বুধবার, ২৭ জুলাই, ২০১৬

বাংলা ভাষায় খোতবা

বাংলা ভাষায় খোতবা

সংলাপ ॥ খোতবা শব্দের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এটা আরবি ‘খুৎবুন’ শব্দ হতে উদ্ভুত, যার আভিধানিক অর্থ হলো বক্তৃতা। ইসলামী পরিভাষায় খোতবা বলতে আল্লাহ্ প্রশংসা, রাসুলের প্রশংসা ও বক্তৃতা বুঝিয়ে থাকে। খোতবার উদ্দেশ্য আল্লাহ্ জিকির বা স্মরণ এবং বক্তৃতা, উপদেশ প্রদান করা। আর এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের নৈতিক সংশোধন সংস্কার। জুম্মার নামাজের পূর্বে মসজিদে কিংবা দুই ঈদের নামাজের পরে ঈদগাহে, আরাফাতের ময়দানে হাজীদের উদ্দেশে, বিবাহ ও জানাজা ইত্যাদি অনুষ্ঠানে খোতবা প্রদান রীতি প্রচলিত রয়েছে।
শুক্রবার দিনটি অন্য সব দিনের তুলনায় শ্রেষ্ঠ, কারণ এদিন সারা বিশ্বের সব মসজিদে জুম্মার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। শহর গ্রামের সব মুসল্লি এ দিন মসজিদে একত্রিত হন। রাসুল সা. এর যুগে তিনি নিজেই খোতবা প্রদান করতেন।  খোত্বার মধ্যে আদর্শ চরিত্র গঠনের দিক নির্দেশনাসহ সামাজিক-পারিবারিক নিয়মরীতি, নাজিলকৃত অহির বাণী, দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা, ব্যবসা-বাণিজ্যের রীতিনীতি, কৃষি কাজ, স্বাস্থ্য, সামাজিক সমস্যা, ইবাদত-বন্দেগী, বিচার ব্যবস্থাসহ যাবতীয় বিষয়ের সমাধান তুলে ধরতেন। মুমিন হতে হলে তার করণীয় ও বর্জনীয় বিভিন্ন বিষয়গুলো কি তা বিশদভাবে আলোচনা করতেন।
আমাদের দেশে খতিবগণ সাধারণতঃ বার চান্দের খোতবার কিতাব সংগ্রহ করে তা দেখে দেখে আরবি ভাষায় পাঠ করেন। অথচ এদেশের মানুষের ভাষা বাংলা। বেশির ভাগ মানুষই আরবি ভাষা জানেন না, তাই খতিবের দেয়া খোতবা শ্রবণ করেন বটে কিন্তু এ থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন না। ফলে খোতবার মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়। অধিকাংশ খতিবই সাধারণত নিজের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রতি শুক্রবারের জন্য আলাদাভাবে কোন খোতবা তৈরি করেন না। একজন খতিব যদি প্রতি সপ্তাহের জন্য নিজে খোতবা তৈরি করেন, তবে তার নিয়মিত জ্ঞান চর্চা হয়। আর নির্ধারিত খোতবা পাঠে তার চিন্তা গবেষণা হয় না।  কুরআন সর্বকালের সর্বাধুনিক সমস্যার সমাধান গ্রন্থ। অতএব কুরআনের আলোকে আমাদের জীবন পরিচালনা করতে পারলে, আমরা সব সমস্যার সমাধান খুঁজে পেতাম। আমাদের দেশের স্বাধীনতা লাভের প্রায় ৪০ বছর পরও মাতৃভাষায় ইসলামী সাহিত্যচর্চা ও গবেষণার পথ উন্মুক্ত হতে পারেনি। প্রতি শুক্রবার জুম্মার দিন খোতবাগুলো যদি গঠনমূলকভাবে তৈরি করে দেয়া যেত, তবে এ দেশের অনেক খতিবই যোগ্য, দক্ষ ও উপযুক্ত লেখক এবং গবেষক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারতেন। একটি সুন্দর উপযুক্ত, মানসম্মত ও আদর্শ খোতবা তৈরির জন্য কতগুলো নিয়ম পদ্ধতি এবং কলাকৌশল অনুসরণ করতে হয়। যার মাধ্যমে গোটা বিশ্ব, জাতি সঠিক দিকনির্দেশনা খুঁজে পাবে। বর্তমান বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে যেসব ফেৎনা-ফ্যাসাদ (সন্ত্রাস), যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদি যেমন ধর্মের নামে নিরীহ মানুষ হত্যা, বর্বরতা, নির্যাতন, নিপীড়ন সাম্প্রতিককালে যেভাবে বেড়ে চলেছে ক্ষমতার জন্য - এসব কিছুর প্রতিকার কী? কী উপায়ে এই অভিশাপ থেকে জাতি মুক্তি পেতে পারে। এ সম্পর্কেও খোতবার মাধ্যমে জাতিকে দেয়া যায় দিক নির্দেশনা। সমাজের সাধারণ মানুষও খতিবের কাছে দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্যই আশা করেন। আমাদের দেশের খতিবগণ প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন খোতবা তৈরি করে দেশ ও জাতির চরিত্র গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, একটি আদর্শ ও মানসম্মত খোতবা যেন বিষয়বস্তুর আলোকে দু’ভাগে বিভক্ত হয়। ১. কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট খোতবা। যেমন ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ভয়াবহ আক্রমণ। ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস, পহেলা মহররম হিজরি নববর্ষের তাৎপর্য, ১০ মহররম আশুরা শরিফ, আখেরি চাহার শোম্বা, ১২ রবিউল আউয়াল পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সা. ইত্যাদি বিষয়াবলির প্রকৃত ঘটনা ও তাৎপর্য গুরুত্বসহকারে মুসলমানদের সামনে তুলে ধরা। ২. পবিত্র কুরআনের আলোকে মানুষকে শান্তির পথ-নির্দেশনার জন্য বিষয়ভিত্তিক আলোচনা যেমন-মানবীয় চরিত্র গঠন, নৈতিকতা, দুর্নীতিমুক্ত দেশ ও জাতি গঠনে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় করণীয় এবং এ সংক্রান্ত কুরআনের উপদেশ সংবলিত ঘটনাবলি ও আদেশ-নিষেধ বর্ণনা করা। নবী-রাসুল, অলি-আউলিয়া ও সূফী সাধকদের জীবনদর্শন আলোচনা করা। অতএব কোন খতিব যদি এ নিয়মে তার খোতবা সাজাতে পারেন, তবে তার খোতবাটি একটি আদর্শ ও মানসম্মত খোতবায় পরিণত হবে। মুসলমানদের মাঝে খোতবা শোনার আগ্রহ বাড়বে। তাই আমাদের মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রতি শুক্রবার নতুন খোতবা প্রস্তুত করে মুসলমানদের সামনে উপস্থাপন করা এখন জরুরি হয়ে উঠেছে। কারণ, খোতবার নামে সাম্প্রতিককালে ইহুদি-খ্রীষ্টান ও তাদের মদদপুষ্ট ঘৃণ্য ওহাবীবাদীদের বিকৃত আদর্শে প্ররোচিত হয়ে এক শ্রেণীর বিপথগামী এদেশীয় ধর্মজীবীরা তরুণদের একটি অংশকে বিপথে নিয়ে যাচ্ছে এবং পবিত্র শান্তিধর্ম (ইসলাম)কে কলুষিত করছে। যা সমগ্র মুসলিম সমাজকে বিব্রত অবস্থায় ফেলে দিয়েছে।     
স্মর্তব্য, ১৯৬০ সালে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা প্রথমবারের মতো ইমাম প্রশিক্ষণ প্রবর্তন করেছিল। সে সময় খোতবা সংস্কারেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল এবং তৎকালীন বিশিষ্ট উলামা এবং বিশেষজ্ঞগণ কর্তৃক বাংলা অনুবাদসহ নতুন খোতবাও রচিত হয়েছিল বলে জানা যায়। একযোগে তা অনেক মসজিদে পঠিতও হয়েছিল। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, নব্বই-এর দশকে বাংলাদেশে খোতবা সংস্কারের প্রথম উদ্যোগ গৃহীত হয়েছিল এবং এ ব্যাপারে কিছুটা বাস্তব পদক্ষেপও নেয়া হয়েছিল। প্রসঙ্গতঃ আরো উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালের ১৪ জানুয়ারী ইকবাল রোডে ইমাম প্রশিক্ষণ প্রকল্প আয়োজিত ১৯৮তম দলের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইমামদের সনদ বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণদানকালে তৎকালীন ধর্মমন্ত্রী একটি খোতবা প্রণয়ন কমিটি গঠন করার তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, দেশে প্রচলিত পুরাতন খোতবার অংশ বিশেষ পরিবর্তন করে মুসল্লীদের মধ্যে প্রচার উপযোগী বলিষ্ঠ ও প্রাঞ্জল ভাষায় মুদ্রিত একটি নতুন খোতবা শীঘ্রই প্রণয়ন করা হবে।
তৎকালীন ধর্মমন্ত্রী ঘোষিত খোতবা সংস্কার কমিটি কিছুদিন কাজও করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পট পরিবর্তনের ফলে সেই খোতবা সংস্কার কমিটির আর কোনো ভূমিকা পরিলক্ষিত না হলেও স্বাধীন বাংলাদেশে খোত্বা সংস্কারের সেটি ছিল প্রথম পদক্ষেপ। এরপর খোতবা সংস্কারের আর কোনো উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে বলে জানা যায় না।
বর্ণিত পটভূমির আলোকে বলা যায় যে, খোতবা সংস্কারের মহৎ উদ্দেশে অতীতে যেসব পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছিল তার বিশদ বিবরণ সরকারী রেকর্ড-পত্রে সংরক্ষিত থাকার কথা। নতুন শতকের নতুন পরিস্থিতিতে খোতবা সংস্কারের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার দাবি রাখে। যেহেতু এ সম্পর্কে অতীতে যথেষ্ট কাজ হয়েছে এবং বেশ অগ্রগতিও সাধিত হয়েছিল। বর্তমানে ধর্ম মন্ত্রণালয় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বিষয়টি বিবেচনায় এনে সারা দেশের মসজিদের জন্য একই ধরনের একটি খোতবা প্রণয়নের যে উদ্যোগ গ্রহণ গ্রহণ করতে যাচ্ছে তা প্রশংসনীয়। এক্ষেত্রে ধর্মীয় গোড়ামীর উর্ধ্বে উঠে সত্য ও শান্তির সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে যুগোপযোগী ধর্মীয় দযুগের চাহিদা অনুযায়ী খোতবা সংস্কারের প্রয়োজন নিয়ে সচেতন মহলে বিতর্ক থাকতে পারে না। তাই খোত্বার সংস্কার ও যুগোপযোগী করা নিয়ে সৌদি-ওহাবী-ইহুদিপন্থী কোনো ধর্মব্যবসায়ী, স্বাধীনতাবিরোধী, যেন বিতর্ক সৃষ্টির সুযোগ না নিতে পারে সেদিকেও তীক্ষ্ন সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
উল্লেখ্য, ধর্মের কথা জানতে হলে, বুঝতে হলে, মানতে হলে সবাইকে নিজ নিজ ভাষায় কুরআন পড়তে হবে। হিন্দুর ভাষা, খ্রিস্টানের ভাষা, কাফেরের ভাষা বলে কোন ভাষাকে অবমাননার সুযোগ আল্লাহ কাউকে দেননি। রাসুল সা. বলেছেন যে, প্রত্যেক মানব শিশুই জন্মগত ভাবে মুসলিম, অর্থাৎ নিষ্পাপ, ভালো ও শান্ত। তাই মানবশিশু জন্মের পর যে ভাষায় কথা বলে তা-ই মুসলমানদের ভাষা। আল্লাহ তায়ালা জন্মের পর নিষ্পাপ ও পবিত্র মানব-শিশুর মুখে যে ভাষা ফুটিয়েছেন সে ভাষাতেই দিয়েছেন ইবাদত ও কিতাব শিক্ষার পূর্ণ অধিকার। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা যে অধিকার দিয়েছেন কোন মোল্লা তা ছিনিয়ে নিতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতে তার সব নবী-রাসুলের কণ্ঠে একমাত্র আরবি ভাষা দেননি এবং নবী-রাসুলদের মাঝে ভাষাগত ঐক্য সৃষ্টি করেননি। বিশ্বের সকল মানুষের জন্য আরবি ভাষাই যদি কল্যাণকর হতো তবে আল্লাহ এতো ভাষা সৃষ্টি করতেন না এবং তাঁর সব কিতাবই আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করতেন, এবং একমাত্র আরবিকেই ইবাদতের যোগ্য ভাষা হিসেবে নির্ধারণ করতেন। অনারবি ভাষা আল্লাহর ইবাদতের অযোগ্য হলে বিভিন্ন অনারবি ভাষায় বিভিন্ন কিতাব অবতীর্ণ করতেন না। অথচ আল্লাহ তায়ালা হিব্রু ভাষায় ইনজিল, ইবরানি ভাষায় তাওরাত ও ইউনানি ভাষায় যাবুর অবতীর্ণ করেছেন। সুতরাং কেবল আরবিই আল্লাহ তায়ালার ভাষা নয়। আল্লাহ তায়ালা অন্তর্যামী। সব মানুষের ভাষাই তাঁর ভাষা। আল্লাহ তায়ালা তাঁর কিতাব না বুঝে আবৃত্তি করার জন্য অবতীর্ণ করেননি। যে মানুষ যে ভাষায় তাঁর কিতাব সহজে বুঝতে পারে সে ভাষাই আল্লাহর কাছে প্রিয় ও পছন্দনীয়। আল্লাহর ইবাদতে বান্দার মাতৃভাষার চেয়ে উত্তম কোন ভাষা নেই।

এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে মসজিদের ইমাম-খতিবগণ সমাজের তৃণমূল থেকে ইসলামের প্রচার-প্রসার, ইসলামি আদর্শ শিক্ষার বিস্তার, বাস্তবায়ন, সামাজিক অপরাধ-কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও ধর্মদ্রোহীদের অপপ্রচার-বিভ্রান্তির অবসানে কার্যকর ও বাস্তবমুখী বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। রাজনৈতিক ইসলাম ও  বিভ্রান্তদের প্রচারণা এবং অপতৎপরতা রোধে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অপরিসীম। এ লক্ষ্যে খোতবা সংস্কারের মাধ্যমে ইমামদের যুগ চাহিদা পূরণে প্রস্তুত ও অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন হতে হবে। খোতবা যেন সমাজের অভ্রান্ত দিশারী হিসেবে, আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে তা নির্ণীত ও নিশ্চিত করতে হবে। কেননা ইমাম-খতীবরা মুসলিম সমাজের ধর্ম বিশ্লেষক হিসাবে সবার মধ্যে খোতবার আবেদন সৃষ্টি করতে পারেন। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন