শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৩

রাজনীতির জন্য ভোট বনাম ভোটের জন্য রাজনীতি



রাজনীতির জন্য ভোট বনাম
ভোটের জন্য রাজনীতি

সাদী যখন কোন রাজনৈতিক দল বা রাজনীতিক নিজ দলের নীতি আদর্শের আলোকে নির্বাচন-পূর্ববর্তী জনগণের ভোটাধিকারের জন্য আবেদন করেন, তাকে বলা হয়রাজনীতির জন্য ভোট অপরদিকে কোন রাজনৈতিক দল বা রাজনীতিক দলের নিজের নীতি আ্লদর্শের জলাঞ্জলি দিয়ে শুধু ভোট প্রাপ্তির আশায় যখন কোন দল বা গোষ্ঠীকে সমর্থন করেন, তাকে বলা হয়ভোটের জন্য রাজনীতি এরূপ সমর্থনের মূল উদ্দেশ্য নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া
আমাদের দেশে ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের প্রতি জনসমর্থন প্রতিদ্বন্দ্বী অন্যান্য দলের তুলনায় অনেক বেশি থাকায় তখন দল দলের নেতারা রাজনীতির জন্য ভোট- মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে জনগণের কাছে ভোট প্রার্থনা করে অভূতপূর্ব বিজয় অর্জন করেছিলেন
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী জামায়াতে ইসলামের রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল এবং ১৯৭৩ এর নির্বাচনে দেখা গেছে ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামের শতভাগ ভোট তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) ভোটবাক্সে পড়েছিল ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে দেখা যায়, বিএনপি দু-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল এবং সে নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনকারী মুসলিম লীগ জামায়াতে ইসলামের সমর্থনপুষ্ট ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ ২০টি আসন লাভ করেছিল নির্বাচনে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামের অস্তিত্ব ছিল না
১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন এবং বাংলাদেশ অভ্যুদয় পরবর্তী ১৯৭৩ ১৯৭৯-এর সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী বিজিত দলগুলো আক্ষরিক অর্থেরাজনীতির জন্য ভোট’-কে মুখ্য বিবেচনায় স্ব-স্ব দলের নীতি আদর্শ জনগণের সামনে উপস্থাপন করে ভোট প্রার্থনা করেছিল
১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১৫৩টি আওয়ামী লীগ ৭৬টি আসন লাভ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সর্বপ্রথম জামায়াতে ইসলামী নিজ দলীয় পরিচয়ে তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ১০টি আসন লাভ করে চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি জামায়াতে ইসলামী অংশগ্রহণ না করায় নির্বাচন অনেকটা একতরফা ছিল এবং জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনে সংসদ গঠিত না হওয়ায় নির্ধারিত মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার অনেক আগেই সংসদ অবলুপ্ত করতে হয়েছিল
১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত ৫ম, ৭ম, ৮ম ৯ম সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যথাক্রমে ৮৮, ১৪৬, ৬২ ২৩০টি আসন পেয়েছিল উপরোক্ত চারটি নির্বাচনে বিএনপি যথাক্রমে ১৪০, ১১৬, ১৯৩ ৩০টি আসন পেয়েছিল চারটি নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রাপ্ত আসন সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩৫, ৩২, ১৪ ২৭ অপরদিকে ওই চারটি নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর প্রাপ্ত আসন সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৮, ০৩, ১৭ ০২
১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত ৫ম, ৭ম, ৮ম ৯ম সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মোট প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৩০.০৮, ৩৭.৪৪, ৪০.১৩ ৪৮.০৪ ভাগ পেয়েছিল
উপরোক্ত চারটি নির্বাচনে বিএনপির ভোট প্রাপ্তির হার ছিল ৩০.৮১, ৩৩.৬০, ৪০.৯৭ ৩২.৫০ শতাংশ চারটি নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভোট প্রাপ্তির হার ছিল ১১.৯২, ১৬.৪০, ০৭.২৫ ০৭.০৪ শতাংশ ওই চারটি নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর ভোট প্রাপ্তির হার ছিল ১২.১৩, ০৮.৬১, ০৪.২৮ ০৪.৭০ শতাংশ
আওয়ামী লীগ বিএনপির গঠনতন্ত্র, ঘোষণাপত্র নির্বাচনী ইশতেহারের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই জামায়াতের বৈপরীত্য পরিলক্ষিত হয় কিন্তু উভয় দলকে দেখা গেছে, নির্বাচনে নিজেদের বিজয় নিশ্চিত করার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জামায়াতের সঙ্গে একটি সমঝোতায় উপনীত হয়েছে শুধু নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করে ক্ষমতাসীন হওয়ার জন্য ধরনের সমঝোতাভোটের জন্য রাজনীতিহিসেবে বিবেচিত
নির্বাচন কিংবা ভোটের রাজনীতির সঙ্গে নীতিগত রাজনীতির কোনো বিভেদ থাকার কথা নয় কিন্তু রাজনীতি যখন হয়ে উঠে শুধু ভোটের জন্য নিবেদিত এবং নিয়ন্ত্রিত, তখন সেই রাজনীতিতে নীতির জায়গাটি ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কঠিন রোগটি অনেক আগেই ঢুকে পড়েছে ঠিক কখন ঢুকে পড়েছে তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন হলেও বাংলাদেশের রাজনীতি বর্তমানে ভোটকেন্দ্রিক রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়
বাংলাদেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সেই দলটির নীতিগত অবস্থান হল তারা স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা বা অসামপ্রদায়িকতা এবং গণতন্ত্রের চেতনাবাহক একটি রাজনৈতিক দল স্বাধীনতার নেতৃত্ব প্রদান থেকে শুরু করে সব প্রগতিশীল আন্দোলনের ইতিহাস দলটির রয়েছে কিন্তু আওয়ামী লীগও ভোটের রাজনীতি করে মৌলবাদী সংগঠনের এবং ধর্মীয় অনুভূতির ভোটারের সমর্থন লাভের আশায় আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে বহাল রাখে সরকার একসময় গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে; আবার যখন দেখে গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে মৌলবাদী কিছু সংগঠন, তখন সরকার ভোটের হিসাবকে বেশি মূল্য দিয়ে গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় মৌলবাদীদের খুশি করতে সরকার প্রমাণ সংগ্রহের আগেই গ্রেফতার করে তিন ব্লগারকে
বিএনপি ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতির একটি উর্বর ক্ষেত্র ধর্মীয় রাজনীতির অপর দল জামায়াতে ইসলামী তাদের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সঙ্গী বিএনপি কখনও কখনও নিজেদের মুক্তিযোদ্ধাদের দল বলে ঘোষণা করে তাদের দলেও মুক্তিযোদ্ধা নেতাকর্মী আছে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ধর্মের কোনো সংঘাত নেই কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীর মধ্যে একটি পার্থক্য আছে নিশ্চিতভাবেই সে ক্ষেত্রে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা থাকা দল বিএনপি শুধু ভোটের হিসাব করেই জামায়াতের মতো কট্টর মৌলবাদী মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট বেঁধে রাজনীতি করছে জামায়াত-শিবিরের তান্ডব এবং সহিংস কার্যকলাপ রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্কের সৃষ্টি করলেও শুধু ভোটের হিসাব করতে গিয়ে বিএনপি জামায়াতকে তার জোটে ধরে রাখছে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা আর সেই জিয়াউর রহমানের দলের অন্যতম প্রধান শরিক দল মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতে ইসলামী
ভোটের ওপর জোর দিতে গিয়েই বিএনপি জোটের সমর্থক নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী জামায়াতের মতো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দলের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে রাজনীতি করছেন নীতির রাজনীতি আজ দেশে ভোটের রাজনীতির কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছে হয়তো একদিন এর পরিবর্তন আসবে তবে সেই দিনটি না আসা পর্যন্ত আমাদের যে কতদিন অপেক্ষা করতে হবে তা কে বলতে পারে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি আজ রাজনীতি করে শুধুই যেন ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ক্ষমতার বাইরে থেকে রাজনীতি করার মানসিকতা আজ তারা অনেক পেছনে ফেলে রেখে এসেছে কীভাবে, কী পদ্ধতিতে, কী চাতুর্যে বেশি ভোট পাওয়া যাবে, কার সঙ্গে থাকলে সরকার গঠন করার মতো ভোট পাওয়া যাবে আজ যেন তা- রাজনীতির মূলমন্ত্র হয়ে গেছে নীতি এবং দলের আদর্শ সেখানে গৌণ অবস্থানে রয়েছে ক্ষমতা চাই--চাই আর সেই ক্ষমতা পেতে যদি বিপরীত মেরুর কোনো রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে আঁতাত করতে হয়, যদি নীতি বিসর্জন দিয়ে বিপরীত মেরুর কারও সঙ্গে হাত মেলাতে হয়, তবে তা ঠিক আছে
জনগণের সেবা করার যে রাজনীতি তাতে সরকার গঠন করার বিষয়টি মুখ্য নয় বিরোধী দলে থেকেও জনগণের স্বার্থে রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালনা করা যায় কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুই প্রধান দল শুধু ক্ষমতাই চায়- বিরোধী আসনে বসতে চায় না ভোটের হিসাব করতে গিয়ে দেশের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দল ক্রমশ নীতির রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে মিথ্যাই হোক, কৃত্রিমভাবেই হোক অথবা ছলনা করেই হোক, রাজনৈতিক দলের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্ষমতা গ্রহণ অর্থাৎ ভোটের প্রাপ্তি তাই ভোটের স্বার্থে সবকিছুই করা যেতে পারে সেখানে নীতিকে টেনে এনে তারা ঝামেলা পোহাতে চায় না নীতি ধরে রেখে বিরোধী আসনে বসার চেয়ে তারা বরং ভোটের গতি দেখে নীতিতে ছাড় দিয়ে ক্ষমতায় বসতে চায় ক্ষমতার রাজনীতি নিশ্চিত করতে মরিয়া হয়ে তারা শুধু দলীয় স্বার্থের কথাই চিন্তা করে, জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করে না
বাংলাদেশের রাজনীতিতে হেফাজতে ইসলাম নামক একটি অরাজনৈতিক সংগঠন সম্প্রতি ঢাকায় নানামুখী প্রতিকূলতা সত্ত্বেও স্মরণকালের বৃহত্তম গণসমাবেশ করায় সংগঠনটির জনসমর্থনকে মাথায় রেখে নতুন করে হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, আগামী সংসদ নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হলে সম্মিলিতভাবে জামায়াত হেফাজতে ইসলামের সমর্থন যে কোন দলের বিজয় নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে আর কারণেই বর্তমানে হেফাজতে ইসলামকে নিয়ে নতুন ভাবনা হেফাজতে ইসলামের সমর্থন পাওয়ার দৌড়ে আওয়ামী লীগ বিএনপির সঙ্গে জাতীয় পার্টিও পিছিয়ে নেই হেফাজতে ইসলাম যে ১৩ দফা সরকারের কাছে দিয়েছে, তার সঙ্গে আওয়ামী লীগ, বিএনপি জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক আদর্শগত কোন মিল নেই কিন্তু মিল এখানে গৌণ, মুখ্য হচ্ছে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন তাই অতীতের মতো আবারও দেখা গেল রাজনীতির জন্য ভোট নয়, ভোটের জন্য রাজনীতি নীতির রাজনীতি জয়ী না হওয়া পর্যন্ত আমাদের দেশের রাজনীতির চেহারা বদলাবে না শুধু নীতি বিসর্জিত ভোটের রাজনীতির কারণে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিতে ক্রমশ প্রকৃত রাজনীতিকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে এবং অর্থ-সম্পদশালী ব্যবসায়ী শ্রেণীর হাতে রাজনীতি বন্দি থাকছে আর ভোটের জন্য রাজনীতির ধারা অব্যাহত থাকলে দেশে সুষ্ঠু রাজনীতির বিকাশ ঘটবে কি-না, সে সংশয় থেকেই যায়

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন