মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৩

বাঙালি চেতনার জাগরণ চাই চরম সংকটে



সময়ের সাফ কথা ....
বাঙালি চেতনার জাগরণ চাই চরম সংকটে

সংলাপ ॥ সারা বিশ্বে বাঙালি জাতি অত্যুজ্জ্বল তার গৌরবময় স্বাতন্ত্রে। প্রত্যেক জাতিরই আছে নিজস্ব সংস্কৃতি, যার পুস্পিত শাখায় প্রস্ফুটিত হয় সে জাতির স্বকীয় চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা। মাতৃভাষাতেই প্রবাহিত হয় সত্তার সলিল ধারা। স্বভাবতঃ তাই সংস্কৃতি হয়ে ওঠে জাতির প্রাণের সম্পদ, অচ্ছেদ্য হৃদ-স্পন্দন। আর তাই কখনও যদি কেউ সে হৃদ-স্পন্দনে ধর্মের নামে যমের কালো থাবা বসাতে চায় কিংবা প্রাণের সম্পদ জবর দখল করতে চায় তখনই অস্তিত্বের ভিত্তি ঠিক রাখতে সুদৃঢ় হয়ে ওঠে উৎসর্গিত প্রাণ। এই সত্য প্রমাণ করেছে একমাত্র বাঙালি জাতি সমগ্র বিশ্বের মধ্যে। নিঃসঙ্কোচে দূরন্ত সাহসে রক্তের বিনিময়ে সুরক্ষিত করেছে তার ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। আমাদের একুশ, একাত্তর বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে বাঙালির সত্যিকারের রূপ। তবু বার বার আঘাত আসে বাঙালি জাতি সত্তায়। এখন প্রশ্ন  ওঠেছে - ‘ধর্মীয় চেতনা, না-কি জাতীয় চেতনা, কোন্‌টা বড়?’ এ দুয়ের কোন্‌ সরোবরে স্নান করে সত্তাকে সজীব রাখতে হবে?
নির্বাচন ও রাজাকার নির্মূলের দৃঢ় প্রত্যয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে বাঙালি জাতি। দ্বিমুখী এই পথের সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে বাঙালি হয়ে উঠছে সাংস্কৃতিক বিপ্লব প্রত্যয়ী। অপরদিকে নির্বাচনের জন্য ক্ষমতার নির্লজ্জ লড়াই জনজীবনে প্রভাব ফেলছে। পক্ষ-বিপক্ষের ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় সাধারণ বাঙালি হয়ে পড়ছে আতঙ্কিত। কিন্তু এই বিভ্রান্তকর পরিবেশ কি বাঙালির জীবনে নতুন? এর চেয়ে ভয়ঙ্কর সব পরিস্থিতির মধ্যে জাতিসত্তা বোধে বাঙালি ছিল অকুন্ঠ স্বতঃস্ফূর্ত। ’৫২র পর থেকে বাঙালির জীবনে এসেছে একের পর এক আন্দোলন। বাঙালির জীবন প্রবাহ বরাবরই বন্ধুর। নিশ্চয়ই এবারও নিজ সংস্কৃতির চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠবে বাঙালি জাতিসত্তা। বোমাবাজদের হাত করে সন্ত্রাস সৃষ্টি করা যায়, নিরীহ মানুষকে ত্রাসের দাস বানানো যায় কিছুকালের জন্যে কিন্তু সর্বকালের জন্যে নয়। বাঙালি জেগে উঠবে এবং এসবের বিরুদ্ধে অবশ্যই সঙ্ঘবদ্ধ হবে।  শাশ্বত বিদ্রোহী মুক্তিপাগল বাঙালি চেতনার জাগরণ ঘটবে চরম সংকটে। তবেই আসবে সম্যক সমাধান।
এখন সামপ্রদায়িকতা এবং ধর্মান্ধমুক্ত বাংলাদেশ গড়াই হলো বাঙালি জাতির কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। জাতীয় চেতনাকে ছাপিয়ে ধর্মীয় চেতনা কখনই প্রাধান্য পেতে পারে না। আজ সমগ্র বিশ্বের মানচিত্রে একবার চোখ ফিরালেই এর সত্যতা প্রমাণিত হয়। পূর্ব জার্মান ও পশ্চিম জার্মান তার বড় প্রমাণ। এই দুই দেশ জাতীয় সত্তার অভিন্নতার কারণেই দীর্ঘদিন পরে হলেও উপড়ে ফেলেছে বিভক্তির প্রাচীর। আগামীতে দক্ষিণ কোরিয়া এবং উত্তর কোরিয়াও যে একত্রীভূত হবে ব্যাপারটি নিশ্চিত। কেননা, যে জাতির মধ্যে তার জাতীয়তাবাদ প্রবলভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত, সে জাতি কখনই বিভক্ত থাকতে পারে না। এর সত্যতা পাওয়া যায় ১৯৮৪ সালে সাংবাদিক সম্মেলনে সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্যে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি সাংবাদিকদের বলে ছিলেন First we are Arab, Second Muslim.
পাক ভারতে দ্বিজাতি তত্ত্বের মূলে ছিল ধর্মীয় জাত তত্ত্বের ঠুন্‌কো দ্বন্দ্ব। এই তত্ত্বকে পুঁজি করেই ভারত পাকিস্তানের সৃষ্টি। কিন্তু এই ঠুন্‌কো বন্ধনে বেশীদিন আবদ্ধ থাকেনি বাঙালি জাতি। দুই ভিন্ন জাতি সত্তার একত্রে অবস্থান কোনদিনই সম্ভবপর নয়। ফলে স্বকীয় জাতীয় সত্তাকে অক্ষুন্ন রাখার তাগিদেই অবধারিতভাবে বাঙালি ছিনিয়ে আনল স্বাধীনতা। এরপরে আর জাতীয়বাদী চেতনা ও ধর্মীয় চেতনার মাঝে বিতর্কের অবকাশ থাকে না, থাকা উচিত নয়। ধর্মীয় অনুশাসন নিজেকে চিনতে শেখায়। কিন্তু মানুষের জীবন চলার পথে ধর্মান্ধতায় মানুষের সাংস্কৃতিক সত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে তার স্বজাতীয়তাবোধ তাকে উজ্জীবিত করবেই। পৃথিবীতে কোথাও ধর্মীয় জাততত্ত্বের বন্ধনে কোন জাতি সৃষ্টি হয়নি, হবেও না। তাহলে পৃথিবীর সমগ্র মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, হিন্দু এক একটি ধর্মাবলম্বী জাতিতে বিভক্ত হয়ে অবস্থান করতো। মুসলমান- মুসলমানে থাকতো না কোন যুদ্ধ, হানাহানি, বিরোধ বরং এক দেশে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী নির্বিঘ্নে বসবাস করছে তাদের নিজস্ব জাতীয়তার অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে। চীন ও জাপানে একই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বাস করলেও তারা বিভক্ত জাতীয়তার ভিত্তিতেই।
চীনের বৌদ্ধরা চীনা এবং জাপানী বৌদ্ধরা ‘জাপানী ভাবতেই গর্ববোধ করে। ভারতে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী বাস করে। অথচ তারা নিজেদের ধর্মীয় ভিত্তিতে নয়, জাতীয়তার ভিত্তিতেই ভারতীয় হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। সুতরাং সব কিছুর উর্ধ্বে জাতীয়তা। এই সহজ বোধ কি সর্বসাধারণের মাঝে সুপ্রতিষ্ঠিত? হলে কেন বাঙালি জাতি এই পরীক্ষায় উতরাতে পারছে না? বর্তমানে দেশের সংঘাতময় ম্লান চিত্র তো সে কথাই প্রমাণ করে দিচ্ছে। কাদের দায়িত্ব এই বোধ সম্পর্কে সাধারণ জনগণকে সচেতন করে তোলা? নিঃসন্দেহে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবি মহলের, কিন্তু এই বুদ্ধিজীবি মহলও একই দ্বন্দ্বের ঘূর্ণিপাকে আবদ্ধ। নিজেরাই যখন কাদাজলে হাবুডুবু খেয়ে চলেছে তখন অন্যকে পরিত্রাণের পথ তারা কেমন করে বাতলে দেবেন?
বাঙালিকে সর্বাগ্রে হয়ে উঠতে হবে যথাযথ বাঙালি । নতুবা সত্যিকার মূল্যবোধের বিকাশ কোনদিনই সম্ভব নয়। যার অভাবেই আজ বাঙালির এই চরম দূরাবস্থা। আবারও যে কোন সময় হানা দিতে পারে তথাকথিত ধর্মজীবী ধর্মান্ধ সওদাগরের সর্বগ্রাসী দল। সময় থাকতে তাই সতর্ক হতে হবে এবং সক্রিয়ভাবে তৎপর হতে হবে জাতীয় মূল্যবোধে উদ্দীপ্ত এক মহান বাঙালি জাতি গঠনে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন