বুধবার, ২৭ জুলাই, ২০১৬

সত্যমানুষের বিকল্প নেই

সত্যমানুষের বিকল্প নেই

অ্যাড.এম. মাফতুন আহম্মেদ ॥ বাল্যবন্ধু মিলটন ঘোষ। পেশায় একজন আইনজীবী। কায়েস্থ পরিবারের নির্লোভ, নির্মোহ একজন সৎ জন। সুখে-দু:খে আজও দু’জনে মিশে আছি খুলনা শহরে একাকার হয়ে। আবেগে উচ্ছাসে দু:খ ভরাক্রান্ত হৃদয়ে সেদিন এসেছিলেন আমার কাছে। বললেন মনের ভেতর জমাটবদ্ধ অজানা অনেক কথা। আসলে মায়ার এই পৃথিবী ফুলশয্যা নয়, সবার জন্যই কন্টকাকীর্ণ। রোগে - শোকে-পাথরে জীবনের এই মধ্যবেলায় অনেককে পোহাতে হয় নানা ঝুট-ঝামেলা। সদালাপী বাল্যবন্ধুর মুখ থেকে ফুটে উঠল হতাশার নানা কথা। যেসব কথার অন্ত নেই। উদ্ভুত এই সমাজ ব্যবস্থায় সমাধানের তেমন কোন পথ খোলা নেই। হাকঢাক না রেখে সাহসের সাথে উচ্চকিত কন্ঠে বললেন,‘এ দেশে সৎ মানুষ নেই’, ‘সৎ মানুষের ভাত নেই’। এ কথাটি কী বন্ধুবর মিলটনের ব্যক্তিগত কথা? নাকি সমাজের করুণ দৃশ্যপট তার ভাবুক মনকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে? তার এতসব কথা কি তার বিক্ষুব্ধ হৃদয়ের বহি:প্রকাশ মাত্র?
আসলে ঘটনাটি কিন্তু তা নয়। বিষয়টি ভিন্ন। অভিন্ন সুরে আমজনতা হাটে-মাঠে সর্বত্রই বলছে, এদেশে ভাল মানুষের কোন জায়গা নেই। সৎ মানুষের কোন ভাত নেই। সৎ ভাবে জীবন-যাপন করে লাভ কী? সমাজে সৎ মানুষ তেমন একটা চোখে পড়ছে না। সর্বত্রই সৎ মানুষের আকাল দেখা দিয়েছে।
পেশাগত এই জীবনে কাছে-দূরে থেকে কম-বেশি অনেক কিছু দেখার সুযোগ পেয়েছি। অনেক কিছু উপলব্ধিতে আনার চেষ্টা করেছি। উদ্বেগ, উৎকন্ঠার সাথে চলমান ঘটনা প্রবাহ লক্ষ্য করেছি। এদেশে যিনি সত্য কথা বলবেন, সমাজের কাছে বিরাগভাজন হবেন, যার জন্য সত্য কথা বললেন শেষ পর্যন্ত তাকে হারাবেন। যার জন্য জীবন উৎসর্গ করবেন তার হাতে খুন হবেন, লাঞ্চিত হবেন, অপমানিত হবেন। ভাল কাজের উপদেশ দিবেন, ভুল বুঝবে, দূর্বল ভাববে; আপনাকে ছেড়ে অসৎদের খোয়াড়ে মিশে যাবে। অত:পর এই ব্যক্তি একদিন আর্থিক, মানুষিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবুও সৎ মানুষেরা অসৎদের সাথে মিলে-মিশে থেকে সমাজ ও দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা চালাবেন। অপরদিকে অসৎ মানুষেরা অবৈধ অর্থ রোজগারে অভিন্ন সুরে বড় বড় কথার বয়ান দেবেন। নিজেকে আবার সাধু হিসেবে জাহির করবেন। এ সবই চলছে যুগের হাওয়ায়। ক্ষমতার পালাবদলে। এরা সমাজের কাছে আর এক শ্রেণীর সাধু শয়তান। এদের কবল থেকে আমরা কী বেরিয়ে আসতে পারব না? প্রতিবাদিদের কন্ঠ আজ স্তব্ধ! তারা নীরব, নিথর! অত:পর দেশের গোটা বীভৎস চিত্র দেখে মনে হয় সৎ মানুষের সংখ্যা দিনের পর দিন কমে যাচ্ছে। এমনিতে আমরা হুজুগে। যা শুনি তাই বিশ্বাস করি। গূঢ় রহস্য কী, গভীরে বিচার বিশ্লেষণ করি না। মনে যা আসে তাই বলি। কোথাকার পানি কোথায় যেয়ে লাগে তা নিয়ে ভাবি না। বিলক্ষণ চিন্তা করি না। আসলে গোটা সমাজ ব্যবস্থা আজ ক্যান্সারে আক্রান্ত। মাছের মাথায় মড়ক লেগেছে। যারা দেশ-জাতিকে উন্নতির শিখরে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, জাতিকে সঠিক দিক নির্দেশনা প্রদান করবেন সমাজে সেই সব সৎ, আদর্শিক বিবেকসম্পন্ন মানুষের মূল্যায়ন নেই বললে চলে। বিশ্বায়নের এই যুগে রক্তের বন্ধন ছিন্ন করে মানুষ শুধু টাকার পেছনে ছুটছে। টাকা রোজগারের প্রতিযোগিতা করছে; বৈধ হোক আর অবৈধভাবে হোক। টাকা আয়ের প্রতিযোগিতায় নামতে যেয়ে মানুষ মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলছে। বিবেক বর্জিত কাজ করছে। রক্তের বন্ধন ছিন্ন করছে। তাই মানবতা আজ বিবর্জিত,আদর্শ আজ উপেক্ষিত।
যদিও দেখা যাচ্ছে সৎ মানুষের আকাল, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এদেশে সত্য মানুষ ছিল, আছে এবং থাকবে চিরকাল। সত্য মানুষের কাফেলা নিয়ে এদেশে আগমন ঘটেছে বহু সূফী-সাধক-অলি-আওলিয়ার। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, রূপসা থেকে শাটুরিয়া পর্যন্ত তারা সত্যের বাণী প্রচার করেছেন এবং করে চলেছেন। সত্যিকার অর্থে শান্তির বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করে চলেছেন। শান্তির সুমহান আদর্শ প্রচার করছেন। বাংলার অবহেলিত, নিপীড়িত মানুষকে আদর্শ চরিত্র ধারণ করে অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর জন্যে সাহস ও প্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছেন।
সততার কোন বিকল্প নেই। সততাকে সামনে রেখে একজন ব্যক্তি সামনে এগিয়ে চলে। একটি দেশ, জাতি উন্নতির শিখরে অবস্থান করে। আর এখন! পূঁজিবাদি এই সমাজ ব্যবস্থায় সততা এখন একটি আপেক্ষিক শব্দ। এ প্রসঙ্গে আমার মরহুম পিতার কথা মনে পড়ে। তিনি একজন পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। দার্শনিক পর্যায়ের অতি সাঁধাসিঁধে একজন আদর্শ মানুষ ছিলেন। অবসরে পরিবারের সকলকে নিয়ে বসতেন। প্রসঙ্গত অভিজ্ঞতার আলোকে খোলামেলা আদর্শভিত্তিক অনেক কথা বলতেন। জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনা করতেন। প্রায়ই বলতেন সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। পিতার সেই আদর্শিক চেতনার সাথে আজকের সামাজিক বাস্তবতার কতটুকু মিল আছে? কালো টাকা রোজগারে অনেকে আজ অবৈধ প্রতিযোগিতায় নেমেছে। কে কত দ্রুত কালো টাকার মালিক হতে পারে, শিল্পপতি হতে পারে, আলীশান বাড়ি তৈরি করতে পারে, গাড়ি কিনতে পারে সেই সব অসম প্রতিযোগিতার অবিরাম সংগ্রাম করছে। আর এ সব কালো টাকা রোজগার করতে যেয়ে সমাজে সৃষ্টি হচ্ছে শ্রেণি বৈষম্য। ধনী-গরিবের মধ্যে অসম পার্থক্য। সৃষ্টি হচ্ছে গোটা নাগরিক সমাজে মধ্যে অবক্ষয়। আর এই অবক্ষয়ের প্রভাব পড়ছে গোটা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এই ক্ষয়িষ্ণু সমাজকে বাঁচাতে সত্য মানুষ হবার কোন বিকল্প নেই।
অসৎদের কদর বেশি কথাটি সত্য নয়। কদর হয় তবে তা সাময়িক ও স্বার্থের লোভে। দুর্নীতি আজ কোথায় না নেই? দেশের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি হচ্ছে। ঘরে-বাইরে সর্বত্রই দুর্নীতি হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সৎ-অসৎ সব মানুষকে এক পাল্লায় মাপা হচ্ছে। সবাইকে দুর্নীতিবাজ হিসেবে ভাবা হচ্ছে। অসৎ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এমন একটি পঁচনশীল সমাজ ব্যবস্থার মৃত্যু উপত্যকায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি যে, এখানে যে যত অবৈধ কর্মের সাথে জড়িত সমাজে তার কদর যেন তত বেশি। কালো টাকার প্রভাব পড়ছে সর্বত্রই। রাজনীতির নামে পদ-পদবি ব্যবহার করে, চোরাকারবারি করে, ঠিকাদারির নামে অর্থ ফাঁকি দিয়ে, মানব পাচার করে, হিরোইনের ব্যবস্য করে,সরকারের ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে, সোনা চোরাকারবারির সাথে জড়িত থেকে অনেকে আজ বিত্ত বৈভবের মালিক হয়েছেন। সমাজের সুধি সেজেছেন। ডবল ভিআইপি সেজেছেন। হালে টাকা হয়েছে। নির্বাচনের একটু খায়েশ জেগেছে। হাটে-মাঠে নেতা-নেত্রীর ছবির সাথে নিজের ছবি দিয়ে ডিজিটাল প্যানা সেটেছে। অহরহ অপরাধের সাথে জড়িত হচ্ছে। ডিজিটাল প্যানার জোরে সাত খুন মাফ হয়ে যাচ্ছে। প্রশাসন উল্টো অপরাধিকে সালাম দিচ্ছে। ডিজিটাল নেতা এমপি হবার স্বপ্ন দেখছে। নিজেকে সুখী সুখী মনে করছে। ভোট মৌসুমে হেলিকপ্টার করে কথিত ডিজিটাল নেতা এলাকায় আসছেন। চাটুকাররা নেতাকে ঘিরে ধরছেন। উদ্দেশ্য কিছু নগদ নারায়নের আশা। নেতা দু’হাত দিয়ে দান-দাক্ষিণ্য দিচ্ছেন। লাজ-লজ্জা বিকিয়ে দিয়ে আমজনতা নির্বিধায় কিছু এনাম গ্রহণ করছেন। অনেকে আবার বলে উঠছেন ‘আলহামদুল্লিাহ’। আবার অনেকে নেতাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন ‘আল্লাহ আপনাকে বাঁচাইয়া রাহুক’।
তাহলে সবাই কী দুর্নীতিবাজ? এদেশে সৎ মানুষের কী কোন বালাই নেই? হ্যাঁ আছে। সৎ মানুষের সংখ্যা সব থেকে বেশি। তবে তারা  রণে ভঙ্গ দিয়েছেন বলে মনে হয়। সামাজিক প্রেক্ষাপটে ক্লান্ত। কোন কোন ক্ষেত্রে তারা অপাংক্তেয়। আর এই সব সৎ মানুষের পাল্লাভারি বিধায় এখনও রাষ্ট্র সমাজ ব্যবস্থা মোটামুটি চলছে। সমগ্র পৃথিবী টিকে আছে। যেদিন সর্বশেষ একজন ভাল মানুষও পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, গোটা পৃথিবী সে দিন ধ্বংস হয়ে যাবে। টাকায় সব কিছু হয় না।এ কথা সত্য যে, অসৎরা দ্রুত বেড়ে উঠে। আবার রাবনের পুরির মত ধ্বংস হয়। সৎ মানুষেরা মরেও জীবিত থাকে। সমাজের কাছে যুগ যুগ ধরে অমর হয়ে টিকে থাকে।
সত্যের বিজয় অবশ্যম্ভাবী। সত্যের জয় চিরস্থায়ী। মিথ্যা তুসের আগুনের মত জ্বলে-পুড়ে সব ছারখার হয়ে যায়। সততার বিকল্প কিছুই নেই। সততা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। সততা অমৃত। সততা এমনই একটা জিনিস একজন মানুষ মরণের পরেও বেঁচে থাকে। সততাকে সামনে নিয়ে দুর্বার গতিতে আগামির প্রত্যাশায় এগিয়ে চলি। গড়ে তুলি সৎ আদর্শভিত্তিক এক নির্মল বাংলাদেশ। তাই আসুন উচ্চকিত কন্ঠে আবারও ঘোষণা করি সত্য মানুষ হউন, দেশ ও জাতির কল্যাণ হবেই হবে। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন