বুধবার, ২৪ জুন, ২০১৫

ইসলামি নামকরণের ধারা অনৈসলামিক পথ ধরে ছুটছে ....

ইসলামি নামকরণের ধারা অনৈসলামিক পথ ধরে ছুটছে ....

সংলাপ ॥ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) প্রেরিত হয়ে ছিলেন মানব জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য বিভক্ত করার জন্য নয়। তিনি শুধু বনু কোরাইশের নবী নন, কেবল আরব ভূখন্ডের নবী নন- তিনি সমগ্র বিশ্বের বিশ্বাসীদের নবী। মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার মানে সত্য-অসত্য, ন্যায়-অন্যায়, কল্যাণ-অকল্যাণ, সুন্দর-অসুন্দর সব গুলিয়ে ফেলা নয়। ইসলামের শিক্ষা হলো মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে সত্যের ওপর, ন্যায়, কল্যাণ ও সুন্দরের ভিত্তিতে। ইসলামের শিক্ষা হলো- মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জন্মের আগে পৃথিবীতে যতো নবী-রাসুল এসেছেন - যাদের সংখ্যা কয়েক লাখেরও বেশী, তারা সবাই ইসলামের নবী। মুসলমানকে বিশ্বাস করতে হবে যে, যারা সত্যের ওপরে ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন তারা সবাই মুসলমান। ইসলামের এ মৌলিক শিক্ষা থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, ইসলাম মানুষকে গোত্রে-গোত্রে, দেশে-দেশে বা ধর্মে-ধর্মে বিভক্ত করতে আসেনি। ইসলাম এসেছে মানুষকে সত্য, সুন্দর, ন্যায় ও কল্যাণের পথে ঐক্যবদ্ধ করতে। আমরা অনেকেই এখন মুখে মুখে বলি বা লিখি, ইসলাম সামপ্রদায়িক ধর্ম নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো ইসলামও অন্যান্য ধর্মের মতো সামপ্রদায়িক ধর্মে পরিণত হয়ে গেছে। ইসলাম ধর্মও এখন অন্যান্য ধর্মের মতো অনেকের কাছে জন্মসূত্রে পাওয়া ধর্মে পরিণত হয়েছে। জন্মসূত্রে ইসলামের তথাকথিত অধিকারী মুসলমান সত্য, সুন্দর, ন্যায় ও কল্যাণের পথ অনুসরণ করুক আর না করুক সে মুসলমান এটাই বড় হয়ে উঠেছে। এটা অন্তঃসারশূন্য অথবা বিভ্রান্তিকর এক পরিচিতি। কিন্তু সত্য তো এ রকম নয়। আল্লাহ্‌তায়ালাও এ রকম নয়। কোরেশরা আল্লাহ্‌র প্রিয় নবীদের বংশধর এবং আল্লাহ্‌র নামের পূজারি ছিলেন বলেই তারা মুসলমান হিসেবে স্বীকৃতি পাননি যতক্ষণ না তারা সত্য ও ন্যায়ের পথে আত্মসমর্পন করেছেন। আর সত্য, ন্যায়, কল্যাণ, সুন্দর ইত্যাদি বিষয় অলৌকিক কিছু নয়, আল্লাহ্‌র নামের দোহাইয়ের ওপর নির্ভরশীলও নয়। এগুলো মানুষের চলমান জীবন ও বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার মানদন্ডে বিচারযোগ্য বিষয়। ইসলাম সামপ্রদায়িকতার ধর্ম নয় একথা যেমন সত্য, এর চেয়েও বাস্তব মুসলমানরা ইসলামকে নিতান্ত সামপ্রদায়িকতার ধর্মেই পরিণত করে যাচ্ছে। জগতের সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) প্রচারিত ধর্মের নাম হতে পারতো ‘দীন-ই-মুহম্মদী’ বা ‘মুহম্মদী ধর্ম’। কিন্তু মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ও তার সাহাবারা তা করেননি। ইসলামের মতে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ প্রচারিত ধর্মের কোনো নামই নেই। বলা হয়েছে নাম ইসলাম। ইসলাম হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে ২ লাখ ২৪ হাজার পয়গম্বরের প্রত্যেকের প্রচারিত ধর্মের নাম। আসলে ‘ইসলাম’ ধর্মের নাম নয়, নীতি-অবস্থানের নাম। ইতিহাসের প্রেক্ষাপট দেখলে আমরা বুঝতে পারব ইসলাম নামটি সর্বজনীন ও অসামপ্রদায়িক। আর মহানবী (সাঃ) প্রচারিত ধর্মের এ অবস্থানটি শুধু ইতিহাস বা অতীতের বেলায় প্রযোজ্য নয়, ভবিষ্যতের বেলায়ও। যেখানে সত্য, ন্যায় ও কল্যাণ আছে সেখানেই ইসলাম আছে, যেখানে তা নেই সেখানে ইসলাম নেই- এটাই ইসলামের শিক্ষা।
এখন মুসলিম সমাজ সামষ্টিক সমাজ হিসেবে এবং মুসলমান নামধারী মানুষরা অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে ইসলামের শিক্ষা থেকে ব্যাপকভাবে বিচ্যুত হচ্ছে- সত্য, ন্যায়, কল্যাণ ও সুন্দরের পথ থেকে নানাভাবে দূরে সরে যাচ্ছে। চিন্তাবিদরা বলে থাকেন মানবসমাজ অনেক সময়ই একেবারে নিখুঁত আদর্শের ওপর থাকে না। ব্যক্তি জীবনেও মানুষ পুরোপুরি নিখুঁত চরিত্রের অধিকারী বা সত্যের অনুসারী থাকে না। মানুষ ভুল করে, সমাজ কলুষ-কালিমাযুক্ত হয়। এটা কিছুটা স্বাভাবিক। এ কারণে ইসলামের শিক্ষায় সর্বত্র আল্লাহতায়ালার ক্ষমা ও অনুগ্রহের কথা বলা হয়েছে। মানুষ ভুল করলে আবার সুপথে ফিরে আসার চেষ্টা করতে পারে- এটাই মহান সত্যের সদয় নীতি। কিন্তু আজকের যুগে মুসলিম সমাজ অধঃপতন ও বিভ্রান্তির দিকে চলে গেছে অনেক বেশী এবং মৌলিকভাবে। সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের সন্ধান করাই এখন হয়ে পড়েছে কঠিন। এ অবস্থায় মুসলমান অধ্যুষিত রাষ্ট্রে এবং সমাজের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ইসলামিকরণের এক বিভ্রান্ত প্রবণতা। মুসলমানরা এখন নিজেদের অপকর্ম ও অক্ষমতা আড়াল করার জন্য ‘ইসলামি’ নামের পেছনে লুকাতে চেষ্টা করছে। এভাবে সভ্যতার সব অর্জনে ইসলামি ভাগ বসানোর মাধ্যমে নিজেদের দৈন্যতা তুলে ধরা হচ্ছে। ইসলাম এখন চলে এসেছে সামপ্রদায়িকতার গন্ডির মধ্যে।
আর বিশেষ কিছু পোশাক-আশাক, অগত্যা কিছু আচার-আনুষ্ঠানিকতা এবং ‘ইসলামি’ শব্দ সহযোগে নামকরণের মাধ্যমে ধরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে ইসলামকে। সবচেয়ে মারাত্মক যেটি করা হচ্ছে তা হলো, ইসলামি নামকরণের মাধ্যমে সভ্যতার সবকিছু বিভক্ত করা, এমনকি মুসলমান সমাজকেও বিভক্তির ঘেরাটোপের মধ্যে ফেলে দেয়া।
ইসলামি অর্থনীতি, ইসলামি রাজনীতি, ইসলামি ব্যাংক, ইসলামি ইন্স্যুরেন্স, ইসলামি বাণিজ্য, ইসলামি প্রযুক্তি, ইসলামি চিকিৎসা, ইসলামি হাসপাতাল, ইসলামি শাসনতন্ত্র, ইসলামি শাসন, ইসলামি সাংবাদিকতা, ইসলামি প্রচার মাধ্যম, ইসলামি লেবাস, ইসলামি জীবন, ইসলামি জগৎ - এভাবে সব কিছুকে ইসলাম দিয়ে বিভক্ত করা হচ্ছে। এভাবে বিভক্ত করে মুসলিম সমাজ কি কিছু অর্জন করছে, নাকি সবকিছুই হারাচ্ছে? আসলে সবকিছুই হারাচ্ছে। ইসলাম এসব কিছুকে বিভক্ত করতে বলেনি বরং এসবকেই সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের অনুগামী করে তুলতে নির্দেশ দিয়েছে। ইসলামি ব্যাংক যদি সত্যিই ইসলামি হয় তবে মুসলমানরা অন্য যে ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে কাজ করে তা কি অনৈসলামিক? ইসলামি প্রযুক্তি বলে যদি কিছু থাকে তবে অমুসলিমদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি কি অনৈসলামিক? অনুরূপভাবে বিভক্ত করা সব বিষয়ের ক্ষেত্রে একই প্রশ্ন প্রযোজ্য। মুসলমানরা কি পারবে এ পৃথিবীতে মুসলমানদের জন্য আলাদা এক জগৎ ও জীবন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে? ইসলাম কি এরকম একটা বিচ্ছিন্ন জীবন ব্যবস্থা গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছে? ইসলাম তা দেয়নি। ইসলাম মুসলমানদের বলেছে, এমন উত্তম ব্যবস্থার নিদর্শন স্থাপন করতে, যাতে অনুপ্রাণিত হয়ে জগতের সব মানুষ সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের সন্ধান পায়। মুসলমানরা এ মহৎ প্রতিযোগিতা থেকে বিচ্যুত হয়ে চলে যাচ্ছে একেবারে প্রান্তিক অবস্থানে। অন্যদিকে আমরা ইসলামি নামকরণে একান্ত নিজেদের সামপ্রদায়িক খোলস হিসেবে আঁকড়ে ধরতে চাইছি এমন কিছু যা প্রকৃত বিচারে উত্তম নয় বরং নিম্নমানের। আমরা কি বলতে পারবো ইসলামি নামকরণ করা কোনো জিনিসটা সভ্যতার বিচারে মানোত্তীর্ণ বা উত্তম? বলতে হবে প্রচলিত কোনোটাই নয়। ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থা মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা নয়। ইসলামি অর্থনীতির বাস্তব কোনো নৈতিক উৎকর্ষের নজির নেই, ইসলামি ব্যাংক আসলে নামের ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। ‘ইসলামি শাসন’ অত্যন্ত বিপজ্জনক একটি শব্দ হিসেবে নিজের পরিচয় তুলে ধরছে বারবার। ইসলামি বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-চিকিৎসা ইত্যাদির কথা যদি বলা হয়, লজ্জাজনক প্রতারণাই বলতে হবে।

আমাদের সমাজের এ ধরনের নিজস্ব কিছু এ যুগে আর নেই। আমাদের সমাজ নানা ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার ফলে যতটা না খারাপ অবস্থায় ছিলাম এর চেয়ে অনেক বেশি খারাপ অবস্থায় যাচ্ছি ইসলামি নামকরণের অনৈসলামিক ধারার পেছনে ছুটে। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন