মঙ্গলবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

জনগণের সেবাই প্রজাতন্ত্রে নিযুক্ত প্রত্যেকের কর্তব্য



জনগণের সেবাই প্রজাতন্ত্রে
নিযুক্ত প্রত্যেকের কর্তব্য

শেখ উল্লাস ॥ সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১ নং অনুচ্ছেদের ৭নং ধারার প্রথমেই বলা হয়েছে, “প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইব”। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সংক্রান্ত ২১ নং ধারায় নাগরিক ও সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, “সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য। এ প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ্য যে, দ্বাদশ সংশোধন আইন, ১৯৯১ (১৯৯১ সনের ২৮ নং আইন)-এর ধারাবলে রাষ্ট্রপরিচালনার ১১ নং ধারায় এ কথাটিও সন্নিবেশিত হয়েছে যে, “প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে’’। বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও পদের মানক্রম অনুযায়ী বিভিন্ন স্তরের মর্যাদা পেয়ে থাকেন। এই হিসেবে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান যারা রাষ্ট্রীয় ও সরকারি বেতন, ভাতা ও সম্মানী পেয়ে থাকেন তাঁরাও নিশ্চয়ই প্রজাতন্ত্রে নিযুক্ত এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন অর্থাৎ সংবিধান অনুযায়ী সকল সময়ে জনগণের সেবার চেষ্টা করাই তাদের কর্তব্য। উল্লেখ্য যে, 'কর্তব্য' শব্দটি একটি বিশেষণ এবং বাংলা একাডেমীর সহজ বাংলা অভিধান অনুযায়ী যা করা উচিত বা করণীয় তাই কর্তব্য।
এদিকে, সংবিধানে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতির ২০(১) ধারায় অধিকার ও কর্তব্য-রূপে কর্ম সম্পর্কে বলা হয়েছে, কর্ম হচ্ছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের পক্ষে অধিকার, কর্তব্য ও সম্মানের বিষয়, এবং ''প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্যতানুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী’’-এই নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করবেন। বাংলাদেশের প্রজাতন্ত্রে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তিই এখন যোগ্যতা অনুসারে পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন। নিম্নস্তরের পদে কর্মরতদের বেতন-ভাতা, সম্মানী নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ থাকলেও উঁচু পদে কর্মরতদের বেতন-ভাতা বা সম্মানী নিয়ে কোনো অসন্তোষ নেই বললেই চলে। উদাহরণ হিসেবে দেখানো যায়, সরকারি-বিরোধী দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকলেও এমপিদের বেতন-ভাতাসহ অন্য যেকোনো সুবিধাদি সব সময় বাড়ানোর ব্যাপারে জাতীয় সংসদে কোনো আপত্তি উঠতে কখনো দেখা যায় না। তেমনিভাবে উচ্চপদস্ত সরকারি কর্মচারিদের বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বাড়ে, পদোন্নতি কার্যক্রমে সাম্প্রতিককালে তো এদেশের বিভিন্ন ক্যাডার সার্ভিস বিশেষ করে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছেন। বিভিন্ন কাজ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা যতই থাকুক না কেন, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো জটিলতা হতে দেখা যায় না, বরং, এই ক্ষেত্রে পদোন্নতি দিতে দিতে অবস্থা এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, প্রশাসনের উচ্চ পদের কর্মকর্তাদের সংখ্যাটি নির্ধারিত পদের চাইতে অনেক গুণ বেড়ে গেছে। প্রারম্ভিক পদের কর্মকর্তাদের যেমন-সহকারী সচিব পদের সংখ্যাটি প্রয়োজনের তুলনায় কমে গেছে, কিন্তু অনেক বেড়ে গেছে সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্নসচিবদের সংখ্যাটি।  অনেক ক্ষেত্রে মাথাভাড়ি প্রশাসন বলতে যা বোঝায়, আমাদের দেশে এখন সেই অবস্থাটি সৃষ্টি হয়ে অত্যন্ত বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে বলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিবরাই বিষয়টি নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করে যাচ্ছেন।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, যে বা যারা এই প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন স্তরে কর্মে নিয়োজিত এবং প্রজাতন্ত্র থেকে নিয়মিত পারিশ্রমিক, সম্মানী, পদোন্নতিসহ সকল সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন তারা রাষ্ট্র এবং জনগণের সেবায় কতটুকু আত্মনিয়োগের চেষ্টা করছেন সেটা জানাই আজকের দিনের সবচেয়ে বেশি জরুরি। কারণ, বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র সৃষ্টি না হলে এদেশের মানুষ কখনো সরকারের শীর্ষস্থানীয় পদে কর্মরত হতে পারতো না। একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ তথা জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত এই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন পদে যারা কর্মরত ও দায়িত্বরত, বিশেষ করে যারা এই কর্ম ও দায়িত্ব পালনের জন্য পারিশ্রমিক পাচ্ছেন তাদেরকে সবার আগে অবশ্যই দেশের কথাটি স্মরণ রাখতে বাধ্য করা উচিত বলে মনে করছেন বিবেকবান মানুষেরা। দেশের আপামোর জনগণের কথা মাথায় রেখেই সংবিধানে এই ধারাটি সন্নিবেশিত হয়েছে যে, 'সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য'। দেশের বিভিন্ন সরকারি অফিস-আদালত সম্পর্কে সামান্য অভিজ্ঞতাও যাদের আছে তারাও জানেন, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও বিভিন্ন ধরনের জটিলতা কীভাবে সেগুলোকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে এবং সরকারি অফিসে দুর্নীতি থাকলে তার কুপ্রভাব বেসরকারি অন্য ক্ষেত্রগুলোতেও পড়তে বাধ্য এবং এ সব কারণেই সর্বস্তরের সুশাসন প্রতিষ্ঠা আজ এতটা কঠিন হয়ে উঠছে বলে মনে হচ্ছে। দুর্নীতিতে দেশ পৃথিবীর মধ্যে রেকর্ড সৃষ্টি করছে যা সরকার ও দেশের জনগণের জন্য দুর্ভাগ্যজনক ও দুঃখজনক ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মপন্থা অবশ্যই বের করতে হবে।  চাকুরিকে শুধুমাত্র চাকুরি হিসেবে না দেখে একে দেশসেবার সুযোগ হিসেবে চিন্তা করে এগিয়ে গেলে প্রজাতন্ত্রে নিযুক্ত যেকোনো মানুষ তার নিজের জীবনকে স্বার্থক করে তুলতে পারেন। কারণ, রাষ্ট্র তার রুটি-রুজির ব্যবস্থা করে রেখেছে। বিশেষ করে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের এক্ষেত্রে সুযোগ অনেক বেশি। এক্ষেত্রে সমস্যা অবশ্যই আছে। তবে আন্তরিক হলে সব সমস্যা মোকাবেলা করেই এক একজন সরকারি কর্মকর্তা তাদের জীবনকে ধন্য করতে পারেন। বাংলাদেশের প্রবাদে আছে, 'মানুষ বাঁচে তাহার কর্মের মধ্যে, বয়সের মধ্যে নহে'। কে কত বছর সরকারি উচ্চপদে কর্মরত ছিলেন সেটা বড় কথা নয়, কে উচ্চ পদে অবস্থান করে দেশসেবা করেছেন সময়ের হিসেবে সেটাই বিবেচ্য হবে। এদেশের বিভিন্ন স্থানে এখনো অনেক বড় বড় আমলা বা সরকারি কর্মকর্তার নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়, যারা শুধু চাকুরিই করেননি, চাকুরির মাধ্যমে দেশসেবা করেছিলেন। স্বাধীন দেশে সরকারি চাকুরি করে এই দেশসেবার সুযোগ এখন অনেক বেশি। শুধু থাকতে হবে ইচ্ছা। দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মরত লাখো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মধ্যে এই ইচ্ছা শক্তি জাগ্রত হবে, দেশের সর্বস্তরে সুশাসন, সঠিক ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত হবে, দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদেরকে কাজের পরিবেশ করে দেয়া হবে- এইসব প্রত্যাশাই করে দেশের বিবেকবান মানুষ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন