ট নামে প্রকল্প করে দেশে নিরক্ষরতা দূরীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যয় করা সমুদয় অর্থই গচ্চায় যায়। তবে এ স্বাক্ষরতা অভিযানের সফলতা দাবি করে অনেক জেলা নিরক্ষরতামুক্ত বলে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছিল! সর্বশেষ আদমশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী, ২০১১ সালে  দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৫  কোটি ২৫ লাখ ১৮ হাজার ১৫ জন। স্বাক্ষরতার হার ৬৫ শতাংশ ধরলে নিরক্ষর মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচ  কোটি ৩৩ লাখ ৪১ হাজার; যা মন্ত্রীর দাবির থেকে প্রায় তিন কোটি বেশি। সাম্প্রতিক প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেশে ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে জনগোষ্ঠীর স্বাক্ষরতার হার ৪৮ দশমিক ৮০ শতাংশ এবং ৭ বছরের ঊর্ধ্বে জনগোষ্ঠীর স্বাক্ষরতার হার ৫৩ শতাংশ উল্লেখ করা হয়। এই পরিসংখ্যানগুলোর কোনটিকে একক বলে গ্রহণ করা যায় অথবা যে পরিসংখ্যান দিয়ে সহজভাবে বলা যায় দেশের স্বাক্ষরতার হার নির্দিষ্ট সীমায় আছে। এই পরিসংখ্যানের ভীড়ে জনগণ সঠিক তথ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। স্বাক্ষরতার হার যাই হোক আনুষ্ঠানিকতা করতে ইউনিস্কোর আহবানে জাতিসংঘের সদস্য দেশ হিসেবে প্রতি বছর ৮ সেপ্টেম্বর দিনটি স্বাক্ষরতা দিবস পালন করে আসছে বাংলাদেশ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন