মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৩

জীবন নিয়ে খেলা !

জীবন নিয়ে খেলা !

শেখ সাহিদ ॥ জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ওষুধ আমদানির চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই বেআইনিভাবে এসব পণ্য আমদানি করেছে। স্বাক্ষর জাল ও ভুয়া চালান দাখিল করে গত দুই বছরে দেশের বিভিন্ন কাস্টম হাউস দিয়ে 'জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ' মানহীন এসব পণ্য খালাস হয়েছে। এর সঙ্গে কাস্টমস কর্মকর্তাদের যোগসূত্র রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবি আর) অধীনে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের এক তদন্তে জালিয়াতির এ ঘটনা ধরা পড়েছে। শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা অভিযুক্ত ব্যবসায়ীদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জব্দ করে প্রমাণ পেয়েছেন, গত দুই বছরে ৫৯৮টি চালান খালাস হয়েছে, যার সবই ভুয়া। ঔষধ প্রশাসন কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষর জাল করে, ভুয়া ছাড়পত্র দাখিল করে এগুলো খালাস করা হয়েছে। ঢাকা কাস্টম হাউস, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস, কমলাপুর আইসিডি, বেনাপোল কাস্টম হাউসসহ দেশের সব শুল্ক বন্দর দিয়ে এসব পণ্য খালাস করা হয়েছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা এ রকম ১৫৮টি আমদানিকারকের নাম খুঁজে পেয়েছেন, যারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষর নকল করে অতি প্রয়োজনীয় এসব ওষুধপণ্য দেশে এনেছে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১১ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুলাইয়ের মধ্যে ইনফিউশন সেটের ৫৯৮টি চালান খালাস হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এ তো শুধু জালিয়াতি নয়, জীবন নিয়ে খেলা। পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক ফাঁকি দেওয়া কিংবা মিথ্যা ঘোষণার নজির আমাদের দেশে বিরল নয়। কিন্তু জীবন রক্ষাকারী ঔষধ নিয়ে এতো বড় জালিয়াতি কি করে হয়? আমদানিকারকরা নিয়ম অনুযায়ী ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের ছাড়পত্র তো সংগ্রহ করেইনি, উপরন্তু কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষর জাল এবং ক্ষেত্রবিশেষে ভুয়া একদিন-দু'দিন নয়; টানা দুই বছর ধরে তারা এই অপকর্ম চালিয়ে গেছে! জালিয়াতির এই ঘটনা নিয়মিত নজরদারিতে ধরা পড়েনি কেন? শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরে অভিযোগ আসার পরই কেবল তদন্ত টিমটি গঠিত হয় এবং কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে এই আজদাহা বের হয়ে আসে। এ প্রসঙ্গে এমন প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয় যে, জালিয়াত প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমদানি নথিপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষাকারীদেরও একটি অংশ যুক্ত ছিল। দুই বছর ধরে দেড় শতাধিক প্রতিষ্ঠান ভুয়া কাগজপত্র ও স্বাক্ষর দেখিয়ে চিকিৎসা উপকরণের মতো স্পর্শকাতর পণ্য আমদানি করে গেছে, আর তারা কিছুই ধরতে পারেননি বিশ্বাস করা কঠিন। অভিযোগের পরই কেবল জালিয়াতির এত বড় ঘটনাটি ধরা পড়া খোদ শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তোলে। রাষ্ট্রীয় অর্থে পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠান তা হলে করছে কী? আমরা চাই, আমদানি নথিপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্তদেরও বিস্তৃত তদন্তের আওতায় আনা হবে। জবাবদিহি করতে হবে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরকেও। জালিয়াত আমদানিকারকদের তো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিকল্প নেই। অনেক সময় দেখা যায় তদন্ত হয়, মামলাও হয়; কিন্তু দুর্বল অভিযোগপত্র ও সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে ছাড় পেয়ে যায় অপরাধীরা। এ ক্ষেত্রে এর পুনরাবৃত্তি আমরা দেখতে চাই না। শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর এবং ঔষধ প্রশাসনের উচিত হবে, জালিয়াত আমদানিকারকদের নাম-পরিচয়ও জনপরিসরে প্রকাশ করা। জনস্বার্থেই এদের চিহ্নিত হওয়া প্রয়োজন রয়েছে। সবাই স্বীকার করবেন, চিকিৎসা উপকরণ আমদানির বিষয়টি আর দশটা পণ্য ব্যবস্থাপনার মতো নয়। এর সঙ্গে দেশের বিপুল মানুষের জীবন-মৃত্যুর বিষয়টি জড়িত। সিরিঞ্জ কিংবা অস্ত্রোপচার যন্ত্রপাতি মানসম্মত না হলে চিকিৎসকের দক্ষতা ও আন্তরিকতাও বিফলে যেতে বাধ্য। আলোচ্য আমদানিকারক ও তার সহযোগীরা সাধারণ জালিয়াত হতে পারেন না, তারা জনবিরোধী অপরাধী। তদন্ত ও মামলা প্রক্রিয়া এবং জালিয়াতির পুনরাবৃত্তি রোধে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সময় সংশ্লিষ্টদের তা মনে রাখতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন