বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০১৩

গণ জাগরণের পথ ধরে - আওয়ামী লীগকে হাঁটতে হবে


গণ জাগরণের পথ ধরে

আওয়ামী লীগকে হাঁটতে হবে

 
সংলাপ ॥  মুসলিম লীগ নামক দলটির নেতৃত্বে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল-এ কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু এর মাত্র ৭ বছর পর ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের মানুষের সাথে মুসলিম লীগের সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছিল। ওই নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছিল মুসলিম লীগের। এর পরের ইতিহাস সবার জানা।

এদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম থেকে শুরু করে অসংখ্য গণআন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দল যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ- সেকথাটি অস্বীকার করারও কোনো উপায় নেই। অথচ ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে জনগণের অকুন্ঠ সমর্থনে ভূমিধ্বস বিজয় অর্জনকারী এই দলটির নেতাদের সাথে সাধারণ জনগণের বিচ্ছিন্নতা এখন যে পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে তা উদ্ধার করতে না পারলে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কি ক্ষমতায় আবার আসতে পারবে? নাকি আগামী দিনগুলোতে আওয়ামী লীগের অবস্থা মুসলিম লীগের মতো হবে? এমন প্রশ্ন ও শংকা এখন অত্যন্ত জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে সচেতন মহলে, বাংলার আকাশে-বাতাসে সর্বত্র।

এমন অবস্থা কেন হলো? এর থেকে উত্তরণের উপায় কি? এই অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো প্রয়োজনই বা আছে কি? বাংলাদেশে স্বাধীন ও মুক্ত চিন্তা-চেতনাসম্পন্ন বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফার একটি বিখ্যাত উক্তি এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যার মূল কথা হচ্ছে এই যে, আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় যায় তখন সমাজের নগণ্য সংখ্যক লোক আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়, আর আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতাচ্যুত হয় তখন দুর্যোগ নেমে আসে সাধারণ মানুষের জীবনে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানীরা সব নিয়ে গেছে, রেখে গেছে চোরগুলোকে। ‘যে দিকে তাকাই, দেখি শুধু চোর। ‘আমি ভিক্ষা করে নিয়ে আসি, আর চাটার দলেরা সব খেয়ে ফেলে। এই চোর আর চাটার দলের কারণেই  আজকে দেশের অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ওই চোর আর চাটার দলেরা দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে তৈরি করেছে ভয়াবহ রকমের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। তারা ধর্মান্ধদের সাথে?হাত মিলিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে অবস্থান তৈরি করে বর্তমানে আওয়ামী লীগ-নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারকেও বেকায়দার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। যা থেকে উত্তরণ ঘটাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলের অপপ্রচারে নিরুৎসাহিত না হয়ে এবং ভেদাভেদ ও অন্তঃকলহ ভুলে জনগণের আস্থা অর্জনে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী করে মহাজোট সরকারের কাছ থেকে যেমন একটি দেশ প্রত্যাশা করেছিল জনগণ তা পুরাপুরি বাস্তবায়িত হতে না দেখে তারা এখন চিন্তিত। সরকারের নীতি-নির্ধারকরাও এখন জনগণের চিন্তার কথা বুঝতে পারছেন কিনা তা সময়?বলে দেবে। অনেক ক্ষেত্রে উন্নয়ন কর্মকা- থাকলেও এই মহাজোট সরকারের  প্রতি সাধারণ মানুষের চিন্তার কারণ বের করার চেষ্টা চলছেও বলে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এত জনপ্রিয় ও বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে এসে সরকারের অবস্থাটি আজ এমন কেন হলো তা খতিয়ে দেখে উত্তরণের পথ খোঁজার কাজটি করতে হবে অত্যন্ত সতর্কতা ও আন্তরিকতার সাথে। বঙ্গবন্ধু এক বিদেশী সাংবাদিককে বলেছিলেন, ‘আমার যোগ্যতা হচ্ছে এই যে, আমি এদেশের মানুষকে ভালোবাসি। এ কথা ভুলে যাওয়া সমীচীন নয় যে, বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী খন্দকার মোশতাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুররা ৭৫-এর ১৫ আগষ্টের আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর অতি কাছেই অবস্থান করতো। বর্তমানেও  আওয়ামী লীগ-নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারকে চুড়ান্তভাবে ব্যর্থ করার জন্য এই ধরনের ষড়যন্ত্রকারীর অভাব নেই এবং তারা বেশ সফলভাবেই সক্রিয় রয়েছে। দলটি বর্তমানে যেভাবে চলছে তা থেকে ঘুরে না দাঁড়ালে আগামী নির্বাচনে এই দল কয়টি আসন পাবে তা নিয়ে অনেক মুখরোচক কথাই এখন বিভিন্ন মহলে উচ্চারিত হচ্ছে।  জাতির বিবেকবান ও সচেতন মহল চাইছে, আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে এর নীতি-নির্ধারকদেরকে এখন জরুরি ভিত্তিতে নিম্নলিখিত কর্মপন্থাগুলো বাস্তবায়ন করা দরকার-

বর্তমানে সরকার ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে যে নব্য রাজাকাররা জায়গা করে নিয়েছে তাদেরকে চিহ্নিত করে সরকার ও দল থেকে বের করে দিতে হবে।

সরকার ও দলে সততা ও দক্ষতার মূল্যায়ন করে নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বের স্থান করে দিতে হবে যাতে তারা দেশ ও সমাজের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিয়ে কর্মপন্থা তৈরি করতে পারেন।

দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সারা দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সর্বোচ্চ শাস্তির জন্য আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে হবে। শাহবাগের গণজারণ মঞ্চ-এর আন্দোলনকারীদেরকে শত্রু না ভেবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তাদের চলমান আন্দোলনে সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। এরশাদ কোনোদিন গণজাগরণ মঞ্চকে সমর্থন দিতে পারে না। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পুরোটাই হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষে ছিলেন। ১৯৭১-এর ৯ মাসে তিনবার তিনি পাকিস্তান থেকে ঢাকা এবং রংপুর গিয়েছেন। কিন্তু বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ তার মধ্যে কোনো আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। আরও ভুলে গেলে চলবে না যে, এদেশের ছাত্র-শ্রমিকসহ সব কয়টি রাজনৈতিক দলের দীর্ঘদিনের গণআন্দোলন তথা এরশাদ-বিরোধী গণজাগরণের মুখে ১৯৯০-এর ডিসেম্বরে একজন স্বৈরাচার হিসেবে ক্ষমতা থেকে তার পতন হয়েছিল। ফলে যেকোন গণজাগরণকে এরশাদ ভয় পাবেন-এটাই স্বাভাবিক।

স্মরণ রাখা দরকার যে, ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে জয়লাভের পেছনে একটি বড় ধরনের নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। তখন ষড়যন্ত্রকারীরা গুজব ছড়িয়েছিল এইভাবে যে, জাহানারা ইমাম আন্দোলনে সফল হলে এদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব চলে যাবে, ঠিক তেমনি এখনকার নব্য রাজাকাররা গুঞ্জন ছড়াচ্ছে যে, গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা আন্দোলনে সফল হলে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের নেতৃত্বও চলে যাবে।  যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার বাধাগ্রস্ত করার জন্য হেফাজত ইসলামের নামে যে সংগঠনটিকে এখন নামানো হয়েছে সেটি নতুন কিছু নয়, জামাতেরই একটি সহোদর সংগঠন মাত্র। বহুদিন আগে থেকেই এই নামের সংগঠন চট্টগ্রামে কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল। বর্তমানে শুধুমাত্র যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে আগের চাইতে আরও অনেক বেশি অর্থ-সম্পদে পুষ্ট হয়ে ধর্মের নামে মাঠে নেমেছে। এদেশের ধর্মভীরু মানুষকে বিভ্রান্ত করে যুদ্ধাপরাধ ইস্যু থেকে তাদের দৃষ্টি সরানোর জন্যই হেফাজত এখন ব্লগার-নাস্তিক প্রসঙ্গ তুলেছে। একাত্তরের রাজাকারসহ পাকিস্তানী বাহিনীর সকল দোসররা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে যে ‘দুস্কৃতিকারী, ‘দুর্বৃত্ত,ভারতের অনুচর, ‘অনুপ্রবেশকারী বলতো সে কথাটিও আজ স্মরণ রাখা দরকার। একটা কথা আজ স্বতঃসিদ্ধই যে, আওয়ামী লীগই আওয়ামী লীগের শত্রু। আর সে আওয়ামী লীগে আজ নব্য রাজাকাররা যেভাবে ঘাপটি মেরে বসেছে তা থেকে দলটিকে সাফ করতে না পারলে দেশে আবারও বিপর্যয় নেমে আসবে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দীর্ঘ ২১ বছর পরে হলেও মানুষ আওয়ামী লীগের প্রতি তাকিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি এদেশের জনগণের নাড়ীর টান। এ চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার কারণেই তারা আজ একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক। অথচ এবার নির্বাচনের মাধ্যমে দলটি জনগণ থেকে পুরোপুরি ছিন্ন হওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে আওয়ামী লীগের ভেতরকার সমস্যাদির জন্য।

শাহবাগে এ বছর ৫ই ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া গণজাগরণ মঞ্চ এদেশের গণমানুষ ও বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমে নতুন করে আকৃষ্ট করেছিল। যারা ১৯৫২, ৬২, ৬৬, ৬৯, ৭১, ৯০ দেখেননি তারা এবার তা শাহবাগে দেখেছে ২০১৩-এ এসে। এই গণজাগরণকে এরশাদ ভয় পাবে, জামাত-হেফাজতিরা একে নাস্তিক-মুরতাদ ঘোষণা করাকে ধর্মের কাজ হিসেবে জাহির করতে চাইবে-এটাই স্বাভাবিক। ‘দুষ্ট লোকের মিষ্ট কথায় কখনো ভুলিতে নাই-এ উপদেশমূলক বাক্যটি বাংলার প্রবাদেই আছে।

একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে যে মামলা চলছে তার শুধু রায় নয়, অনতিবিলম্বে সেই রায়ের বাস্তবায়ন দেখতে চায় জাতি, বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম যারা ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোটকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করার পেছনে নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। এই মামলা ও এর রায় কার্যকর করা নিয়ে যেকোনো টালবাহানা এদেশ ও বর্তমান সরকারের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে।  

সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ এবং এর চেতনা  সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া এখন সময়ের দাবি। বর্তমানে ছাত্রলীগ-যুবলীগ নামের যে সংগঠন আছে সেগুলো দিয়ে যুদ্ধাপরাধবিরোধী গণজাগরণ তৈরি করা কোনো মতেই সম্ভব নয়-এ কথা এরা নিজেরাও জানে। তারা ছাত্রদল-যুবদলের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে।  এদের একমাত্র লক্ষ্যই হচ্ছে ক্ষমতায় থাকা এবং ক্ষমতায় যাওয়া। অপরদিকে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা ক্ষমতা চায়না। এরা ১৯৬৯, ৭১-এর সেই মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরাধিকার যারা দেশ ও মানুষের জন্য নিজেকে অকাতরে বিলীন করে দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে। যাদের ডাকে ২০১৩-এ এসেও এদেশের মুক্তিকামী সকল মানুষ শাহবাগে সমবেত হয়েছিল এ বছর ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে। যুদ্ধাপরাধীদের সাথে কোনো আপোষ না করে এবং গণজাগরণের পথ ধরে আওয়ামী লীগকে আবারো সঠিক পথে ফিরে আসতে হবে দেশ ও জাতির জন্য। যুদ্ধাপরাধী ও ধর্মান্ধ শক্তির সাথে আপোষের রাজনীতির জন্য আওয়ামী লীগের জন্ম নয়। ওই রাজনীতির ধারক-বাহক বিএনপি, জাতীয় পার্টি বা জামাতই এর জন্য যথেষ্ট।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন