মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

সময়ের সাফ কথা .... আদর্শের অনুসরণ সমৃদ্ধ জীবন ও সমাজ নির্মাণের উপায়

সময়ের সাফ কথা ....
আদর্শের অনুসরণ সমৃদ্ধ জীবন ও সমাজ নির্মাণের উপায়

সিদ্ধার্থ ॥ ক্ষুধা লাগলে আমরা খাবার খুঁজি কিন্তু ক্ষুধা মিটে গেলে সামনে লোভনীয় খাবার থাকলেও মুখ ফিরিয়ে নিই। আমাদের শরীর অভ্যন্তরীণ পরিবেশ স্থিতিশীল রাখতে সচেষ্ট থাকে। দেহের স্থিতিশীলতা হেরফের হলেই স্থিতিশীল অবস্থা ফিরিয়ে আনতে তাড়না বোধ হয় আবার দেহের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ স্থিতিশীল হয়ে গেলে তাড়নাটি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। কিন্তু আরামের জীবন ত্যাগ করে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে কিছু মানুষ পাহাড়ের চূড়ায় আরোহন করতে প্রচেষ্টা করে কেন? কেন মানুষ আন্দোলন, সংগ্রামে জীবন বিসর্জন দেয়? সর্বত্যাগী হয়ে কেন মানুষ শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত নিয়ে পড়ে থাকে? এসব কর্মের পিছনে প্রেষণা আসে কোন্‌ তাড়নায়? এটি স্পষ্ট যে, এসব ক্ষেত্রে দেহের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য প্রেষণা আসে না। এসব প্রেষণা আসে চিন্তা থেকে। চিন্তা প্রয়োজন সৃষ্টি করে এবং মানুষ নিজের চিন্তা সৃষ্ট প্রয়োজন মেটাতে কঠিন প্রচেষ্টা করে, জীবনও দেয়।
মানুষের সকল প্রয়োজনকে সাতটি ধাপে সাজানো যায়। নীচের ধাপের প্রয়োজনগুলো পূর্ণ হলে মানুষ ক্রমে উচ্চতর ধাপের প্রয়োজন বোধ করে এবং তা পূরণে সচেষ্ট হয়। প্রয়োজন-পিরামিডের ভূমি থেকে শীর্ষ পর্যন্ত ধাপগুলো হলো ১. শারীরবৃত্তীয় প্রয়োজন ২. নিরাপত্তার প্রয়োজন ৩. মর্যাদা লাভের প্রয়োজন ৪. নান্দনিক প্রয়োজন ৫. আত্মবিকাশের প্রয়োজন ৬. জ্ঞানগত প্রয়োজন এবং ৭. একাত্ম হওয়ার প্রয়োজন ।
শারীরবৃত্তীয় প্রয়োজনগুলো জৈবিক। যেমন - ক্ষুধা, তৃষ্ণা, শীত ও উত্তাপ থেকে রক্ষা, যৌনাকাঙ্খা, বংশবৃদ্ধি ইত্যাদি। নিরাপত্তার প্রয়োজনকেও জৈব প্রয়োজনের সারিতে রাখা যেতে পারে। পিরামিডের তৃতীয় ও চতুর্থ স্তর অর্থাৎ মর্যাদা লাভের প্রয়োজন এবং নান্দনিক প্রয়োজনকে বলা যেতে পারে সামাজিক প্রয়োজন। মানুষ কেবল ব্যক্তি হিসেবে থাকতে চায় না, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই সুপ্ত থাকে ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠার বাসনা। কোন ব্যক্তিকে ব্যক্তিত্বে রূপায়িত হতে হলে তাকে এমন গুণাবলী অর্জন করতে হয় যা সে সামাজিক প্রয়োজনে কাজে লাগতে পারে। এ জন্যই দরকার তার নান্দনিক সমৃদ্ধি। মর্যাদা লাভের প্রয়োজনটি মেটানোর জন্য নান্দনিক প্রয়োজন মধ্যবর্তী উপায় হিসেবে কাজ করে। কয়েকজন নবীন চিত্রশিল্পীকে বলা হয় শিল্পকর্মের জন্য তাদেরকে যথেষ্ট পারিশ্রমিক দেয়া হবে শর্ত শুধু একটিই - তারা তাদের আঁকা ছবি কাউকে দেখাতে পারবে না, আঁকার পর ছবিগুলো নষ্ট করা হবে। কোন শিল্পীই এ শর্তে ছবি আঁকতে রাজী হন নি। এতে প্রমাণিত হয় যে, মানুষ কেবল শিল্পকে ভালোবাসে বলে শিল্প চর্চা করে না। মানুষ শিল্পচর্চার মাধ্যমে অন্যকে আনন্দ দিতে চায় এবং মর্যাদা পেতে চায়।
মর্যাদা লাভের প্রেষণা ব্যক্তির শিক্ষা ও চিন্তার স্তর অনুযায়ী নানা দিকে যেতে পারে। শ্রেণী বিভক্ত সমাজে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা ধন-সম্পদ আহরণের দিকে ধাবিত হয়। কারণ এরূপ সমাজের অধিকাংশ মানুষ জৈব প্রয়োজন মেটাতে অক্ষম থাকে এবং নিজের জৈব প্রয়োজন মেটাতে ধনীদের মর্যাদা দিয়ে থাকে। তাই পশ্চাদপদ সমাজে মর্যাদা লাভের উপায় হিসেবে অধিকাংশ মানুষ ধন-সম্পদকে বেছে নেয়। মর্যাদা লাভের প্রয়োজন যেমন রূপ নিতে পারে ব্যক্তিগত ক্ষমতা অর্জনের প্রেষণায়, তেমনি তা পরিবর্তিত হতে পারে সমাজ সেবায়। মর্যাদা লাভের প্রয়োজনটি যেন ব্যক্তি স্বার্থ থেকে সমাজের স্বার্থে রূপান্তরিত হয় এজন্য ব্যক্তিকে সাংস্কৃতিকভাবে বিকশিত করে তোলার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
সমস্যা হলো প্রয়োজন-পিরামিডের পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম ধাপ নিয়ে। এগুলো যথাক্রমে আত্মবিকাশের প্রয়োজন, জ্ঞানগত প্রয়োজন এবং একাত্ম হওয়ার প্রয়োজন।
এসব প্রয়োজনের মূলে রয়েছে চিন্তা ও অসহায়ত্বের উপলব্ধি। মানুষ বড়ই অসহায়। প্রকৃতিকে জয় করেও প্রকৃতির উপর নির্ভরতা মানুষের থেকেই যাচ্ছে। মানুষ যত আদর্শ সমাজই নির্মাণ হোক না কেন সমাজের কাছে ব্যক্তির অসহায়ত্ব থেকেই যাচ্ছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অসাধারণ উন্নতি ঘটলেও এখনো পর্যন্ত মৃত্যুই জীবনের জন্য অপরিহার্য গন্তব্য। মানুষ উপলব্ধি করতে সক্ষম যে, অসহায়ত্বের কারণ দূরীকরণ অসহায়ত্ব নিবারণের উপায় নয়। অসহায়ত্ব নিবারণের উপায় হলো চেতনার উন্নয়ন। চেতনার একটি উচ্চতম স্তরে উপনীত হতে পেরেছিলেন বলেই সক্রেটিসের পক্ষে আত্মসমর্পণ না-করে হেমলকের পেয়ালায় শান্তভাবে চুমুক দেয়া সম্ভব হয়েছিল।
ব্যক্তিত্ব তিনটি পরস্পর সংশ্লিষ্ট কাঠামোর সমন্বিতরূপ। এর কেন্দ্রে রয়েছে আন্তঃব্যক্তি উপকাঠামো বা শারীরী ব্যক্তি, যাকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বলেও চিহ্নিত করা যায়। এ কাঠামোর বাইরে রয়েছে আন্তঃব্যক্তি উপকাঠামো যা ব্যক্তির সামাজিক কাজকর্মে প্রকাশিত হয় এবং ব্যক্তির প্রত্যক্ষ সম্পর্কে আসা অন্য ব্যক্তিদের চিন্তায় তার একটি রূপকল্প হিসাবে কার্যকর থাকে। এর বাইরে রয়েছে অধিব্যক্তি উপকাঠামো, ব্যক্তির কাজের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে সম্পর্কে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে তার যে রূপকল্প গড়ে ওঠে, তাই অধিব্যক্তিত্ব। কোন ব্যক্তির মৃত্যু মানে তার আন্তঃব্যক্তি উপকাঠামোর মৃত্যু। কিন্তু তার আন্তঃ ও অধিব্যক্তি উপকাঠামো দু’টি জীবিত ব্যক্তিদের মাঝে বেঁচে থাকে। মৃত ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুর সঙ্গে আন্তঃব্যক্তি উপকাঠামোর মৃত্যু ঘটলেও তার অধিব্যক্তি উপকাঠামো মানুষের মাঝে জন্ম-জন্মান্তর বেঁচে থাকতে পারে, দেশে দেশে তা বিস্তৃত হতে পারে। মানব জাতির পথপ্রদর্শকগণ এভাবেই আমাদের মধ্যে বেঁচে আছেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তি তার কর্মের মাধ্যমে মানুষের মাঝে মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকতে পারে।

মানুষের আত্মবোধ বা আমিত্ববোধের অন্তর্গত রয়েছে নিজের অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যত তথা সময়ের ঐক্য এবং সেই ব্যক্তিত্বের রূপকল্প, যাকে আদর্শ করে আমিত্ব বিকশিত হয়। যে স্নায়ুজালিকা আদর্শ রূপকল্পকে ধারণ করে, তাঁর কাজের ঐক্যেই আমিত্বের প্রকাশ হয়। এভাবে আমিত্বের সঙ্গে এর আপন রূপকল্প বেঁচে থাকে এবং বিকশিত হয়। আদর্শের অনুসরণ প্রেষণার উদ্বরনে যেমন শক্তি দেয় তেমনি জীবিত থাকার আকাঙ্খা পূরণের সম্ভাবনাটিও উন্মোচিত করে। এ তত্ত্ব বাস্তবমুখী এবং সমৃদ্ধ জীবন ও সমাজ নির্মাণের উপায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন