বৃহস্পতিবার, ১১ জুন, ২০১৫

সময়ের সাফ কথা.... সহকর্মীদের পারস্পারিক কর্তব্য


সময়ের সাফকথা....
সহকর্মীদের পারস্পারিক কর্তব্য

আল্লামা মোঃ সাদেক নূরী ॥ সহকর্মী মানে কাজের সাথী। শিক্ষা, সাধনা ও কৃষিক্ষেত্র, কলকারখানা, অফিস-আদালত, সমাজসেবা অথবা রাজনীতি প্রভৃতি কর্মক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য যারা একসাথে কাজ করেন, তারা প্রত্যেকেই একে অন্যের সহকর্মী ও সহযোগী।
সহকর্মী বা সহযোগী ছাড়া মানুষের পক্ষে কোন কাজই করা সম্ভব নয়। অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় ব্যক্তিগতভাবে মানুষ নিতান্তই অসহায়। একটি গরুর বাছুর জন্মগ্রহণ করে অল্প সময়ের ব্যবধানেই কারো সাহায্য ছাড়া তার মায়ের দুধ খেতে পারে। এ জন্য তার কারো সাহায্যের প্রয়োজন হয় না। কিন' একটি মানব সন্তান অন্যের সাহায্য ছাড়া তা পারে না। তাই জন্মগতভাবেই মানুষ পরস্পর নির্ভরশীল। বর্তমানে এ নির্ভরশীলতা আরো ব্যাপক। কারণ, আদিম মানুষের তুলনায় আধুনিক মানুষের জীবনের অনেক জটিল-প্রয়োজন সীমাহীন। এখানেই সহকর্মীর গুরুত্ব ও মর্যাদা। আর এরই নিরিখে সহকর্মীর অধিকার ও কর্তব্য সুনির্দিষ্ট।
মানুষ কেবল স্বার্থপরই নয়, সে পরার্থপরও বটে। যে শিশুটিকে এক সময় দেখা যায় অন্যের চকলেটটি ছিনিয়েনিতে অথবা ছিনিয়ে নিতে না পেরে কাঁদতে, তাকেই অন্য সময়ে দেখা যায়, নিজের চকলেটগুলো আনন্দের সাথে অন্যকে বিলিয়ে দিতে। সুতরাং দেয়া-নেয়া দুটোই মানুষের অভ্যাস এবং স্বার্থ দিয়ে, স্বার্থ অর্জন নীতির মধ্যেই এ অভ্যাসের  সঠিক রূপায়ন নিহিত। আর এ নীতিই পারস্পারিক সহযোগিতার ভিত্তি এবং সহকর্মীর হক বা অধিকারের ভিত্তিও এটাই।
সহকর্মী জীবন-সাথী, উন্নতি ও সাফল্যের সহায়ক এবং সভ্যতার নির্মাণসঙ্গী। তাই সহকর্মীর হক রক্তের আত্মীয়ের চেয়েও বেশি। তাইতো মহানবী ভালবাসতেন ক্রীতদাস বেলালকে, আপন চাচা আবু জেহেলকে নয়। সকল সহকর্মীর অধিকার সমান। কারণ, এ অধিকারসমূহ মৌলিক ও মানবিক। আর মৌলিক ও মানবিক হক বা অধিকার সকলের সমান। কারণ মানুষ হিসাবে সকলেই সমান, একে অন্যের ভাই। আল-কুরআনের দাবি হলো, আল্লাহর নিদর্শনসমূহের একটি ‘তিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, এখন তোমরা মানুষ, সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছ’। আরো বলা হচ্ছে- ‘তোমাদের প্রতি আল্লাহ্‌র অনুগ্রহকে স্মরণ কর, তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে, তিনি তোমাদের অন্তরে প্রীতির সঞ্চার করেছেন, তোমরা পরস্পর ভাই হলে’। এ জন্যই প্রত্যেক মানুষের মানবিক মর্যাদা ও মৌলিক অধিকার সমান। তাই পদমর্যাদা ও কাজের গুরুত্বের আনুপাতিক তারতম্যের জন্য সহকর্মীর নিকট সহকর্মীর হক বা অধিকারের তারতম্য হবে না। তা ছাড়া, একজন সহকর্মী সমগ্র কাজের যত ক্ষুদ্র অংশই সম্পাদন করুন, তা বাদ দিলে গোটা কাজটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তদুপরি, মৌলিক ও মানবিক পাওনার বিচার কাজের পরিমাণ বা প্রকৃতিক দ্বারা নিরূপিত হয় না।
আপনি যতই উচ্চপদে থাকুন, কোন কাজের যত গুরুত্বপূর্ণ বা অংশই সম্পাদন করুন, আপনি আপনার সহকর্মীর কাছে সহকর্মী হিসাবে যা আশা করেন, যে হক দাবি করেন, আপনার সহকর্মীও আপনার কাছে ঠিক তাই প্রত্যাশা করেন। আর এ উভয়ের পারস্পারিক প্রত্যাশিত বস্থই সকল সহকর্মীর হক ও অধিকার এবং পারস্পারিক কর্তব্য। যেমন আপনি আশা করেন-আপনার সহকর্মী আপনার পদমর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন, আপনার কাজের স্বীকৃতি দেবেন, যৌথকাজে আপনার পরামর্শ গ্রহণ করবেন। আপনার মত সহকর্মীর থেকে ভিন্ন হলেও তিনি তা’ সম্মানের সাথে গ্রহণ করবেন। আপনার সাথে ন্যায়াচারণ করবেন, আপনার প্রতি সৌহার্দ্য ও সহমর্মিতা দেখাবেন। কোন ভুল বুঝাবুঝি হলে আপোষে মিটাবার চেষ্টা করবেন, আপনার সুখে সুখী হবেন এবং আপনার দুঃখে দুঃখী হবেন, আপদে বিপদে আপনাকে সাহায্য করবেন ইত্যাদি। শুধু তাই নয়।  আপনি আরো আশা করেন, আপনার সহকর্মী আপনার বিশ্বাস নষ্ট করবেন না, আপনার কাজে তিনি বাধা হবেন না, আপনাকে ঠকাবেন না, আপনার সম্পর্কে বিরূপ ধারণা করবেন না, আপনার দুর্নাম করবেন না, আপনার বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করবেন না এবং আপনার কোনো গোপন ফাঁস করবেন না ইত্যাদি।
অতএব, আপনার সহকর্মীও আপনার কাছে সে সবই আশা করেন। এগুলো সহকর্মীর হক। এ হক বা অধিকারগুলো মৌলিক ও মানবিক এবং পারস্পারিক সহযোগিতার ভিত্তি। এগুলোকে অমান্য করে সুখী জীবন, স্বচ্ছ জীবন, উন্নত মনুষ্যত্বের জীবন, সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি সমাজ সম্ভব নয়। এ জন্যেই রাসূল্লাহ্‌ (সাঃ) বলেন ‘যে ব্যক্তি নিজের জন্য যা ভালবাসে নিজের ভায়ের জন্য তাই ভালবাসে না, সে মু’মেন হতে পারে না’ - অর্থাৎ সে ব্যক্তি পরম সত্য ও সার্বিক মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী নয়।
সুতরাং সহকর্মীর হক পূরণ করে ‘তোমরা আমায় স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ করব’- এই কুরআনিক নীতির অনুসরণে সহকর্মীর কাছে নিজের হক দাবি করতে হবে। অর্থাৎ অন্যের পাওনা আদায় করে নিজের পাওনা চাইতে হবে। তা’হলে তা পাওয়া যাবে, অন্যথায় নয়। বস্থতঃ শান্তি ও সাফল্যের জন্য সহকর্মীদের মধ্যে পারস্পারিক কর্তব্যবোধের কার্যকর অনুশীলন অপরিহার্য।
আল্লাহ্‌ আমাদের সকলকে সহকর্মীর হক সম্পর্কে সচেতন করুন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন