শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৩

বাঙালিত্বই উত্তরণের একমাত্র পথ



বাঙালিত্বই উত্তরণের একমাত্র পথ

শাহ্ফুয়াদ বিশ্বের সমগ্র বাঙালি জনগোষ্ঠীর একমাত্র রাষ্ট্র বাংলাদেশ এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বিগত চল্লিশ বছরে এদেশের এমন একটি দিনও ছিল না যখন রাষ্ট্রক্ষমতার কোনো পদ শূন্য ছিল স্বাধীনতার পর থেকে দিন যতই গেছে ততই দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সরকারি ক্ষেত্রে নতুন নতুন পদ সৃষ্টি হয়েছে এবং হচ্ছে দেশের কোনো কোনো বিশেষ শ্রেণী বা গোষ্ঠীর সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে কিন্তু যা হয়নি তা হলো সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধার একটি দেশ প্রতিষ্ঠা এক কথায় বলা যায়, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া যে ব্যক্তি বা দল যখনই ক্ষমতায় গিয়েছে তখনই তারা নিজেদের ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থ উদ্ধারে সর্বশক্তি নিয়োজিত করেছে আর তাই যদি না হবে দেশের অবস্থা আজ এমন হবে কেন? কয়েক শত বা কয়েক হাজার পরিবারের হাতে দেশের সমস্ত সম্পদ, সুযোগ-সুবিধা কুক্ষিগত হবে কেন ? শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, পরিবহণ ব্যবস্থা কতিপয় গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি হবে কেন? যে গ্রাম, মফস্বল শহর শত শত বছর ধরে ছিল শান্তিপূর্ণ আবাসস্থল সেখানে আজ কেন অশান্তি ? বৈষম্য মিথ্যাচার নেই এমন একটি জায়গাও পাওয়া যাবে না আজকের সমাজে স্বাধীনতার ৪০ বছর পরে এমন অবস্থা তৈরি করা হচ্ছে যে, ইংরেজি না শিখলে সভ্য সমাজে বাস করা যাবে না বড় লোক হওয়া যাবে না অথচ নিজের মাতৃভাষাকে সম্মান না করে, মর্যাদা না দিয়ে শুধুমাত্র বিদেশি ভাষা সংস্কৃতি চর্চা করে উন্নতি করেছে এমন একটি উদাহরণও পৃথিবীতে নেই
বাঙালির চাওয়া-পাওয়া : বাঙালি জাতির অবিসম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল বাঙালির সার্বিক মুক্তি বর্তমানে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বক্তৃতা, বিবৃতিসহ সকল রাজনৈতিক কর্মকা- চলছে ঠিকই, কিন্তু যে লক্ষ্য উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে সারা জীবন তিনি রাজনীতি করলেন, জেল খাটলেন, তা  বাস্তবায়িত হয়নি অর্থাৎ বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তি আজও আসেনি কেন আসেনি? ১৯৭১ সালে বাঙালিরা যখন রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ তখন কী ছিল তাদের চাওয়া-পাওয়া? কী ছিল তাদের স্বপ্ন?- এসব কথার উত্তর রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণেই রেসকোর্স ময়দানে (আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সেদিন বঙ্গবন্ধু যা বলেছিলেন তার মূলে ছিল সকল প্রকার শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্য থেকে বাঙালি জাতির মুক্তির নির্দেশনা বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাই ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ ১৯৭১-এর অগ্নিঝরা মাসে সমগ্র পূর্ব বাংলার শহর-বন্দর-গ্রাম-গঞ্জ সর্বত্র ধ্বনিত হয়েছিল, ‘জয় বাংলা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগোইত্যাদি শ্লোগানে বঙ্গবন্ধুর মার্চের ১৮-মিনিটের ভাষণে ছিল বাঙালির মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার উদাত্ত আহ্বান এই ভাষণে ঘুরে ফিরে বার বারই এসেছে বাংলা বাঙালির কথা মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের বাংলাদেশ আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি এর জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব তা আজ অনস্বীকার্য আর এই ব্যর্থ রাজনীতির জন্যই দেশে তৈরি হয়েছে সুবিধাভোগী মাথাভারী আমলাতন্ত্র সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবী সমাজ, যাদের মিথ্যাচার তথা বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির ঘেরাটোপে নতুন করে জন্ম হয়েছে একটি ধর্মান্ধ ধর্মভীরু সমাজ এই সুবিধাভোগীদেরই আরেকটি উপজাত সমাজ হচ্ছে নতুন নতুন ব্যবসায়ী সম্প্রদায় যাদের হাতে আজ দেশের সকল সম্পদ কুক্ষিগত এবং তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন গণমাধ্যমে চাকুরি করে, বুদ্ধি বিক্রি করে নতুন যে সুবিধাভোগী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে তাদের পক্ষে দেশের সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখা যে কোনোভাবেই সম্ভব নয় তা দেশের ১৯৯০-পরবর্তী রাজনীতির চরিত্রে ইতোমধ্যেই প্রমাণিত শেষ পর্যন্ত দেশের গণতন্ত্রের নামে আজ দেশে দুই নেত্রীর পরিবারতন্ত্র কায়েম হয়েছে বলেই প্রতীয়মান তাই দেখা যায়, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আজও দেশে ক্ষমতার হাতিয়ার ধর্মের নামে, ইসলামের নামে এত বড় জালিয়াতির ঘটনা পৃথিবীতে আর কয়টা আছে তা আজ আবার ভেবে দেখার সময় এসেছে
ডান-বাম রাজনীতির ধুম্রজাল : ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার সংগ্রাম ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের সংগ্রাম এখানে ডানপন্থী, বামপন্থী রাজনীতির কোনো বিষয় ছিল না খাঁটি দেশপ্রেম, খাঁটি বাঙালিত্ব এদেশের মানুষের মধ্যে সেদিন ছিল বলেই পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের দেশি-বিদেশি সকল শক্তির চক্রান্ত সেদিন ব্যর্থ হয়েছিল কে বামপন্থী আর কে ডানপন্থী সে প্রশ্ন সেদিন ছিল না পরিচয় সেদিন একটিই ছিলআমরা বাঙালিএকজন ভাল বাঙালিই পারে একজন ভাল মানুষ হতে আর বাঙালিরা সেদিন মানুষ হয়েছিল বলেই তাঁদের স্বাধীনতার যুদ্ধে এদেশের বসবাসকারী সকল আদিবাসী, উপজাতি যারা আছে সবাই এদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ সহযোগিতা করেছিল
কিন্ত্র অত্যন্ত দুঃখজনক দুর্ভাগ্যজনক হলেও আজকের বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের দেশের মানুষকে আজ বামপন্থী, ডানপন্থী, উদারপন্থী মুসলমান, মডারেট মুসলমান ইত্যাদি নানা পরিচয়ে আমাদের বাঙালি পরিচয় মুছে দেয়ার চক্রান্ত বহমান বিশ্বায়নের গোলক ধাঁধায় পড়ে সবাই এখন ছুটছে বিশাল পরিমাণের অর্থ-বিত্ত-ভোগ-বিলাসের মোহে বড় মাপের ভালো মানুষ বাঙালি সমাজে দিন দিন দুর্লভ হয়ে পড়ছে অথচ এক সময় বাঙালি সমাজে সাহিত্য, কাব্য সাধনায়, রাজনীতি, বিপ্লবী চিন্তা-চেতনায়, সাংবাদিকতায়, চিকিৎসায়, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে বড় মাপের ভাল মানুষের অসংখ্য উদাহরণ ছিল  সমাজে দেখা দিচ্ছে মনুষ্যত্বের সংকট মিথ্যাচার কপটতার ( আরবী ভাষায় যাকে বলে মোনাফেক) সংস্কৃতি চালু হয়ে যাচ্ছে সর্বত্র ডানপন্থী-বামপন্থী-মুসলমান ইত্যাদি পরিচয়ের কেউই বলতে পারবে না যে, তাদের মধ্যে মিথ্যাচার নেই চিন্তাশীলদের বক্তব্য হচ্ছে, বাঙালি পরিচয়ে নিজেদেরকে আবারো প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে আরও আরও অধঃপতন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে
আমাদের পাথেয় : দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে, যেসব প্রতিশ্রুতি শুনে জনগণ বর্তমান সরকারকে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিল সেগুলোর অনেক কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি সরকার হয়তো ভেবেছিল সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখলেই দেশের মানুষকে খুশী রাখা যাবে সরকারের জনপ্রিয়তা বেড়ে যাবে কিন্তু বাস্তবে কতটুকু হয়েছে তা এখন গভীরভাবে ভেবে দেখার সময় এসেছে সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন কেলেঙ্কারির ফাঁদে পড়ে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি যে আরও জটিল আকার ধারণ করেছে তা স্বীকার করতেই হবে আবহমান কাল ধরে এদেশের মানুষে মানুষে যে সহানুভূতি, সহমর্মিতা, পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, দয়া-মায়া ছিল তা আজকের সমাজে প্রবলভাবে অনুপস্থিত বলে পরিলক্ষিত হচ্ছে দেশে সর্বত্র মারামারি, সংঘর্ষ, দুর্নীতি এবং সর্বক্ষেত্রে মিথ্যাচার নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাঙালিদের দেশে বাঙালির এই দুর্দিন কাটিয়ে তুলতে আমাদেরকে অবশ্যই আবারো কায়মনোবাক্যে বাঙালি হতে হবে আমাদের মূল পরিচয় আমাদের বাঙালি জাতিসত্তা, আমাদের বাঙালিত্বকে যেন আমরা ভুলে না যাই জীবনে আবারো প্রতিষ্ঠিত করতে হবে বাঙালির জ্ঞানতাপস বলে পরিচিত . মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সেই অমর বাণী, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি এটা কোন আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা মা-প্রকৃতি আমাদের চেহারায় ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে মালা-তিলক-টিকিতে কিম্বা টুপি-লুঙ্গি-দাঁড়িতে তা ঢাকবার জোটি নেই বিশ্বের উন্নত প্রতিটি জাতি নিজেদের জাতি পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে আমাদেরও বলতেই হবে এবং মনেপ্রাণে ধারণ করতে হবে এই সত্যটি যে, আমাদের দেশের মুক্তি বাঙালিত্বেই

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন