বুধবার, ২ অক্টোবর, ২০১৩

আন্তর্জাতিক ত্যাগ দিবস চাই


আন্তর্জাতিক ত্যাগ দিবস চাই

 
আরিফিন  হক ॥ মানুষ শান্তি চায়। শান্তির আশায় মানুষ পুঞ্জিভূত করে অর্থ-বিত্ত, ক্ষমতা। কিন্তু অর্থ-বিত্ত, ক্ষমতা যত বাড়তে থাকে ততই কমতে থাকে শান্তি। ভোগের জগতে ফুর্তি আছে কিন্তু শান্তি নাই। শান্তি আছে ত্যাগে।

ত্যাগ হচ্ছে একটি স্বতঃস্ফূর্ত ক্রিয়া। পার্থিব উদ্দেশ্যমূলক ত্যাগ, ত্যাগ নয়। আমরা যখন ঐ-টা পাওয়ার আশায় এ-টা ত্যাগ করি তখন এ-টার চেয়ে ঐ-টাকে মূল্যবান মনে করি। যার মূল্য আমাদের কাছে কম তা দিয়ে যার মূল্য বেশি তা পেতে চাই। পাওয়ার লোভে দেয়া হলো বাণিজ্য আর প্রত্যাশাহীনভাবে দেয়া হলো ত্যাগ। দুঃখের সাথে কিছু দেয়াও ত্যাগ নয়। বাধ্যতামূলক ত্যাগও ত্যাগ নয়। ত্যাগের পূর্বশর্ত হচ্ছে আনন্দ। বাধ্য হয়ে দেওার মধ্যে কোন আনন্দ নেই। ত্যাগ আসতে হবে ভেতর থেকে। আর সামাজিকতা রক্ষার্থে কিংবা মর্যাদা রক্ষার্থে ত্যাগ হলো প্রতিপত্তি বৃদ্ধির রাজনীতি।

হারানো এবং ত্যাগ করা সমার্থক নয়। যে দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলে সে কুদৃষ্টি ত্যাগ করতে পারে না,  যে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে সে অতিকথন ও মিথ্যাকথন ত্যাগ করতে পারে না, যে কামশক্তি হারিয়ে ফেলে সে কামেচ্ছা ত্যাগ করতে পারে না। হারানোর মধ্যে আছে আক্ষেপ আর ত্যাগের মধ্যে আছে আনন্দ।

যার যা নেই সে তা ত্যাগ করতে পারে না। একজন ভিখারী সম্পদ ত্যাগ করতে পারে না, একজন মূর্খ জ্ঞান ত্যাগ করতে পারে না, যার ব্যক্তিত্ব নেই সে ব্যক্তিত্ব ত্যাগ করতে পারে না। ত্যাগ করার পূর্বশর্ত হচ্ছে প্রাচুর্য। শান্তি লাভের পূর্বশর্ত হলো - যার যেখানে প্রাচুর্য আছে তাকে সেই প্রাচুর্য থেকে ত্যাগ করা।

ত্যাগের মধ্যে আনন্দ থাকতে হবে। ত্যাগ করার সাথে সাথেই এমন একটা অনুভূতি আসতে হবে যে, এতদিনে আমি ভার মুক্ত হলাম, এতদিনে আমার মাথা থেকে বোঝাটা নামলো। তাই যে আমার ত্যাগ গ্রহণ করলো তার প্রতি অন্তরের গভীর থেকে প্রকাশিত হবে কৃতজ্ঞতা। আমি যাকে দিলাম সে কৃতজ্ঞতা জানাবে না, যে দেয়াটা গ্রহণ করলো তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় যখন আনন্দ হয় তখনই ত্যাগ মহান হয়। ফলবান বৃক্ষ চারিদিকে পাকা ফলের সুবাস ছড়িয়ে পাখি, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদের এই বলে আহবান করতে থাকে যে ‘তোমরা এসো, আমার ফল ভক্ষণ করে আমাকে ভারমুক্ত করো, আমাকে কৃতার্থ করো’। সমগ্র প্রকৃতিতে রয়েছে ত্যাগের দৃষ্টান্ত। মানুষের কিছু শিখবার আছে প্রকৃতি থেকে। প্রকৃতি নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছে মানুষের ভোগের জন্য। মানুষ কি স্বার্থপরের মতো শুধু ভোগই করবে? তার কি দেবার মতো কিছুই নেই? মানুষ যা দিতে পারে তা হলো প্রেম। প্রেম ছাড়া এই জগতকে মানুষের দেবার আর কিছুই নেই। মানুষের সত্তা যখন প্রেমময় হয়, যখন প্রেম একটা নিত্যগুণ হিসেবে মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় তখন তা থেকে যে বিকীরণ ঘটে তা-ই ত্যাগ। প্রেম ছাড়া ত্যাগ নেই। যে দেয়ার মধ্যে নেওয়ার আকাঙ্খা নেই, সেই দেয়াই হচ্ছে প্রেম বা ত্যাগ। প্রেম পাওয়ার নয়, দেয়ার প্রশ্ন, দেওয়ার উদগ্রীব আকাঙ্খা। সকলের মধ্যে নিজেকে এবং নিজের মধ্যে সকলকে অনুভব করা।

প্রকৃত ত্যাগ হচ্ছে বস্তুমোহ ত্যাগ, ‘আমার বোধ’ তথা মালিকানা বোধের ত্যাগ। আমার বলতে কিছু নেই এই বোধের উদ্ধোধনই জীবনের স্বপ্ন থেকে জাগরণ। যদি আমাদের মধ্যে প্রকৃতই এই বোধের উদ্বোধন হয়ে থাকে যে - জীবনটা একটা স্বপ্ন তবে জাগরণের মাধ্যমেই স্বপ্নকে ত্যাগ করা হয়। আমরা প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে আমাদের স্বপ্নগুলো ত্যাগ করি না। ঘুম ভেঙ্গে যখন স্বপ্নকে স্বপ্ন বলে বুঝতে পারি তখন স্বপ্ন নিজ থেকেই ত্যাগ হয়।

‘আমার মালিকানা বোধ’ হদয়কে আচ্ছাদিত করে রাখে, দৃষ্টিকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে, তাই আনন্দপ্রবাহ আমাদের স্পর্শ করতে পারে না। কোহেলিকা কেটে গেলে যেমন ঝকঝক করে উঠে সূর্যের জ্যোতি, ‘আমার বোধ’ দূর হলে তেমনি আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে মানব সত্তা। প্রেম যখন ‘আমার’ শৃঙ্খল ছিন্ন করে তখন তার ব্যাপ্তী ঘটে বিশ্বময়।

‘আমার বোধ’ ভোগবাদের পূজারী আর প্রেম ত্যাগের পূজারী। ভোগের জীবন যাপন করার অর্থ হচ্ছে মরার জন্য বেঁচে থাকা আর ত্যাগের জীবন যাপন করার অর্থ - বেঁচে থাকার জন্য মরে যাওয়া। ‘আমার বোধ’ ত্যাগ মৃত্যুর সমতুল্য। প্রতিটি জীবিত প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ একবারই গ্রহণ করে। আমার বোধ দূর করার মাধ্যমে যে একবার মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে তাঁর আর মৃত্যু নেই। তিনি চিরঞ্জীব, অমর, অক্ষয়, অবিনশ্বর। একমাত্র প্রেমই পারে ‘আমার বোধ’ দূর করতে আর এ বোধ দূর হলেই আনন্দলোকে অন্তহীন ভ্রমন।

বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদির নিশ্চয়ই প্রয়োজন আছে। নিশ্চয়ই আধুনিক সকল সুযোগ-সুবিধা জীবন যাপনকে আরামপ্রদ করবে। কিন্তু এসবের সাথে নিজেকে একীকরণ করে ফেললে মানুষ আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে। স্ত্রী, পরিবার, সন্তান-সন্তদি ইত্যাদি কোন কিছুই চিরন্তন আনন্দের পথে বাধা নয় বরং সহযোগী শক্তি হতে পারে যদি ‘আমার বোধ’ না থাকে, যদি মালিকানা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা না থাকে।  আমরা প্রায়ই শুনে থাকি যে, কোন কোন সূফী সাধক পানির উপর দিয়ে হেঁটে বেড়াতেন। এসব গল্প রূপক। পানির উপর দিয়ে হাঁটা মানে একটা বিশেষ জীবনযাপন পদ্বতি। যে পদ্ধতিতে সাধক তার প্রয়োজনে সব বস্তুকেই ভোগ করেন কিন্তু কোন বস্তুর সাথেই নিজেকে একীকরণ করেন না। কাঁঠাল খাবার আগে হাতে তেল মাখিয়ে নিলে কাঁঠালের আঠা আর হাতে লাগে না। সংসার রূপ কাঁঠালকে যদি জ্ঞানরূপ তেল হাতে মেখে সম্ভোগ করা যায়, তাহলে আঠার দাগ আর মনে লাগতে পারে না। 

ত্যাগ শিক্ষার প্রথম পাঠ হচ্ছে আজ যেসব জিনিসকে আমরা খুব মূল্যবান মনে করছি তা আসলেই মূল্যবান কি-না তা যাচাই করে দেখা। যাদের কাছে খ্যাতি মূল্যবান তারা খ্যাতির জন্য অর্থ ত্যাগ করে, যাদের কাছে অর্থ মূল্যবান তারা অর্থের জন্য খ্যাতি ত্যাগ করে। কেউ দুধ বিক্রি করে মদ খায় কেউ বা মদ বিক্রি করে দুধ খায়। আসলে খ্যাতি কিংবা অর্থ, মদ কিংবা দুধ ইত্যাদি কোন বস্তুই মূল্যবান নয়, বস্তুর উপর মূল্য মানুষ নিজেই আরোপ করে। মানুষ স্বর্ণকে মূল্যবান মনে করে বলেই তা মূল্যবান। বাস্তবে স্বর্ণ মূল্যবান ধাতু হবার কোন কারণ নেই। স্বর্ণ মানুষের কোন ভোগেই আসে না, স্বর্ণ খাওয়া যায় না, পান করা যায় না, এটি শরীরকে শীত বা তাপ থেকেও রক্ষা করে না, স্বর্ণ গলায় দিলে কোন আরামও লাগে না। তবুও স্বর্ণ অতি মূল্যবান ধাতু হবার কারণ, মানুষ স্বর্ণের উপর মূল্যটি আরোপ করেছে। বস্তুর মূল্য নির্ভর করে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির উপর। তাই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলে বস্তুর মূল্যও পরিবর্তন হয়। আজ যাকে আমরা খুব মূল্যবান বলে মনে করছি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলে হয়তো একদিন তাই মূল্যহীন মনে হবে। সুতরাং ত্যাগের পাঠ নিতে হলে প্রথমে দৃষ্টিভঙ্গিতে রূপান্তর আনতে হবে।

ত্যাগ হচ্ছে তোমার মধ্যে লীন হবার জন্য ‘আমার বোধ’ ত্যাগ। চিরন্তনের মধ্যে লীন হবার জন্য ক্ষণিকের ভালোলাগা ত্যাগ। পরম আনন্দের জন্য আরাম-আয়েস বিলাসিতার ত্যাগ। ‘আমার প্রিয় বস্তু’ মানুষকে বন্দী করে রাখে নিঃসঙ্গতার বন্দীশালায়। তাই ‘প্রিয় বস্তু’ ত্যাগের মাধ্যমে মুক্তি মেলে এ বন্দীশালা থেকে।

পৃথিবী আজ ভোগবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। মানুষ ভোগের জন্য লালায়িত হচ্ছে, ভোগ করছে আর ছুটছে ভোগ্য বস্তুর অন্বেষণে, উন্মাদের মতো। ভোগবাদীদের যুক্তি - জীবন একটাই।  সুতরাং যেভাবে পার এ জীবনকে ভোগ কর। এ পৃথিবীতে যা কিছু আছে তার সবই মানুষের ভোগের জন্য। তাদের দৃষ্টিতে ব্যক্তি ভোক্তা, পৃথিবীর সবই ভোগ্য বস্তু। মানুষের পারস্পরিক সংযোগও এখন ভোগের নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। যে ভোগে আসে না বা আসবে না তার সাথে ভোগবাদীরা সম্পর্ক রাখে না। ভোগবাদের মূল বিষয় হচ্ছে ‘আমার’। ভোগবাদী মানুষ এখন ‘চাই চাই’ ব্যাধিতে আক্রান্ত।

ভোগবাদের এই চরম প্রতাপের যুগে শুধু কোন একটা অঞ্চল, জাতি বা ধর্মে নয়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সারা বিশ্বে বৎসরে অন্তত একটি দিন “আন্তর্জাতিক ত্যাগ উৎসব” পালন করা দরকার। বৎসরে একটি দিন আমরা আনন্দের সাথে ত্যাগ করবো এবং ত্যাগ করে আনন্দিত হবো। জাতি-ধর্ম-বর্ণ পরিচয় নির্বিশেষে সমগ্র মানব জাতি অংশগ্রহণ করবে এই ত্যাগ উৎসবে। ত্যাগ উৎসব হবে ধর্মনিরপেক্ষ ধর্মাচরণ। ত্যাগের ধর্মোৎসবে থাকবে সকল মানুষের আনন্দ ও প্রীতিময় অংশীদারিত্ব। তাহলে নিশ্চয়ই এই পৃথিবী হবে সত্য ও সুন্দর পৃথিবী, শন্তির পৃথিবী।

আমাদের চেতনায় সত্য এবং সুন্দরের বসতি হোক। আমরা হয়ে উঠি জ্যোতির্ময়ের জ্যোতিতে জ্যোতির্ময়। ত্যাগের আদর্শে উজ্জীবিত করি নিজেকে। নিজের ভেতরে প্রতিষ্ঠিত করি সত্যের অনড় শেকড়। ত্যাগের পথ ধরে যাত্রা করি শান্তিময় জীবনের দিকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন