ধন্য
অগ্রহায়ণ মাস
বিফল
জনম তার নাহি যার চাষ
আরিফিন
হক ॥ রাজনৈতিক অস্থিরতায় বড্ড খারাপ সময় পার করছে বাংলাদেশ। ক্ষমতার দ্বানদ্বিকতায়
বিদ্বেষের আগুনে পুড়ছে নিরীহ মানুষ, তবু থেমে থাকে না কিছুই। পাকা ধানের মউ মউ গন্ধে
বিমোহিত দশদিগন্ত। শীতের পরশ আলতো করে গায়ে মাখছে প্রকৃতি। কমছে তাপমাত্রা, কুয়াশার
চাঁদরে মোড়ানো প্রত্যুষের প্রামবাংলা। ভোরের কোমল রোদ, শিশির ভেজা ঘাসের ডগায় যেন মুক্তোর
মেলা। ঝলমল শিশিরের হাসি, লকলকে লাউয়ের ডগায় তারুণ্যের সতেজতা - কানে কানে বলে যায়
এসেছে অগ্রহায়ণ। শৈত্যপ্রবাহও নেই, খরতাপও নেই। মৃদু হিমস্পর্শ প্রাণে শিহরণ জাগায়।
উদাসীন বাতাসে ওড়ে ঝরাপাতা। সন্ধ্যায় বাঁশঝাড়ে পাখির কলকাকলি সৃষ্টি করে ভিন্নমাত্রিক
দ্যোতনা। রাতে মেঘমুক্ত আকাশে জ্যোৎস্নার আলো ঠিকরে পড়ে। প্রাণে প্রাণে দোলে গানের
কলি - ‘ও মা অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে কী দেখেছি মধুর হাসি’।
১৪২০
বঙ্গাব্দের ১ অগ্রহায়ণ, বৃহস্পতিবার। এ দিনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে শুরু হয় উৎসবের
ধুম। রমনার বটমূলে, চারুকলায় বসে নবান্ন উৎসবের বর্ণিল আয়োজন।
ইতিহাস
বলে, অগ্রহায়ণই ছিল বাঙালির বর্ষ গণনার প্রথম মাস। বাংলা বছরের পঞ্জিকায় যে ১২টি মাস
রয়েছে তার মধ্যে ১১টি মাসেরই নামকরণ হয়েছে নক্ষত্রের নামে। 'বৈশাখ' বিশাখা নক্ষত্রের
নামে, 'জ্যৈষ্ঠ' জ্যাষ্ঠা নক্ষত্রের নামে, 'আষাঢ়' আষাঢ়ার নামে এবং এরূপ শ্রাবণ, ভাদ্র,
আশ্বিন, কার্তিক, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র যথাক্রমে শ্রবণা, পূর্বভাদ্রপদা, অশ্বিনী,
কৃত্তিকা, পৌষী, মঘা, ফাল্গুনী ও চিত্রার নামে অঙ্কিত হয়েছে। যে মাসটি নক্ষত্রের নামের
সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, সেটি হচ্ছে অগ্রহায়ণ; আর এই নামটির সঙ্গেই মিশে আছে বাংলার কিছু
ইতিহাস, কিছু স্মৃতি এবং কিছু বিস্মৃত হয়ে যাওয়া তথ্য।
'অগ্র'
শব্দের অর্থ প্রথম, আর 'হায়ণ' শব্দের অর্থ বছর। বছরের প্রথম বা অগ্রে অবস্থান করার
কারণে নক্ষত্রের সঙ্গে সম্পর্কহীন একমাত্র মাসটির নাম হচ্ছে অগ্রহায়ণ। খ্রিস্টপূর্ব
৩০০০ বছর আগে প্রণীত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণের
প্রিয়
মাস হিসেবে অগ্রহায়ণ মাসটির উদ্ধৃতি রয়েছে (১০ম অধ্যায় : ৩৫ নম্বর শ্লোক)।
বাংলার
এই মাস ও ঋতুগুলো যে বহুপূর্বকাল থেকে প্রচলিত, নির্ভরযোগ্য তথ্য মূলত তারই পরিচায়ক।
প্রায় প্রাচীন কাল থেকেই এ অঞ্চলে অগ্রহায়ণের ১ তারিখে নববর্ষের উৎসব পালন করা হতো।
এটি ছিল মূলত কৃষকের উৎসব।
বলা
হয়, সম্রাট আকবরের সময় থেকে 'বৈশাখ' মাস বাংলা বছরের প্রথম মাস হিসেবে যাত্রা শুরু
করেছে। কিন্তু আকবরের অনেক পরে রচিত বাংলা সাহিত্যে, বছরের প্রথম মাস হিসেবে বৈশাখের
উল্লেখ নাই। ঠাকুর পরিবারে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের সূচনা হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে।
পরে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ব্যবস্থা
করেন।
পাকিস্তান
আমলে পূর্ব বাংলায় বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন কেন্দ্রীয় সরকারের বাধার মুখে পড়ে। তারা একে ‘হিন্দুয়ানি’ বলে আখ্যায়িত করে। বাঙালি
পন্ডিতেরা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ প্রমুখের নেতৃত্বে সম্রাট আকবর যে বাংলা সন প্রবর্তন
করেছিলেন, তা স্মরণ করিয়ে বাঙালির নববর্ষকে বাধাগ্রস্ত না করার আহ্বান জানান। পাকিস্তান
সরকার সেই দাবি অগ্রাহ্য করে। এ রকম একটি অবস্থার মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ছায়ানট’
(১৯৬১) নামক আজকের খ্যাতনামা সাংস্কৃতিক সংগঠনটি। এই সংগঠন ১৯৬৭ সাল থেকে রমনার বটমূলে
নিয়মিতভাবে বাঙালি সংস্কৃতির নানা আঙ্গিকে পরিবেশনার মধ্য দিয়ে বর্ণাঢ্যভাবে বাংলা
নববর্ষ উদ্যাপন করতে শুরু করে। সেই নববর্ষ উৎসব প্রতিবছরই বিশাল থেকে বিশালতর হয়ে
এখন বাঙালির সর্ববৃহৎ জাতীয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
ইতিহাসের
চাকা পেছনের দিকে ঘোরে না। বৈশাখ, বছরের প্রথম মাস হয়েছে তো হয়েছে। কিন্তু তাতে ম্লান
হয়নি অগ্রহায়ণের ঐতিহ্য। অগ্রহায়ণের বাঙালি ঐতিহ্যে নতুন মাত্রা যুগ করেছে
বাংলাদেশ হাক্কানী খানকা শরীফ, পহেলা অগ্রহায়ণকে ‘হাক্কানী বর্ষে’র প্রথম দিন ঘোষণা দিয়ে। এরও রয়েছে ইতিহাস
- ভিন্ন মাত্রার। অগ্রহায়ণ মাসেই আবির্ভূত হয়েছিলেন হাক্কানী দর্শনের দুই পথিকৃত সাধক
- সূফী সাধক আবু আলী আক্তার উদ্দিন এবং সূফী সাধক আনোয়ারুল হক। তাঁদের আবির্ভাব স্মরণে
আত্ম-উন্নয়নের মাস হিসেব অগ্রহায়ণের ১ তারিখ থেকে শুরু হয় হাক্কানী বর্ষ। হাক্কানী
বর্ষ দিন-তারিখ গণনার বর্ষ নয়। দিন-তারিখ গণনার বর্ষ হিসেবে সকলের জন্য অনুসরণীয় কোন
নতুন বর্ষপুঞ্জিকা প্রতিষ্ঠিতও করতে চায় না হাক্কানী। যারা আশ্রিত হয় হাক্কানী সাধকের
ছায়াতলে তাদের সাধনার বর্ষ হলো হাক্কানী বর্ষ। অগ্রহায়ণের ১ তারিখে বাংলাদেশ হাক্কানী
খান্কা শরীফের ভক্ত আশেকানগণ নিজের বিচার নিজে করেন বিশেষভাবে। এক বছরের সাধনায় আজ
কী ফসল ঘরে তুললাম? এই মাসে নতুনভাবে মানস জমিন চাষ করে কোন্ ফসলের বীজ বপন করবো?
- এসব নির্ধারণের মাস অগ্রহায়ণ। আত্ম উন্নয়নের সাধনাও এক প্রকারের কৃষি কাজই বটে। ফসল
কাটা ও বীজ বপনের মাস অগ্রহায়ণ। যে যেই বীজ বুনে, যে যতটা যতনের সাথে আগাছা পরিষ্কার
করে, সেচ দেয়, সার দেয় সে ততটা ফসলই ঘরে তোলে। বিফল জনম তার, নাহি যার চাষ। যে মানুষ
জমিনে চাষাবাদ করে না, নতুন বীজ বপন (কর্মসূচী গ্রহণ) করে না, তার জন্ম বৃথা। যে বীজই
বপন করে না, সে ফসল পাবে কোথায়? তাই হাক্কানীতে অগ্রহায়ণের ১ তারিখ অন্য রকম গুরুত্ব
বহন করে। প্রতি বছরই এই দিন উদ্যাপিত হয় বিশেষ মর্যাদায়, নবান্ন, গান, বাঙালি সংস্কৃতির
সবই থাকে কিন্তু সবকিছুর আড়ালে কাজ করে শিকড়ের সন্ধান, নিজেকে আবিষ্কার করার প্রচেষ্টা।
এবার
হাক্কানী বর্ষ উদ্যাপন উদ্বোধন হয় মিরপুর আস্তানা শরীফে। সকাল ৭টা ১ মিনিটে বাঁশির
সুরের মূর্ছনায় স্বাগত জানানো হয় হাক্কানী বর্ষকে। বাঁশি, তবলাসহ দেশীয় যন্ত্র-সঙ্গীত
পরিবেশনের মাধ্যমে শুরু হয় এ উৎসব। সকাল থেকেই অনুষ্ঠান উদ্যাপন করতে মিরপুর আস্তানা
শরীফে জড়ো হন ভক্ত আশেকানরা। তারা দিন ভর নানা আয়োজনে মুগ্ধ থাকেন। নবান্নের সঙ্গীত,
মুর্শিদী গান, হাক্কানী গান পরিবেশন করেন ‘হাক্কানী সাংস্কৃতিক একাডেমী’র শিল্পীবৃন্দ।
গানের পর 'নবান্ন উৎসব'।
বাদ
আসর তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণে শুরু হয় “বাঙালির অগ্রহায়ণ শীর্ষক” হাক্কানী কথন। নতুন
প্রজন্মের হাক্কানীদের কথনে বাঙালির অগ্রহায়ণ চিত্রিত হয় বিচিত্রভাবে। তবে সব কথার
মূলে একই কথার প্রতিধ্বনী - ‘আমি এই অঘ্রানেরে ভালোবাসি বিকেলে এই রঙ!/রক্তের শূন্যতা
রোদের নরম রোম-ঢালু মাঠ/বিবর্ণ বাদামী পাখি/ হলুদ বিচালী'। সবকিছু ছাড়িয়ে শোনা যায়
উদ্দীপ্ত আওয়াজ - ‘আমি বাঙালি, আমাকে বাঁচতে হবে বাঙালি সংস্কৃতির ধারক বাহক হয়ে’।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন