বিপর্যস্ত জন জীবন
সংবরণই শান্তির পথ
সংলাপ
॥ বর্তমানে দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি যা হারাচ্ছে তা হলো রাজনীতির আদর্শ ও আভিজাত্য।
শাসনব্যবস্থার মধ্যে বর্তমানে গণতন্ত্রই যে সর্বোত্তম হয়ে উঠতে পারল, তার একমাত্র কারণ
- এই শাসনব্যবস্থা অভিজাত। বিদ্বেষহীন-রুচিবোধ, মূল্যবোধ, শালীনতা, মনুষ্যত্ব, ঔদার্য
হাত ধরাধরি করে এখানে বিরাজ করে। গণতন্ত্রে মতভেদ আছে, কিন্তু মনোমালিন্য নেই। বিতর্ক
আছে, বিবাদ নেই। দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আছে, কিন্তু মানুষের সমাজে এর কোনও
প্রতিফলন নেই, কোনও অন্তর্দ্বন্দ্বও নেই। তাই বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে যখন দেশবাসী তাকায়
তখন বিস্মিত না হয়ে পারে না। আভিজাত্যের ঘরানাই আলাদা। আদর্শে, ত্যাগে, তিতিক্ষায় তুলনাহীন।
রাজা হয়েও রাজর্ষি। গৃহী হয়েও ত্যাগী। রাজনীতির এই স্বাভাবিক স্বভাবটিই এখন হৃত। দুষ্ট
রাজনীতিকদের কারসাজিতে রাজনীতি এখন ক্ষমতাভোগের কারখানা। রাজনীতিকরা এখন স্রেফ কারবারী।
রাজনীতিও গুছিয়ে নেয়ার গৃহস্থালি। রাজনীতিতে নেই সৃষ্টিশীল কোনও উপলব্ধি। নেই জীবনের
মহত্তম অনুভূতি থেকে জন্ম নেয়া এক আদর্শ, যা জাতিকে পথ দেখায়। বর্তমানের রাজনীতিকরা
এই আভিজাত্যের সঙ্গে পরিচিত হতে চাচ্ছেন না। তাই ব্যক্তিকে দোষী করে লাভ কী? রাজনীতির
জগতই অধঃপতিত। যেমন শিখছেন, তেমনই শেখাচ্ছেন। রাজনীতিকদের চাল-চলন, আচার-আচরণ দেখে
আশ্বস্ত হতে পারছে না দেশবাসী। পরিবর্তন প্রয়োজন সর্বাগ্রে। বৈষয়িক উন্নয়নের বান ডেকে
যাবে, এ আশ্বাসে আস্থা রাখা কঠিন। তাই বাস্তব উন্নয়নেই সাধারণ মানুষ থাকে সন্তুষ্ট।
তারা চায় শান্তি। শান্ত পরিবেশ। ব্যক্তির শাসন নয়। আদর্শের শাসন। রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায়
আইনের শাসন। চায় রাজনীতিতে আভিজাত্যের আগমন। প্রকৃত পরিবর্তনের পরিকাঠামো গড়ে তুলতে
এখন বাঙালি জাতীয়তা ও আভিজাত্যের প্রয়োজন সবচেয়ে
বেশি।
বাংলাদেশের
রাজনৈতিক দৃশ্যপটে নব্য রাজাকাররা মানুষের স্বাধীনতা হরণ করে নিষ্ঠুর পেশী শক্তির আচ্ছাদনে
এ দেশের মানুষকে সুপরিকল্পিত এক হীরক রাজ্যের অধিবাসী বানাতে উদ্যত। আমরা ১৬ কোটি মানুষ
এখন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এক নব্য ক্রীতদাসে
রূপান্তরিত হচ্ছি। এদের ইচ্ছা অনিচ্ছাই এখন ১৬ কোটি মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা। এর বিরুদ্ধচারিতা
মানেই দেহ থেকে মুন্ডু বিচ্ছিন্ন।
রাজনৈতিক
উচ্চাভিলাসের জন্যে কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থ অর্জনের জন্য কা-জ্ঞানহীন কর্মকান্ডের এরূপ
লীলাক্ষেত্র বিশ্বের অন্যকোথাও আছে কিনা জানা নেই। মানুষের জীবনের কোন মূল্য নেই, নেই
মানুষের ইচ্ছা অভিলাসের কোন মূল্য। সৎচিন্তা, সুবচন, সমবেদনা, সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতার
মত শব্দমালা হয়েছে বিসর্জিত। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এক চরমহীনমন্যতা বোধে আচ্ছন্ন।
কারও সৎ ও সুন্দর পরামর্শ গ্রহণ করাকেও যেন তারা আজকাল আত্মসম্মান বিনষ্টকারী বিষয়
বলে মনে করেন। যার জন্যে দেখা যাচ্ছে দেশের হাতে গোনা সুশিক্ষিত বিশিষ্ট চিন্তাবিদদের
পরামর্শকেও তারা হেয় করছেন অনায়াসে। রাজনৈতিক কর্ণধারগণ তাই এখন বাতাসের বিরুদ্ধে অসি
চালনা করছেন। আর সেজন্যেই দেশের এই করুণ অবস্থা। আর দেশের ১৬ কোটি মানুষের অবস্থা এখন
করুণ থেকে করুণতর।
এই
উপমহাদেশে এবং এর আশেপাশের অনেক দেশেই সরকারি ও বিরোধীদলের মধ্যে ক্ষমতার সংঘাত হয়েছে
এবং এখনও হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের মত নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা বিনষ্ট করার মত
ঘটনা সে সব দেশে ঘটেছে বলে দেখা যায় না। আমাদের প্রতিবেশী দেশ মায়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান
কিংবা সুবৃহৎ দেশ ভারতেও সরকার ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে লড়াই হতে দেখা গেছে কিন্তু কোন
অবস্থাতেই এসব দেশে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে স্থবির, ধ্বংস বা বিনষ্ট করতে
কাউকে দেখা যায়নি। দেখা যায়নি সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রার উপর সামান্যতম আঘাত হানতে।
এসব ব্যাপারে আমরাই এক অনন্য নজির স্থাপন করে চলেছি।
যে
দেশে খাদ্যাভাব সব সময়েই বিদ্যমান, যেদেশে জনগোষ্ঠীর বৃহৎ অংশই বেকার সেদেশে এ ধরনের
হিংসাপ্রসূত বিনাশী রাজনীতি কার কল্যাণে পরিচালিত? সাধারণ মানুষের কি লাভ এবং কি কল্যাণ
হচ্ছে এই রাজনীতি থেকে? শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রাসাদের আয়েশী কক্ষে বসবাসরত রাজনীতির
কর্ণধারগণের এ কথা বুঝবার ক্ষমতা স্রষ্টা সম্ভবতঃ বিনষ্ট করে রেখেছেন! এখন অবস্থা এমন
পর্যায়ে উপনীত যে, আরও কিছুদিন এই নৈরাজ্য চলতে থাকলে দেশে বহু লোক অকালে মৃত্যুবরণ
করবে। দেশে তারই আলামত সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। সারাদেশে নিশ্চিত আয়ের পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ায়
দৈন্য দশায় নিপতিত হচ্ছে হাজার হাজার শ্রমিক পরিবার। এদিকে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার
সিংহভাগ অর্জনকারী গার্মেন্টস শিল্পের অবস্থাও করুণ। জ্বালাও পোড়াও আর শ্রমিক অসন্তুষে ক্রমেই দুর্বল
হয়ে পড়ছে পোষাক শিল্প । পোষাক শিল্পকে রক্ষা করতেই হবে কিন্তু দুঃখজনক যে রাজনৈতিক
নেতৃবৃন্দকে এ ব্যাপারে মোটেই সহানুভূতিশীল হতে দেখা যাচ্ছে না।
বিরোধী
দলগুলো সন্ত্রাস ও হরতালে দেশের অর্থনীতির মাজা এমনভাবে মচ্কে দিয়েছে। দেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করলেও সাধারণ মানুষের
দুঃখ কষ্ট সহ্যের সমস্ত সীমা অতিক্রম করে গেছে। সরকারী বা বিরোধী দলের রাজনীতিকদের
কোন চিন্তা বা কার্যক্রম নেই এ বিষয়ে, দেশ পুড়ছে পুড়ুক, সেই আগুন যেন রাজনীতিকদের বা
তাদের নেতাদের নিবাসের ধারেকাছে না আসতে পারে। লোক মরছে মরুক যেন ওই মৃত্যুর শীতল স্পর্শ
নেতা-নেত্রীদের আপনজনকে তাড়া না করে। কি অদ্ভুত স্বার্থ লোলুপতা।
দেশের
সাধারণ মানুষকে মরতে হচ্ছে দেদার, সইতে হচ্ছে নির্যাতন নিপীড়ন আর অত্যাচার। এর জবাবদিহিতা
এদেশের মানুষ রাজনীতিকদের কাছে অবশ্যই চাইবে। চারদিকে পেশীশক্তি ঘিরে আছে বলে অনেক
রাজনীতিক চিন্তা করছেন মহা নিরাপদে আছেন। নিরাপদ বা নিরাপত্তা এসব শব্দমালা সব সময়েই
আপ্তগরজী, পিচ্ছিল এবং ক্ষণস্থায়ী।
রাজনীতিক
বা রাজনীতিজীবী যারা তারা একযোগে সবাই আজ দেশের বর্তমান অবস্থার জন্যে সমানভাবে দায়ী।
এদের মধ্যে দেশপ্রেম, মানবপ্রেম ও সমাজ প্রেমের যে নিদারুণ ঘাটতি রয়েছে তারা এ কথা
চিৎকার করে অস্বীকারের চেষ্টা করলেও সাধারণ মানুষ তা মানবে না। কেননা রাজনীতির নামে,
ক্ষমতার লড়াইয়ের নামে এসব সাধারণ মানুষের জীবনে দুঃখ, কষ্ট, হতাশা, বিভ্রান্তি নির্যাতন
নিপীড়নের মাধ্যমে রাজনীতিজীবীরা যে রাজনৈতিক পৈশাচিক কর্মকান্ডে
নেশাগ্রস্থ এদেশের
মানুষ তা জানে। সাধারণ মানুষের কল্যাণে বা তাদের সার্বিক সামাজিক অর্থনৈতিক স্বার্থে
রাজনীতিক বা রাজনীতিজীবীদের রাজনীতির উদ্দেশ্য ও কর্মকান্ড পরিচালিত হলে কোথায় সেই উদ্দেশ্য
ও লক্ষ্য? তাহলে দেশের আজ এ হাল কেন? রাজনীতিকরা ক্ষমতার লড়াইয়ে ময়দান কাঁপিয়ে তুলতে
সক্ষম হলেও দেশের মানুষ স্বস্তি দিতে পারে নি। রাজনীতির লড়াই সাধারণ মানুষের জীবনকে
তছনছ করে দিচ্ছে। চোখের সামনে এখন এক শংকিত ভবিষ্যৎ।
গণতান্ত্রিক
ব্যবস্থাপনাতেই দেশের কল্যাণ তথা দেশের মানুষের কল্যাণ। এই আপ্ত বাক্যটি রাজনীতির মূল
কথা হওয়া উচিত। পরমতসহিষ্ণুতাকে তাই অগ্রাধিকার প্রদান নেতাদের এই মুহূর্তের অবশ্য
করণীয় কাজ। হিংসা জন্ম দেয় প্রতিহিংসার। আজ একদলের কর্মী অন্যদলের লোকের বাড়িতে আগুন
লাগালে কাল যে তার বাড়িতেও আগুন লাগবে না সে নিশ্চয়তা কোথায়! রাজনৈতিক হিংসার বশবর্তী
হয়ে অন্যদলের লোকদের প্রাণ সংহারে ব্রতী হলে কাল যে সে দলেরই লোক মারা পড়বে না সেটাই
বা কি করে নিশ্চিত হওয়া যায়। সে জন্যেই সংবরণের কথা ভাবতে হবে। নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে
কোন মঙ্গল আসতে পারে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন