যুদ্ধাপরাধীদের
মুক্তির দাবিতে কলঙ্কিত স্বাধীনতা উদ্যান
নিষাদ
হায়দার ॥ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকেই এসেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক। এখানেই
পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণে সৃষ্টি হয়েছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। গত ২৫ অক্টোবর ২০১৩
তারিখে সেই স্বাধীনতার উদ্যানেই মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দন্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের
মুক্তি চেয়ে শক্তির মহড়া দিলো জামাতে ইসলামী।
এটি
হয়েছে বিএনপি-র রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে। আঠারো দলের জোটে মূলদল এখন বিএনপি নয়
- জামাত। অন্তত আলোচিত জনসভায় এই সত্যটি স্পষ্ট হয়েছে দেশবাসীর কাছে। স্বাধীনতার উদ্যানে
যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির দাবিতে জামাত-শিবিরের ব্যানার ফেষ্টুন মহামারিতে বিএনপি নেত্রী
দেশের আগামী রাজনীতির বক্তৃতা দিচ্ছেন, এই দৃশ্য কোন স্বাধীনতাকামী কিংবা স্বাধীনতাকে
ভালোবাসার মানুষের পক্ষে হজম করা সম্ভব নয়।
স্বাধীনতা
উদ্যানে দাঁড়িয়ে তারা ব্যক্ত করেছেন কীভাবে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি আওয়ামীলীগকে পঙ্গু
করে জামাতের রাজত্ব কায়েম করবেন। একটি জাতির স্বাধীনতার চার দশক পর স্বাধীনতার বিরোধীদের
এমন আস্ফালন আর কোন জাতির ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। জামাত তাদের ইচ্ছাকে কতদূর
এগিয়ে নিতে পারবেন সে বিবেচনা পরে, কিন্তু এই মুহুর্তে বাঙালির ইতিহাসকে যে পায়ের নিচে
ফেলেছেন সেটি তো সত্য! আর এই মূহুর্তটি তাদের হাতে এসেছে প্রধান বিরোধী দলের রাজনীতির
কারণে। বিরোধী দল ক্ষমতার রাজনীতিতে এতটাই অন্ধ যে তারা স্বাধীনতাবিরোধীদের ছাড়া চলতে
পারে না। অন্যদিকে প্রশ্ন জাগে, পলাতক আসামীরা কী করে ওখানে জমায়েত হয়ে দিব্যি বক্তৃতার
ফোয়ারা ফোটালেন? কেন পুলিশ তাদেরকে দেখতে পেল না? বিএনপি নেত্রীর সমস্যা নেই তিনি তার
রাজনীতির ঐতিহ্য ধারণ করেই জামাত-শিবির যুদ্ধপরাধীদের কাঁধে বসিয়ে স্বাধীনতা উদ্যানে
পদদলন চালিয়েছেন। তারা গোড়া থেকেই যুদ্ধাপরাধীদেরকে চেনেন না , বিচারের ট্রাইব্যুনালকে
মানেন না, যাদের রায় ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে তাদেরকে তারা রাজনৈতিক বন্দী মনে করছেন, সুতরাং
স্বাধীনতা উদ্যান নিয়ে তাদের আকর্ষণ না থাকবারই কথা। এদেশে বিএনপির রাজনীতি শুরুই হয়েছিল
স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী রাজাকার আলবদর শান্তিকমিটির পতিত মানুষগুলোকে নিয়ে। পঁচাত্তরের
পর থেকে বিএনপি তাদেরকে ত্যাগ করেনি, বরং বিএনপির রাজনীতি তাদেরকে সুখ স্বপন স্বীকৃতি
সবই দিয়ে আসছে। এ থেকেই বিএনপির রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধ কী জিনিস তা অস্পষ্ট। আর সে
কারণেই একজন মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকার কাছে সংবিধান এখন স্রেফ “তেজ পাতা”। অর্থাৎ
ফের তারা ক্ষমতা পেলে এ সংবিধান, ব্যবহার করা তেজপাতার মতোই ডাষ্টবিনে ফেলে দিবেন।
দিতেই হবে, না দিলে তাদের কাঙিক্ষত যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করবেন কী করে? জোটের অন্যান্য
যারা আছেন তারা সকলেই যে সহমত পোষণ করেন বা করবেন সেটাই স্বাভাবিক, সেটা তারাও গোপন
করেন নি।
জামাতকে
নিষিদ্ধ করার দাবি বহু পুরানো। গণজাগরণ মঞ্চ তাকে দিয়েছিলো নতুন গতি। দেশের সকল শ্রেণী
পেশার স্বাধীনতার পক্ষের মানুষ জামাতকে নিষিদ্ধ করার দাবির প্রতি তাদের সমর্থন এবং
আন্দোলনে সম্পৃক্ততা যখনি প্রবল করতে শুরু করে, তখনি কোন এক অদৃশ্য সুতার টানে সে আন্দোলনকে
ব্রেক কষে দেয়া হয়। বুঝতে অসুবিধা হয় না এর পিছনেও ছিল রাজনীতি। প্রচেষ্টা ছিলো জামাতকে
বিএনপি থেকে আলাদা করার। কিন্তু সে গুড়েবালি।
এখন লেজে কুকুর নাড়াতে শুরু করেছে। সংলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে লেজের দৌরাত্ম্য যে আরো
বহুগুণ বেড়ে যাবে তা কী একবারও ভেবেছেন স্বাধীনতার পক্ষের বিশিষ্টজনেরা? ইতিহাসে পুনরাবৃত্তি
নেই, কিন্তু কথাটি আমাদের দেশে একেবারেই অচল। তার কারণ এখানের রাজনীতিতে গণতন্ত্র অচল,
দুর্বৃত্তায়নই একমাত্র রাজনৈতিক লক্ষ্য। আর
সে কারণেই ইতিহাসের চাকা উল্টো দিকে ঘোরা শুরু করলে অবাক হবার কিছু নেই। স্বাধীনতা
উদ্যানের প্রতি যে রাজনীতি সম্মান দেখাতে জানে না, সে রাজনীতি আর যা-ই হোক গণতান্ত্রিক
রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমে সমর্থ হবে না। অতীতেও হয়নি।
একাত্তরের
মুক্তিযোদ্ধা ওকালতি করছেন যুদ্ধাপরাধীর মুক্তির জন্য। রাজনীতি করছেন তাদেরকে মসনদে
ফিরিয়ে আনবার জন্য। হরতাল দিয়ে মানুষের জানমালের ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছেন রাজনীতির
নামে। তা হলে তিনি আর মুক্তিযোদ্ধা থাকলেন কোথায়? আমাদের রাজনীতিতে সেটা আর কোন সমস্যা
নয়, আমরা চিনি ক্ষমতা, বুঝি ক্ষমতা এবং জানি ক্ষমতাকেই। আর সে কারণেই আমরা মর্যাদা
দিতে পারি না নিজের আত্মশক্তিতে জেগে ওঠা শাহবাগের মুক্তিযুদ্ধকে।
জাতি
নির্বাচন চায়। না চেয়ে আর কোন পথ নেই। কোন রকম একটি নির্বাচন। তাই শর্টকাট পথটিই কাম্য।
বাঙালি চরিত্রের এই বোধটিকে খুব ভালোভাবেই অনুধাবন করছে যুদ্ধাপরাধের রাজনীতি। আর সেটা
বুঝেই তারা রাজপথ দখলের নিরবচ্ছিন্ন ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে আসছে। আর তা দেখে আমরাও আমাদের
পুরাতন অভিধাটির প্রতি সুবিচার করতে কুন্ঠিত নই, ভাবখানা এমন - বীর্য যা দেখাবার তা
একাত্তরেই দেখিয়ে ফেলেছি এখন আর প্রয়োজন নাই। তাই যুদ্ধাপরাধী আমাদের মাথার উপর বসে
পা দোলালে ক্ষতি কী? এই ভাবনার পরিণতিতে আসছে নির্বাচন, আমরাও উন্মাদ হবো, ওঠা নামানোর পালা বদলে তাই না?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন