সুলতানুল আউলিয়া শাহ্ কলন্দর
সূফী খাজা আনোয়ারুল হক
সে ১৯৩৬ খ্রীষ্টাব্দ, বাংলা ১৩৪৩ ১৭ অগ্রহায়ণ। বুধবার, সময় সকাল এগারটা সূফী সাধক আনোয়ারুল হক এঁর আবির্ভাব -
কলকাতার হ্যারিসন রোডে। তাঁর পিতা মজর উদ্দিন ভূঁইয়া ছিলেন কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত
একজন বড় ব্যবসায়ী। ১৯৪৭-এ দেশ বিভক্তির পর ১৯৪৮-এ মজর উদ্দিন শিশু পুত্র আনার
মিয়াসহ স্বপরিবারে ফিরে আসেন পূর্ববাংলায়, তাঁর স্থায়ী নিবাস কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি থানার নিভৃত পল্লী চাঁন্দপুরে।
ছোটবেলা থেকেই তিনি অন্য রকম ছিলেন। ১২/১৩
বৎসর বয়স থেকেই তিনি সাদা পোশাক পরতেন। কথাবার্তা, আচরণে ছিলেন নম্রভদ্র, শালীনতা ছিল
প্রখর। তিনি যে আধ্যাত্মিক সাধক হয়ে উঠবেন তা তাঁর আচরণে সে সময়ই প্রকাশ পেয়েছিল।
বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া, অতিরিক্ত কথা
বলা,
ফালতু সময় ব্যয় করা তাঁর স্বভাবে ছিল না। কারো সাথে তাঁর
ঝগড়াঝাটি হতো না কখনো।
আনার মিয়ার প্রাথমিক শিক্ষার শুরু কলকাতায়
হলেও তা শেষ করতে হয় গ্রামে এসে। এ যেন মাটির মানুষের মাটিতে ফেরা। গ্রামেই কাটে
তাঁর শৈশব-কৈশোর। চাঁন্দপুর গ্রামের উকিল বাড়ীর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক
শিক্ষা শেষ করে স্থানীয় বনগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখানে তিনি লেখাপড়া করেন
দশম শ্রেণী পর্যন্ত। অসাধারণ কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর। ছোট বেলা থেকেই
তিনি ছিলেন অন্যরকম মানুষ। বিত্তবান বাবার পুত্র হিসেবে তাঁর চলাফেরা ছিল অত্যন্ত
সৌখিন,
প্রচুর খরচ করতেন, সঙ্গী সাথীদের নিয়ে এক সাথে খাওয়া দাওয়া করতেন। পয়সার প্রতি কোন মায়া ছিল না।
কারোর কোন কষ্ট বা সমস্যা দেখলে তিনি নির্দ্বিধায় তার জন্য ব্যয় করতেন। বলতেন ‘আমি না দিলে দিব কেডারে’? স্কুলের বা সঙ্গের কারোর গায়ে ছেঁড়া জামা দেখলে তিনি নিজের গায়ের জামা দিয়ে
দিতেন তাকে।
অভাবী, দরিদ্র ও অবহেলিত লোকজনই ছিল তাঁর চলার পথের সাথী। দুঃখ-কষ্টে আছে এমন সব
মানুষদের সাথেই তিনি চলাফেরা, মেলামেশা করতেন।
তাঁর মধ্যে কেউ কখনো হিংসা, ঘৃণা, অহংকার দেখেনি। কোন জাত-পাত তিনি মানতেন না। তিনি খোঁজ খবর
নিতেন কার বাড়িতে কি রান্না হয়েছে। কিশোরগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষায় বলতেন - ‘ও মায়া কি রানছুইন’? হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবার ঘরে খাবার দিলে তিনি খেয়েছেন। তাঁর আচরণে কখনোই
প্রকাশিত হতো না যে তিনি ধনী পরিবারের ছেলে। অন্যদিকে তিনি খুব চঞ্চল প্রকৃতিরও ছিলেন।
সব সময়ই খোশ-মেজাজে থাকতেন। সকলের সাথে কথাও বলতেন অত্যন্ত নম্র-ভদ্রভাবে। কারো
সাথেই কখনো রাগ করতেন না কিংবা বিরক্তি প্রকাশ করতেন না।
বনগ্রাম স্কুলে পড়াশুনা করার সময় তিনি থাকতেন
কাছের সম্পর্কে তাঁর এক মামার বাড়িতে। এগারো/বারো বছর বয়সে তাঁর বাবা তাকে লেখাপড়ার
জন্য মামার বাড়ীতে পাঠিয়ে দেন। বনগ্রাম হাইস্কুলে ভর্তি করা হয় তাঁকে। ষষ্ঠ শ্রেণী
থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত মামার বাড়িতে থেকেই লেখাপড়া করেছেন তিনি। বাড়িতে লজিং মাস্টার ছিল।
মাস্টারের কাছে পড়তেন। মধ্যরাত পর্যন্ত লেখাপড়া করতেন। পাঠ্য বই ছাড়াও স্কুল থেকে
এনে নানা রকম বই পড়তেন। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন। বিকালে বনগ্রাম স্কুল মাঠে ফুটবল
খেলতে যেতেন। খেলায় জিততে হবে, হারলে চলবে না
এমন মনোভাব ছিল তাঁর। খুবই সৌখিন ছিলেন আনার মিয়া। কম কম খেতেন। স্কুলে যাওয়ার আগে
পুকুরে গোসল করতেন। বাড়িতে নিজের ঘরের পাশে ফুলের বাগান করেছিলেন। বিভিন্ন রকমের
ফুল দিয়ে মালা তৈরি করে ঘরে টাঙ্গিয়ে রাখতেন। একদিন স্কুল থেকে এসে তিনি তাঁর
মামাকে বললেন, ‘আমি আর স্কুলে যাব না। শিক্ষক
আমাকে মেরেছে’। এ ঘটনার পর তিনি ফিরে আসেন নিজের বাড়ি চাঁন্দপুরে। শত চেষ্টা করেও কেউ আর
তাঁকে স্কুলে পাঠাতে পারেনি।
‘ওকে আমি মাজারে মাজারে ঘুরে পেয়েছিলাম’ - পুত্র আনার মিয়ার জন্ম-নেপথ্য তথ্য পাওয়া যায় তাঁর মা
ছায়েদা আক্তারের মুখে এভাবে। বিয়ের অনেকদিন পার হওয়ার পরও কোলে সন্তান আসেনি
ছায়েদা আক্তারের। সন্তান তৃষ্ণায় ব্যাকুল ছায়েদা চোখের জলে ভাসেন। শেষ নেই যেন
আল্লাহকে ডাকাডাকির। স্বামীর ব্যবসাস্থল কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে শায়িত ওলি আউলিয়ার
কোন মাজারের খোঁজ পেলেই তিনি ছুটে যেতেন সেখানে। গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসলেও ছুটে
যেতেন স্থানীয় বিভিন্ন মাজারে। কান্দুলিয়ার মৌলভীর কথা তখন মানুষের মুখে মুখে।
বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা, ঢাকা, কুমিল্লা, সিলেট, নোয়াখালী সর্বত্রই তাঁর ভক্ত আশেকান। কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর
থানাধীন ফরিদপুর গ্রাম ছিলো নিরাশ্রয় ও বিপন্ন মানুষের আশ্রয়স্থল। কান্দুলিয়ার
মৌলভীর কাছ থেকে কেউ খালি হাতে ফেরে না; এ যে মানুষের জানা কথা। একদিন ছায়েদা আক্তারও গিয়ে লুটিয়ে পড়েন তাঁর পায়ের
কাছে। কান্দুলিয়ার মৌলভী তাকেও বিমুখ করেন নি। তাঁর ভাষায় - ‘কান্দুলিয়ার হুজুর পাক হযরত আবু আলী আক্তার উদ্দীন শাহ্
কলন্দর গউস পাক এঁর কাছে গিয়েই এ সন্তানকে পাই। আমার কোন সন্তান না হওয়ায় আমি
বিভিন্ন মাজার ও দরবারে আর্জি করেছিলাম। অবশেষে কান্দুলিয়ার হুজুর পাকের করুণায় এ
সন্তান আমার গর্ভে আসে।’ একদিন যাঁর হাতে
তিনি দিয়ে যাবেন তাঁর মহা দায়িত্ব ভার, তাঁর আর্বিভাবেরও নিমিত্ত হয়ে উঠবেন তিনি, এও যেন ঠিক করা আগে থেকেই! যুগের ডাকে সাড়া দিতেই যেন যুগাবতারের পরিকল্পিত
আগমন!
মা ছায়েদার স্মৃতিচারণেও দেখা যায় এরই প্রতিফলন, “ছেলে যখন মোটামুটি সাবালক তখন থেকেই সে দলবল নিয়ে
এদিক-সেদিক বেড়াতো, ঘরে থাকতো না।
আমার কথাও শুনতো না, তাই একদিন
কান্দুলিয়ার হুজুর পাকের কাছে গিয়ে বললাম, ছেলেতো আমার কথা শুনে না, ঘরেও থাকে না।
তিনি বললেন, ‘ছেলেকে বিয়ে দিয়ে দেন’। আমার ভাগ্নির
সাথে বিয়ে দিলাম ছেলের, তারপরও তাকে ঘর
মুখা করতে পারলাম না। সেই আগের মতই। দলবল নিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। আমি অনেকটা বিরক্ত
হয়েই আবার তাঁর কাছে গিয়ে নালিশ করলাম - ছেলেতো সেই আগের মতোই, সংসার পরিবার কারোর প্রতি কোন খেয়াল নেই। তখন তিনি বললেন, ‘আমার ছেলেকে আমাকেই দিয়ে দেন।’ তাঁর কথা শুনে মা ছায়েদা আক্তার বললেন, ‘ছেলে আপনার কাছেই থাক।’ তিনি বুঝে গিয়েছিলেন যে, সাধনার ধন যাবে
সাধনার পথেই! ছেলে যখন কোলে তখনি তিনি তা জেনে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘ওঁর যখন এক বছর বয়স তখন এক সাধক ওকে দেখে বলেছিলেন, ‘মা’ তুই এ-ছেলেকে
কোন বন্ধন দিয়েই ধরে রাখতে পারবি না।’ তবুও মায়ের মনতো! ছেলেকে ঘরে ধরে রাখার চেষ্টা তাই কম করেননি তিনি। ছেলেকে
তিনি বিয়ে করিয়েছিলেন ২০ বৎসর বয়সেই। মায়ের ইচ্ছায় যেমন তিনি বিয়ে করেছেন তেমনি
স্বামী হিসেবেও তাঁকে দেখা গেছে আদর্শ স্বামীর ভূমিকাতে। স্ত্রী আছিয়া খাতুন নিজেও
জানতেন স্বামীর ভাবুক স্বভাব। তাই স্বামীর পথে বাধা না হয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে
দেন তিনি। তাঁদের দাম্পত্য জীবনে আসে পরপর দু’টি ছেলে সন্তান। কিন্তু সন্তান হলে কি
হবে?
ভাবনায় যার জগৎ সংসার, ক্ষুদ্র সংসার তাকে আটকে রাখে সে শক্তি কোথায়? তাঁর মন যে আগে থেকেই ধরা পড়ে আছে কান্দুলিয়ার মৌলভীর কাছে!
সংসার উদাসীন তিনি অনেক আগে থেকেই ঘুরে বেড়াতেন বিভিন্ন মাজার দরবারে। বিশাল
সম্পত্তির মায়া ছিন্ন করে তিনি বাইরে বাইরে ঘুরতেন, অন্তরে প্রোথিত সত্যানুসন্ধানী সত্তার উদ্বেলতায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণে
অনীহার পেছনেও এটাই ছিল মূল কারণ। ভেতর থেকে নিজেকে জানার তাগিদ যিনি অনুভব করেন, প্রাতিষ্ঠানিক পাড়ালেখায় যে তার মন বসে না!
মাজারে মাজারে ঘুরে প্রচুর অর্থ তিনি
নিঃসঙ্কোচে ব্যয় করেছেন। অবশেষে তাঁর অনুসন্ধিৎসু মন খুঁজে পেল তাঁর কাঙ্ক্ষিত
আশ্রয়,
আত্মবিকাশের সঠিক পথ। আশ্রয় পেলেন ‘কান্দুলিয়ার মৌলভী’ অর্থাৎ হযরত আবু আলী আক্তারউদ্দীন
শাহ্ কলন্দর গউস পাঁক এর চরণে। গুরুর ইচ্ছাতে সমর্পণ করলেন নিজের ইচ্ছাকে। নিখাঁদ
প্রেমের তরী ভাসালেন গউস পাক-এঁর হৃদয় সাগরে। কর্ম ও ত্যাগের সাধনায় তাঁর
একনিষ্ঠতা তাঁকে মুক্তির সনদ এনে দিল এক সময়। পরশ পাথরের পরশে ‘ভাটির ছেঁড়া’ (তাঁর গুরু তাঁকে এ-নামেই ডাকতেন) হলেন স্বতন্ত্র এক পরশ পাথর। সাধনার এ
পর্যায়ে বৈশ্বিক মানবতার এক অনুধ্যান নিয়ে তিনি হলেন সংসারত্যাগী। সংসার তাকে আটকে
রাখতে পারলো না। যিনি পরিবর্তনের কারিগর হবেন, তিনি আবদ্ধ থাকতে পারেন না সংসারের চার দেয়ালে। ‘কর্মের বাইরে ধর্ম নয়’ - সত্যের এ চরম দীক্ষা দিবেন যিনি, মানবতার সেবায় কর্মের স্রোতে তাঁর সতত সঞ্চরণ তো খুবই স্বাভাবিক।
গুরুভক্ত শিষ্য গুরুর কাছ থেকেই জেনেছিলেন, ‘জ্ঞানার্জনে বই কেতাব হতে মানুষ কেতাব উত্তম।’ তাই বুঝি তাঁকে দেখা গেছে মানুষের মাঝে অবাধ বিচরণে। স্বভাবতই, গতানুগতিক জীবন যাপনের সাধ তাঁর ছিল না। মাস-মাহিনের চাকুরি
জীবনের দাসত্বের তো প্রশ্নই ওঠেনা। পিতার পথ অনুসরণ করে তাই তিনিও আয়ের উৎস হিসেবে
বেছে নিয়েছিলেন ব্যবসা। ‘চাকুরি করা
মানেই অন্যের গোলামী করা’ - তিনি নিজেই
বলতেন একথা। আজীবন তিনি স্বাধীন জীবনযাপন করেছেন। আপন ভুবনে আপনিই বাদশাহী করেছেন।
পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধে তিনি কিশোরগঞ্জ শহরে ব্যবসা শুরু করেন। কিশোরগঞ্জ শহরের
শহিদী মসজিদের কাছে মহাজনী ঘরের মতো এক ঘরে তাঁর কাপড়ের দোকান ছিল। পড়াশুনা ছেড়েই
তিনি ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তাঁর বয়স তখন পনের/ষোল বছর। দোকানে বসে তিনি কুরআন
অধ্যয়ন করতেন। ব্যবসার প্রতি কোন খেয়ালই ছিল না তাঁর। মনে হতো তিনি যেন কি
খুঁজছেন। কথা বলার মতো লোক পেলেই তাদের দোকানে বসিয়ে চা-বিস্কুট খাইয়ে আপ্যায়ন
করতেন এবং আলাপ-আলোচনা করতেন।
এরপর তাঁকে ব্যবসায়ী হিসেবে দেখা যায় ঢাকার
চকবাজারে। যতদূর জানা যায়, ছোট কাটরায়
হাকিম হাবিবুর রহমান রোডে তিনি ব্যবসা করতেন। দুনিয়াদারির এসব কর্মে যুক্ত থেকেও
তিনি সাদা পোশাক পরিধান করতেন। এ সময়েই কান্দুলিয়ার মৌলভী সাহেবের সাথে তাঁর
যোগাযোগ হয়। ১৯৫৫-৫৬ সালের দিকে প্রায়ই তাঁকে তপস্যারত দেখা যেতো। ব্যবসাতে মনোযোগ
না থাকার কারণে তা ক্রমে সঙ্কুচিত হতে থাকে। লোকে এ নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি তাঁর
আল্লাহর উপর নির্ভরতার কথা বলতেন।
সাধনার পথে নেমে তাঁর আল্লাহ্কে যখন তিনি
খুঁজে পেয়েছিলেন, একটু একটু করে
যখন পূর্ণ সমর্পিত হলেন তাঁর আল্লাহর কাছে, তখন যেন চেনা আনার মিয়া আর নেই। তাঁর পরিচয় হলো আনার ফকির। সূফী সাধক আবু আলী
আক্তার উদ্দীন তাঁকে কঠিন সব পরীক্ষার আগুনে পুড়িয়ে পুড়িয়ে পরিণত করেন খাঁটি পরশ
পাথরে। জানা যায় শাহ্ সূফী হওয়ার পর তিনি প্রথম অবস্থান করেন কিশোরগঞ্জ জেলার
বর্তমান নিকলী উপজেলার ছাতিরচর এলাকায়। এ সময় তাঁর পদচারণা ছিল - নিকলী, বাজিতপুর, কুলিয়ারচর, সরারচর, অষ্টগ্রাম, ইটনা এবং বৃহত্তর সিলেটের ভাঁটি এলাকায়। কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো দিনের পর দিন নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়াতেন তিনি। প্রায়ই
তাকে দেখা গেছে নদীর কিনারায় তন্ময় অবস্থায়। কখনো বা দিনের পর দিন পানির উপর
ভাসমান অবস্থায়। তিনি যখন তন্ময় থাকতেন তখন তাঁর গায়ে কাপড় আছে কি-না সে খেয়াল
থাকতো না,
লোকজন তাঁকে লুঙ্গি পরিয়ে দিতো। ঐ সময় তাঁর হাতে একটা দা
থাকতো। সে দা’টি এখন সরারচর দরবারে রক্ষিত আছে।
গোটা ষাটের দশকে উল্লেখযোগ্য সময় তাঁর কাটে এই এলাকায়। কিশোরগঞ্জ, বাজিতপুর, অষ্টগ্রাম, নিকলি মোটকথা সমগ্র কিশোরগঞ্জ এলাকায় তিনি ঘুরে বেড়াতেন।
এসব এলাকায় তিনি যেখানে গেছেন সেখানেই মানুষের ভীড় জমে যেত এবং লোকজন তাদের
সমস্যার কথা তাঁর সাথে আলাপ করত। সকলের সমস্যা এমনি এমনিই দূর হয়ে যেত। তিনি কোথায়
যাবেন তা আগে থেকে নির্ধারিত থাকত না। মনে হয়েছে তো গভীর রাতেই রওনা দিয়েছেন। সে
সময় ৩/৪ শত মানুষ তাঁর সাথে সাথে থেকেছে। যেখানে রাত হয়েছে, সেখানেই সকলে জমায়েত হয়ে মারফতি গান বাজনা, জিকির ইত্যাদি করে রাত পার করেছেন। আর খাওয়ার তো কথাই নেই।
কোথা থেকে যে খাবার এসেছে তা আগে থেকে বলা মুশ্কিল। মানুষ বুঝে খাবার এসেছে, বা গরু জবাই হয়েছে। চোখে না দেখলে যা কেউ উপলব্ধি করতে
পারবে না। এই সময় তাঁর ভাব ছিল বেশ গরম। মাঝে মধ্যে বকাবকিও করতেন। তবে তাঁর বকাবকি কাউকেই পীড়া দিতো না। রাতের পর
রাত তিনি এখান থেকে ওখানে হেঁটে বেড়িয়েছেন কিন্তু তাঁর কোন ক্লান্তি ছিলো না।
কিশোরগঞ্জে যখন ছিলেন তখন তাঁর বেশ লম্বা চুল
ছিল। তিনি সকলের সাথে উদারভাবে মিশতেন। ধনী-গরিব, হিন্দু-মুসলমান, নারী-পুরুষ, সকলেই ছিল তাঁর খুব প্রিয়। তিনি বৈষ্ণবদের আখড়ায়ও যেতেন।
বৈষ্ণবীরা তাঁকে ভালোবাসতেন। তিনি তাদের আখড়ায় এলে তারা খুব খুশি হতেন এবং সারারাত
তাঁকে গান শুনাতেন। হুজুর বৈষ্ণবীদেরকে মা সম্বোধন করতেন এবং সেভাবে তাদের সাথে
মেলামেশাও করেছেন। শুধু বৈষ্ণব বা বৈষ্ণবী নয়, ওই এলাকায় সকল নারী-পুরুষের কাছে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কাছের, আপনজন, সাক্ষাৎ দেবতা
কিংবা মুক্তিদাতা।
ষাটের দশকের শেষে গুরুর নির্দেশে তিনি অবস্থান
নেন রাজধানী ঢাকায়, নারিন্দা শাহ্সাব
বাড়িতে। এ সময় তিনি সংসার ত্যাগ করেছেন পুরোপুরিভাবে। তাঁর মাথাভর্তি বাবরী চুল, বেশ বড় গোঁফ, পরনে সাদা পোশাক-লুঙ্গি, গেঞ্জি, উড়নী। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি নারিন্দা শাহ্সাব
বাড়ি থেকে ভজহরী স্ট্রিটে ভূতের গলিতে দুই
কক্ষের একটি ভাড়া বাড়িতে চলে এলেন। এ বাড়িতেই প্রথম হাক্কানী খান্কা শরীফের সাইনবোর্ড লাগানো হয়।
১৯৭৩ সালে ভজহরী স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে তিনি উঠে আসেন ধানমন্ডির ঝিগাতলায়।
তাঁর মুর্শিদের হুকুমে তিনি ঢাকার ধানমন্ডিতে
হাক্কানী খান্কা শরীফ স্থাপন করেন। ক্রমান্বয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তিনি
ছড়িয়েছেন তাঁর সাধনার দীপ্তি। গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মাঝে
মানবতার ধর্মকে প্রসারিত করেছেন তিনি। ধর্মান্ধতাকে কখনোই প্রশ্রয় দেননি তিনি।
তাঁর সংস্পর্শে যিনি এসেছেন তিনিই উপলব্ধি করতে পেরেছেন প্রকৃত ধর্মের স্বরূপ। ধর্মকে
প্রতিষ্ঠিত করতে দেশব্যাপী তিনি বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময়ে স্থাপন করেছেন
হাক্কানী খান্কা শরীফ, আস্তানা শরীফ, দরবার শরীফ, হাক্কানী কমপ্লেক্স প্রভৃতি। তাঁর আশীর্বাদপুষ্ট হাক্কানী মিশন বাংলাদেশ -এর
প্রতিষ্ঠা সেই একই লক্ষ্যে - ‘ধর্ম মানবতার জন্য, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থের জন্য
নয়’। হাক্কানী মিশন বিদ্যাপীঠ, হাক্কানী মিশন মহাবিদ্যালয় - তাঁর শিক্ষানুরাগকেই প্রকাশিত
করে।
বর্তমান হলুদ সাংবাদিকতার জগতে সত্য ও ন্যায়ের
পক্ষে নির্ভীক হওয়ার জেহাদে রত, সৃজনশীল ও
আত্মিক সেবা সহায়তা দানের অভিপ্রায়ে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক বর্তমান সংলাপ’ তাঁর যুগোপযোগী
আধুনিক চিন্তা-চেতনাকে প্রতিভাত করে।
ধর্মের গোঁড়ামিকে তিনি প্রশ্রয় দিতেন না।
সাধনার উন্মুক্ত চিত্ত বলয়ে ছিল তাঁর পরিভ্রমণ। শুভ্র বসনে সজ্জিত হয়ে যে
শাহানশাহীতে তিনি থাকতেন, তা কারো কারো
কাছে প্রশ্নবোধক হয়ে দেখা দিতো। কিন্তু যিনি তাঁর সঙ্গ লাভ করেছেন তিনিই দেখেছেন
বাহ্যিক আবরণের আড়ালে তাঁর ত্যাগের নিদর্শন।
অধিকাংশ সময়ই তিনি সফরে থাকতেন। কখনো গাড়িতে, কখনো নৌকায়, কখনো পায়ে হেঁটে তিনি সফর করেছেন দেশের আনাচে-কানাচে। তাঁর প্রতিটি সফর ছিল
কার্যকারণ সম্পর্কিত। ধর্মকে কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তিনি শিক্ষা দিয়েছেন - ‘নিজের বিচার নিজে করো, রাত্রদিনে’। আত্মবিশ্লেষণের সূক্ষ্মতায় আত্মোন্নয়নের পথে অভিযাত্রী রূপে গড়ে উঠতে তিনি
দীক্ষা দিয়েছেন তাঁর অনুসারীদেরকে। ভালবাসায়, স্নেহে, আদরে, আপ্যায়ণে, আতিথেয়তায় তাঁর
তুলনা চলে না। অনেকেই তাঁর কাছে আসতেন এসবেরই টানে। শুধু ধর্মীয় শিক্ষাই নয়, জাগতিক কর্মানুশীলনের মাধ্যমেও তিনি অনেককেই দিয়েছেন নতুন
জীবনের সন্ধান। তাঁর প্রতিটি কথায়, চলাফেরায়, ভঙ্গিমায়, চাহনিতে তিনি শিক্ষণীয় ইঙ্গিত রেখেছেন। যে যেভাবে বুঝেছে সে
সেভাবেই তা গ্রহণ করেছে। দরবারী আদব ও তাঁর হুকুম যথাযথ পালন করতে পারলে অনেক
মকসুদি তাদের সমস্যার সমাধান পেয়েছেন। আত্মপ্রচার বিমুখ ছিলেন বলেই ওলিকুল শিরোমনি
হয়েও তিনি নিভৃতচারী জীবনযাপন করেছেন। ‘মন চাইলে আইসেন’ বলে তিনি
আগন্তুকদের আহ্বান জানাতেন। কখনই তিনি নিজের সুপ্ত সাধন ভান্ডার যেচে কারোর সামনে
প্রচার করেননি। তাঁর শিক্ষাই ছিল - ‘ধনবান হও, প্রকাশিত হয়ো না’। যিনি তাঁর
একান্ত অনুগ্রহের পাত্র শুধু তিনিই তাঁর প্রকৃত পরিচয় জানতে পেরেছেন।
২০ শ্রাবণ ১৪০৬, ৪ আগস্ট, ১৯৯৯, বুধবার, সকাল ৭টা ৫
মিনিট। প্রতিদিনের মতোই ভোর থেকেই শুরু
হয়েছে নগরবাসীর প্রস্তুতি। চমক সৃষ্টিকারী একরাশ সংবাদ বুকে নিয়ে পত্রিকাগুলো
পাঠকের হাতে পৌঁছে দেয়ার জন্য দিক্ বিদিক হকাররা বেরিয়ে পড়েছে; প্রভাতী স্কুলের ছোট্ট সোনামনিরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ কচলাতে
কচলাতে যখন বিদ্যালয়ের দিকে যাত্রা শুরু করেছে - ঠিক তখনই সক্রিয় হয়ে উঠে রাজধানীসহ
দূর-দূরান্তের টেলিফোনগুলো। কান্নাভেজা আর্তি নিয়ে পরস্পরের কাছে তরঙ্গ প্রবাহে
প্রবাহিত হতে থাকে তাপসকূল শিরোমণি সুলতানুল আউলিয়া আলহাজ্ব হযরত শাহ্ কলন্দর
সূফী খাজা আনোয়ারুল হক রওশন জমির মাদ্দা জিল্লাহুল আলী -এঁর অন্তর্ধানের সংবাদ।
হঠাৎ এ সংবাদে নিস্তব্ধ নিথর হয়ে যায় তাঁর ভক্তকূলের চলনশক্তি। ছন্দপতন ঘটে তাদের
দৈনিক জীবনযাত্রার। সম্বিত ফিরে পেতেই আবারো ভক্তকূল সক্রিয় ওঠে ভিন্ন ধারায়।
উন্মাদের মতোই নিজেদের অজান্তে যাত্রা শুরু করে, লক্ষ্যস্থল - রাজধানীর ধানমন্ডি। যেখানে সকলের প্রাণ প্রিয় পুঁরুষ শেষ
নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। আত্মার পরম আত্মীয়ের বিয়োগ ব্যথায় উদ্বেলিত মানুষের ঢল
নামে ধানমন্ডির হাক্কানী দরবার শরীফের রাস্তায়।
মা ভক্ত সাধক মায়ের মৃত্যু তারিখকেই বরণ করে
নিলেন নতুন পথে যাত্রার। পরিশেষে মায়ের পাশেই শায়িত হলেন তিনি। কিশোরগঞ্জ জেলার
চাঁন্দপুর গ্রাম আজ এ মহাপ্রাণের স্পর্শে
পুনরুজ্জীবন লাভ করে হয়েছে ‘চাঁন্দপুর শরীফ’। কল্লোলিত হয়ে
উঠেছে তাঁর প্রেমিক, ভক্ত ও
মকসুদিদের সমাগমে। এক মহামিলন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে চাঁন্দপুর শরীফ। এর ব্যাপ্তি দিনে দিনে হচ্ছে প্রসারিত।
চরম লৌকিকতার মাঝে থেকেও যেন এক পরম অলৌকিক
সত্তা আনোয়ারুল হক। ধারণার জগতের মাঝে থেকেও ধারণাতীত রূপে দেখা গেছে তাঁকে। যাঁর
মাধ্যমে যন্ত্রণাক্লিষ্ট বিপন্ন অস্থির মানুষ লাভ করেছে স্বস্তি, রোগমুক্তি; দূর হয়েছে বিপদ, ঘোচাতে পেরেছে অভাব, পেয়েছে পরম নিশ্চয়তা। সাধারণ বেশে থেকেও রাজকীয়ভাবে ছিল তাঁর নিত্য চলাফেরা; এক অসাধারণত্ব ঘিরে থাকতো তাঁকে সারাক্ষণ। লোকান্তরের পর
বিভিন্ন ভক্তদের টুকরো স্মৃতিচারণে উঠে আসে এই মহান সাধকের অসাধারণ জীবনাচরণ ও
কর্মের কথা। তাঁর ভক্ত, দীর্ঘদিনের
অনুগামী,
কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুরের এম এম লুৎফর রহমান তাঁর
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘উনি যে কখন
ঘুমাতেন আমরা বুঝতে পারি নাই। প্রায় প্রতিদিনই দরবারে লোকজন নিয়ে ভোর চারটা পাঁচটা
পর্যন্ত জেগে থাকতেন। তিনি যখন যেখানেই যান না কেন কোন দিনই ভর পেট খেতেন না। খুব
অল্প অল্প খেতেন। আমি দেখেছি পাঁচ দিন
পর্যন্ত তিনি শুধু চা বিস্কিট খেয়ে থেকেছেন’। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর জাহিদ হোসেন আবুধাবিতে
কর্মরত থাকা অবস্থায় জটিল সমস্যায় পতিত হন, পারিবারিক সূত্রে ধানমন্ডিতে সূফী সাধক আনোয়ারুল হক-এঁর দরবারে গেলে যে
বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা তার হয়, সেটা ছিল - ‘হুজুর হঠাৎ করে আমার আবুধাবীর সমস্যার কথা বললেন। তখন আমি ভাবলাম উনি তো সাধারণ মানুষ
না। যেটা আমি ছাড়া কেউ জানে না, অথচ উনি সেটাই বললেন’! হুজুর বললেন, ‘আল্লাহ্ তো
আলিমুল গায়েব’। দরবারের উপস্থিত সবাই বললো ‘জ্বী হুজুর’। আমি চুপ করে
আছি। হুজুর আমাকে বললেন, ‘আপনি কি বলেন? আমি বললাম, ‘জ্বী, আল্লাহ্ আলিমুল
গায়েব।’
তখন তিনি বললেন, ‘আমাকে একদিন আমার মা বাজার থেকে এক মন দুধ, এক মন চিনি, এক মন পোলাউর চাল আনতে বলেছিলেন।
তা তাঁর কথার কোন উত্তর না দিয়ে কান্দুলিয়া (গুরু হয়রত আবু আলী আক্তার
উদ্দীন -এঁর কাছে) চলে গেলাম। সেখানে গেলে তিনি বললেন, ‘মা তো বাজার থেকে এক মন দুধ, এক মন চিনি, এক মন পোলাউর চাল আনতে বলেছিলেন’। একথা বলার পর উনি বললেন, ‘আল্লাহ্ নাকি আলিমুল গায়েব’, ‘কান্দুলিয়ার মৌলবী তাহলে কী?’
এম এম লুৎফর রহমানের বর্ণনা থেকে জানা যায়, ‘সৌদি আরবে চাকরি করে এক ছেলে। সে লিখেছে তার মুত্রদ্বারে
পাথর হয়েছে। খুব খারাপ অবস্থা। অপারেশন করতে হবে।
ছেলের চিঠি পেয়ে বাবা দরবারে এলেন। হুজুরকে ঘটনা জানালে উনি এক বোতল
সেভেন-আপ আনতে বললেন। ছেলেটির বাবা সেভেন-আপ আনলে তিনি আর একজনকে তা খাইয়ে দিলেন।
একমাস পরে সৌদি আরব থেকে চিঠি এলো -‘আমি ভালো হয়ে গিয়েছি’।
তিনি যখন ঢাকা নারিন্দা শাহ্ সাহেব বাড়িতে
ছিলেন তখনকার একটা ঘটনা, ঐ এলাকার
ব্যবসায়ী তাঁর ভক্ত মো. সাইদুল হকের (তারা মিয়া) বর্ণনায় - “একদিন এশার সময় আমি আর হুজুর পাক বসে আছি। একজন লোক মসজিদ
থেকে নামাজ পড়ে আমাদের সামনে আসলে হুজুর পাক তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কিগো নামাজ পড়ে ফেলেছেন?’ সেই লোকটি বললো, ‘আপনি না আমার
পাশে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়লেন’। হুজুর পাক বললেন, ‘আরে দূর মিয়া, হেই কথা
জিগাইছিনি’?”
নরসিংদীর বেলাব থানার জেবুন নাহার মতিন ছিলেন
তাঁর ভক্ত। তার স্মৃতিচারণে জানা যায় - ‘দ্বিতীয় সন্তান হওয়ার পর একদিন দরবারে এক বোনের সাথে কথা বলছি, একটি মেয়ে সন্তান হলে ভালো হতো। প্রথমটা যখন ছেলে হলো, দ্বিতীয়টা মেয়ে হলেই ভাল হতো। আমরা যখন এ কথা বলাবলি করছি
হুজুর পাক তখন ভিতরে, হুজুরা শরীফে।
একথা বলার ঠিক দুই মিনিট পর তিনি বাইরে বেরিয়ে এসেই বললেন, - ‘একটা মেয়ে হলেই ভালো হতো’। আমরা খুব লজ্জায় পড়ে গেলাম। তিনি যেখানে বসা
ছিলেন সেখানে কোন শব্দই যাওয়ার কথা না, অথচ তিনি আমাদের ভাষাই নিজ মুখে উচ্চারণ করলেন, ‘একটা মেয়ে হলেই ভালো হতো’।
তাঁর ছাতিরচরে থাকার সময়ের কথা। সেখানকার ভক্ত
মোহাম্মদ আহসান আলী মাস্তানের স্মৃতিচারণে জানা যায় - “দীর্ঘ জীবনে তাঁর অনেক লীলা আমি দেখেছি। একবার হুজুর আমায়
নদীর ঘূর্ণি (যেখানে পাক ওঠে) মধ্যে থেকে ডুব দিয়ে মাছ তুলে আনতে বললেন। আমি তার
কথা মতো কোনরূপ দ্বিধা না করে প্রচন্ড ঘূর্ণির মধ্যে ডুব দিলাম এবং বিশ হাত নিচ
থেকে একটা বড় সাইজের বাইল্লারা মাছ তুলে আনি যা সাধারণত কোন অবস্থাতেই ওই প্রচন্ড
ঘূর্নির মধ্যে ধরা সম্ভব না। সম্ভব হয়েছে কেবল তাঁর হুকুমের জোরে’। একদিন নিকলিতে
থাকার সময় নৌকা থেকে নিকলির নদীতে একটা সাবান বেশ দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন তিনি।
উপস্থিত ১০/১২ জনকে বললেন নদী থেকে সাবান তুলে আনতে। সকলে চেষ্টা করল কিন্তু সাবান
কেউ খুঁজে পেলনা। হুজুর আমায় বললেন, ‘তুই যা, সাবান তুলে নিয়ে আয়’। আমি তাঁর
নির্দেশ মত পানিতে ডুব দেই এবং দেখি যে পাঁচ-ছ’হাত নিচে সাবানটা ভাসছে। সাবানটা তুলে আনলাম, যা সম্ভব হয়েছে কেবল হুজুরের হুকুম বা তাঁর ইচ্ছার কারণে।” ধানমন্ডি-হাক্কানী খান্কা শরীফে অনেক বছর দায়িত্ব পালন
করেছেন নরসিংদীর মোতালেব। তার স্মৃতিতে উঠে এসেছে লৌকিকতার মাঝে বিচরণ করে থাকা
সূফী সাধকের অলৌকিক ঘটনা। তিনি বলেন - “আমাকে দরবারের কিছু দায়িত্বে রেখে তিনি যখন আজমীর চলে গেলেন, সে সময় প্রায় ১৫/১৬ দিন পর একদিন দরবারের বাইরে হাইর্কোট
মাজারে চলে যাই। ফিরে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। কথা ছিল দরবারে সন্ধ্যের সময় বাতি
দেয়া কিন্তু রাস্তায় থাকতেই মাগরিবের আযান পড়ে যাওয়ায় দ্রুত দরবারে এসে দেখি
হুজুরা শরীফের দরজা খোলা এবং আমি দরজার কাছাকাছি আসতেই দেখি হুজুর পাক ভিতরে বসে
আছেন। তাঁকে বসা দেখে পিছনে ফিরে গদি ঘরে মোস্তফা ভাইকে জিজ্ঞাসা করি, হুজুর পাক কখন এলেন? মোস্তফা ভাই আশ্চর্য হয়ে বললেন, হুজুর পাক আসলে তো দেখতেই পেতেন। পরে আবার হুজুরা শরীফের কাছে গিয়ে দেখি দরজা
বন্ধ। আমার তখন বুঝ হয় যে, আল্লাহ্’র ওলী যখন যেখানে ইচ্ছা করেন সেখানেই অবস্থান করতে পারেন।
হুজুর পাক আজমীর থেকে
ফিরে আসার পর এ ঘটনার কথা মনে করে যখনই তাঁর
সামনে গিয়েছি তখনই তিনি আমায় ধমক দিয়েছেন অর্থাৎ তিনি প্রসঙ্গটা এড়াতে চেয়েছেন। পরে একদিন তিনি তাঁর
মুর্শিদ কেবলার কথা তুলে বলেন, ‘মৌলবী যে একই
সাথে ২/৩ মসজিদে নামাজও পড়ছেন, দরবারেও ছিলেন!’ বলে ‘আল্লাহ্ হাজির নাজির’ এই কথা দুই-তিনবার তিনি বললেন”।
উনিশ’শ নিরানব্বই -এর ৪ আগস্ট প্রভাতের বুক চিরে সূর্য তার
উজ্জ্বল কিরণচ্ছটায় জানিয়ে দিয়েছিলো - আমি আছি তোমাদের মাঝে, বাতাস প্রতিটি জীবে প্রাণের সঞ্চার করে বলেছিল - আমি
আছি তোমাদের মাঝে। আকাশ তার বিশালতা নিয়ে বলে দিয়েছিলো - আমি থাকবো তোমাদের মাথার উপর ছাতার মতো। আমি
বর্তমান। আমি আছি। জাগতিক দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে থাকা সূফী সাধক আনোয়ারুল হক আজ অন্তরালে থেকেই নিজেকে প্রকাশিত করছেন
বিশ্বাসীদের অন্তরে ও চিন্তা প্রবাহে। বিশ্বাসীদের কাছে তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী এক
মহাপ্রাণ, প্রশংসার সর্বোচ্চ শিখরে
অধিষ্ঠিত। সূফী সাধক আনোয়ারুল হক -এঁর আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করার মানসে
কর্ম-মানবতা-সেবার পতাকা নিয়ে হাক্কানী মিশন বাংলাদেশ মানবতার সেবায় কর্ম করে
যাচ্ছে নিরলসভাবে। দেশের সীমানা অতিক্রম করে আজ হাক্কানী মিশন বাংলাদেশ’র কর্ম-পরিধি বিস্তৃত হচ্ছে বিদেশে। বিশ্বের
কল্যাণকামী মানুষ মিলিত হচ্ছে শান্তির
ছায়াতলে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন