মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষায়
মাঠে নামার সময় এসেছে
সংলাপ ॥ বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে মহত্তম ও গৌরবের অর্জন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় যে স্বপ্ন বা আকাঙ্খা কাজ করেছে তা-ই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। কি ছিল সে চেতনা? আমাদের প্রাথমিক স্বপ্ন ছিল আমরা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হব। আমাদের পরবর্তী স্বপ্ন ছিল আমরা আমাদের রক্তার্জিত দেশটিকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করব। সেই সোনার বাংলায় প্রতিটি নাগরিক হবে সোনার মানুষ, আর সামষ্টিকভাবে জাতিটি হবে সোনার জাতি। সেখানে প্রত্যেক বাঙালি সব ধরনের বৈষম্য, বঞ্চনা, অন্যায়, অবিচার, শোষণ, ত্রাস, অগণতান্ত্রিকতা, সাম্প্রদায়িকতা, আধিপত্যকামিতা বা ক্ষমতান্ধতা থেকে মুক্ত হয়ে এমন এক নৈয়ায়িক রাষ্ট্রের নাগরিক হবে, যেখানে ধর্ম-বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে একটি সমতাভিত্তিক শান্তি সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। মুক্তিযুদ্ধের অসামপ্রদায়িক ও শোষণ মুক্তির চেতনাকে ধরে রাখার জন্য আমরা একটি অসাধারণ দলিল প্রণয়ন করেছিলাম। সেই দলিলটিরই নাম
‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’। অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে পুষ্ট করে তোলার জন্য, রাষ্ট্রের জন্য আমরা চারটি মূলনীতি বিধিবদ্ধ করেছিলাম। জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র- এই চারটি মূলনীতিই ছিল আমাদের রাষ্ট্রের স্তম্ভ।
আমাদের বিজয়ের চার বছর যেতে না যেতেই বিজয়ের সুফলটিকে স্বাধীনতার শত্রুরা অপহরণ করে নিয়ে যায়। রাষ্ট্রের স্থপতিকে তারা স্বপরিবারে হত্যা করে। স্বাধীনতার পক্ষের অনেক নেতাকে কারাবন্দি করে। বন্দি অবস্থাতেই হত্যা করে আমাদের আরও চারজন নেতাকে। এর পরপরই আমাদের সংবিধান ও দলিলটিকে প্রায় পুরোপুরি নষ্ট করে দেয় তারা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্থলে এক উদ্ভট জাতীয়তাবাদের আমদানি করে। নাম দেয় তারা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ।
আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতির অন্যতম ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। আমাদের উদ্দীষ্ট লক্ষ্য ছিল সেক্যুলারিজম। তাই ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে এও বলা হয়েছিল যে, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা হচ্ছে রাষ্ট্র কোন ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করবে না। কিন্তু স্বাধীনতার শত্রুরা ধর্মনিরপেক্ষতাকে পুরোপুরি ধর্মহীনতা বলে অপপ্রচার চালায়। সেই অপপ্রচারে অনেক মানুষকেই তারা বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়। তাদের বক্তব্য ছিল - যে দেশের নাগরিকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী, সেই বিশ্বাসকেই ধ্বসিয়ে দেবার জন্য ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি আমদানি করা হয়েছে। এ রকম অপপ্রচারের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতার শত্রুরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বলে ঘোষণা করে। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় চেতনা লুট হয়ে যায়। বাঙালি জাতির হাজার বছরের লালিত চেতনার স্থলে পাকিস্তানি চেতনাকে নতুনভাবে ফিরিয়ে আনা হয়। এখন ধর্মনিরপেক্ষতা এবং রাষ্ট্রধর্ম উভয়ই সংবিধানে আছে। তবে বদলে দেয়া হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতার তাৎপর্য। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে এখন বুঝানো হচ্ছে সব ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা। অন্যদিকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকায় ইসলাম নিয়ে রাজনীতির সুযোগ অবারিত হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক ইসলামের কূট কৌশলের প্যাঁচে পড়ে আমরা হারাতে বসেছি নিজস্ব গৌরব ও শক্তি। রাজনৈতিক ইসলাম বাঙালি জাতি সত্তাকে ধ্বংস করতে চাচ্ছে। দেশের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমানকে আবার নতুন করে মুসলমান বানানোর প্রচেষ্টা চলছে। বস্তাপঁচা শারিয়া গেলানোর সার্বিক প্রচেষ্টা চালিয়ে দেশের গরীব মানুষ ও অশিক্ষিত লোকদেরকে উগ্রবাদী ও ধর্মান্ধ বানানোর নেশায় তথাকথিত রাজনৈতিক ইসলামপন্থীদের ঘুম নেই। তারা ইসলামের নামে তথাকথিত জেহাদী শিক্ষা দিয়ে চলেছে যার সাথে নবী মুহাম্মদ (সঃ)-এঁর ইসলাম এর জেহাদী শিক্ষার কোন মিল নেই। নবী মুহাম্মদ (সঃ)-এঁর সময় কোথায় ছিল শারিয়া? কোথায় ছিলো ইসলামী রাষ্ট্র? এমনকি আজকের পৃথিবীতে কোথাও কি কোন ইসলামী রাষ্ট্র আছে বলে কেউ প্রমাণ করতে পারবেন? সবই যুগে যুগে তৈরি করা হয়েছে ধর্মের নামে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী দ্বারা শোষণ এবং শাসন করার জন্য। তাই বাঙালির সামনে এসেছে সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রশ্ন। তিন হাজার বছরের শান্তির ধারক বাহক বাঙালি জাতি যারা নিজেদের শান্তিকে শান্তিময় করে রাখার জন্য নবী মুহাম্মদ (সঃ)-এঁর (ইসলাম) শান্তিকে আঁকড়ে ধরে এক হাজার বছর শান্তিতে বসবাস করে আসছে সত্য ধর্মকে আঁকড়ে ধরে, সেখানে তথাকথিত রাজনৈতিক ইসলাম তৈরি করে ধর্মান্ধরা বাংলা ও বাঙালির বিরুদ্ধে একের পর এক ষড়যন্ত্র করে চলেছে।
সময় আসছে দেশবাসীকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা আল্লাহ্ ও মুহাম্মদ (সঃ)-এঁর ইসলাম ধারণ-লালন-পালন করবে নাকি ধর্মান্ধ মানুষের গড়া ইসলাম মানবে। অপরদিকে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের উর্দ্ধে উঠতে না পারায় এবং মুক্তিযোদ্ধা বাঙালি জাতিকে দলীয়করণের নেশায় মত্ত হওয়ার ফলে মুক্তিযোদ্ধারা আজ বহুধা বিভক্ত। শুধু তাই নয়,
একদল মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধাপরাধী ধর্মান্ধদের লেজুড়বৃত্তি করছে শুধুমাত্র ব্যক্তিস্বার্থ ও ক্ষমতার জন্য!
এখন সময় এসেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে মাঠে নামার, বাঙালি জাতির বাঙালিত্ব নিয়ে মাঠে নামার। আবার সেই মুক্তিযুদ্ধের জীবনীশক্তি জয়ধ্বনি প্রতিটি বাঙালির কন্ঠে প্রতিধ্বনিত হতে হবে এবং আওয়াজ তুলতে হবে - জয় বাংলা - জয় বাংলা - জয় বাংলা। যারা তথাকথিত ধর্মের নামে একে অসম্মান করতে চায় তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার সময় এসেছে এবং প্রতিহত করার সময় এসেছে যে জয় বাংলার শান্তি (ইসলাম) আর নবী মুহাম্মদ (সঃ)-এঁর ইসলাম এক ও অভিন্ন যা এদেশের মাটিতে আল্লাহ্র ওলীগণের দ্বারা বীজবপন করা হয়েছিলো এক হাজার বছর আগে। বাংলাদেশে বাঙালি সত্তাই একমাত্র সত্তা যাকে ধারণ-লালন-পালন করতে হবে তবেই নবী মুহাম্মদ (সঃ) এঁর ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে এবং বাঙালি জগৎসভায় মর্যাদাময় আসন পাবে। এতে যদি আমরা অমনোযোগী হই,
তাহলে আমাদের দুঃখ ঘুচবে না,
আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়েই থাকবে। এ কাজটি আমাদের করতেই হবে। এর কোন বিকল্প নেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন