মঙ্গলবার, ২০ আগস্ট, ২০১৩

ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধীতা রাষ্ট্রদ্রোহীতার শামিল




ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধীতা রাষ্ট্রদ্রোহীতার শামিল

সাদিকুল হক ॥ ধর্ম অর্থ যাই হোক না কেন, কোন মানুষের পক্ষেই ধর্মনিরপেক্ষ থাকা সম্ভব নয়। মানুষ মাত্রই ধর্ম বিষয়ে নিজের একটা অবস্থানে থাকে। কেউ ধার্মিক, কেউ ধর্মভীরু, কেউ ধর্মান্ধ, কেউ ধর্ম অস্বীকারকারী, কেউ ধর্মের প্রতি উন্নাসিক, কেউ বিপরীত ধর্মের প্রতি সহনশীল কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানে কোন ব্যক্তি থাকতে পারে না। ধর্মনিরপেক্ষতা একটা রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিভাষা। বিগত শতাব্দীর মাঝামাঝি ভারত উপমহাদেশের রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষ পরিভাষাটি যুক্ত হয়। দ্বিজাতিতত্ত্বের ধোঁয়াটে ফানুসে ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান নামক ২টি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ফলে এই অঞ্চলে চরমভাবে বিনষ্ট হয় ধর্মীয় সমপ্রীতি। পুরো উপমহাদেশে সামপ্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। ধর্মে ভিন্নতার কারণে মানুষ মানুষকে হত্যা করে, লুটতরাজ করে, রক্তগঙ্গায় ভাসিয়ে দেয় গোটা উপমহাদেশ। তাই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেরণা ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। এরশাদ সাহেব রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের নিমিত্তে ধর্ম নিয়ে অপ্রয়োজনীয় বিতর্কের সূত্রপাত করেন। রাষ্ট্রধর্মকে স্থান দেন সংবিধানে। এর পর বদলে যায় দৃশ্যপট। দেশের প্রায় সবকটি রাজনৈতিক দল ভাবতে থাকে এইদেশে ধর্মকে বাদ দিয়ে ভোট পাওয়া যাবে না। ফলে ধর্মভীরু মানুষের দৃষ্টিআকষর্ণী মতবাদ হিসেবে রাজনীতিতে ব্যবহৃত হতে থাকে ধর্ম। তথাকথিত রাজনীতিকরা মুক্তিযুদ্ধের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা থেকে সরে যান। বাংলাদেশের মানুষ হাজার বছর ধরে ধর্মভীরু ও ধার্মিক। এদেশে ধর্ম নিয়ে কোন সামপ্রদায়িক হানাহানি ছিল না। ভোটের রাজনীতিতে ধর্ম ব্যবহারের ফল হয়েছে ধর্মের নামে হানাহানি ও উগ্রতা।
বিশ্বে ধর্মরাষ্ট্র হাজার হাজার বছর সময় পেয়েছে নিজেদের যৌক্তিকতা প্রমাণ করার এবং এখনো পাচ্ছে কিছু দেশে। কিন্তু ধর্মরাষ্ট্রের ইতিহাস কলঙ্কিত হয়ে আছে মানুষের দুর্ভোগে, মানবাধিকার লঙ্ঘনে, নারীর অশ্রু আর নিরাপরাধ মানুষের রক্তে। ধর্মরাষ্ট্রের অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানুষের ঘৃণা ও গণবিক্ষোভের মাধ্যমে সভ্যতার ইতিহাসে ধর্মরাষ্ট্রের উৎখাতের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে প্রত্যেকের মানবাধিকার সুরক্ষিত এবং আইনের চোখে সবাই সমান। কিন্তু ধর্মরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা যায় না।
যে কোন একটি ধর্ম ভিত্তিক ধর্মরাষ্ট্র বানাবার চেষ্টা করলে দুনিয়ার প্রতিটি ধর্মের আলাদা রাষ্ট্রগঠনকে বৈধতা দিতে হয়। প্রতিটি  ধর্মের আলাদা ধর্মরাষ্ট্র হলে মানবজাতি ধর্মের ভিত্তিতে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে মানবসভ্যতা। ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলো ইহুদী-খৃষ্টান রাষ্ট্র বানিয়ে তাদের ধর্মীয়শাস্ত্র আইন আমাদের উপর চাপিয়ে দিলে আমাদের অবস্থা কেমন হবে ভাবা যায়?
রাষ্ট্র যখন ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রপরিচালনার নীতি হিসেবে ধারণ করে তখন এর অর্থ হলো - রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হবে না। রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা, জীবনযাত্রার সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো, ধর্মের ব্যাপারে ব্যক্তির স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, আইন, বিচার ও রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে পরিচালিত শিক্ষাকে কোন ধর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা। দুনিয়ার কোন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রই ধর্মের বিরোধীতা তো করেই না বরং ব্যক্তি মানুষের ধর্মকে রক্ষা ও ধারণ করতে সহায়তা করে। কোন ধর্মনিরপেক্ষ সরকার পৃথিবীর কোন দেশে ধর্মীয় শিক্ষার ব্যক্তিগত উদ্যোগ কিংবা মসজিদ মাদ্রাসা, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা নির্মাণে আজ পর্যন্ত বাধা দেয় নি। এখন পর্যন্ত কোন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে একধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের উপাসনালয়ে হামলা করেনি।
ধর্মরিপেক্ষ রাষ্ট্র জার্মানীতে বর্তমানে আড়াই হাজার মসজিদ রয়েছে। আমেরিকার আদালতগুলোতেও বাদী-বিবাদী নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী সত্য বলার শপথ নেয়। আমেরিকার ট্রেজারীও শারিয়া ব্যাংকিং এর অনুমোদন দিয়েছে। টরেন্টো শহরেই রেজিষ্ট্রিকৃত ইসলামি সংগঠন আছে ১২১টি।  ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রেও সরকার পুলিশ দিয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সংবিধান গীর্জাতে বসে পাদ্রী-রাবাইরা তৈরী করে না। সংবিধান তৈরী করেন সংসদে বসে যুগোপযোগী শিক্ষায় শিক্ষিত সাংসদগণ। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি ইহূদী-খ্রীষ্টানদের শয়তানি ষড়যন্ত্র  ও কুফরি আকিদা হয় তবে ইহুদী-খৃষ্টানদের আবিষ্কৃত টুথব্রাশ, চিরুণি থেকে শুরু করে বক্তৃতার মাইক, বাস, ট্রাক, কাপড়, হিটার, এয়ারকন্ডিশনার, জুতো, মাথা ব্যথার ট্যাবলেট, বুড়ো বাবা মার ইনসোলিন, রেডিও, টিভি, গাড়ি, হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ইত্যাদি সবই তো ইহূদী-খ্রীষ্টানদের শয়তানি ষড়যন্ত্র  ও কুফরি আকিদা হতে হয়।
রাষ্ট্র নৈর্ব্যত্তিক। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে বোঝানো হয় রাষ্ট্রযন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধর্মীয় রীতিনীতির বাইরে থেকে পরিচালনা করা। ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মীয় স্বাধীনতাকে প্রকাশ করে। রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো তথ্য এবং প্রমাণের উপর নির্ভর করবে, কোন ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর নয়।  ধর্মনিরপেক্ষতা হলো রাষ্ট্র ও ধর্মকে যার যার স্থানে রেখে সম্মান প্রদর্শন। রাষ্ট্রে ধর্ম থাকবে কিন্তু রাষ্ট্রের কোন ধর্ম থাকবে না। ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধিতা করা মানে ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা এবং স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বিরোধিতা করা। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের মূলে রয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা। বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতিতেও রয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা। তাই ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধিতা রাষ্ট্রদ্রোহীতার শামিল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন