মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই, ২০১৩

অত্যাচারীর রেহাই নাই



অত্যাচারীর রেহাই নাই

সংলাপ ॥ অতি+আচার=অত্যাচার। যেসব চালচলন ও ব্যবহারে ‘অতি যুক্ত হয়ে নিজের কিংবা অন্যের ক্ষতির কারণ হয় তা-ই অত্যাচার।  যেমন, অপরিমিত বা অত্যধিক আহার বিহার পরিশ্রম ইত্যাদি শরীরের উপর অত্যাচার। যে কোন কর্ম নিজের বা অন্যের ক্ষতির কারণ হলে তা অত্যাচার হয়। কে কখন কী কতটুকু গ্রহণ-বর্জন করতে পারবে তার একটা সীমা আছে। এ সীমা নির্ধারিত।  নির্ধারিত সীমাই অসীমের প্রমাণ ও পরিচয়। সীমালঙ্ঘন মাত্রই অত্যাচার। নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করলে, আচার ‘অতি দোষে দুষ্ট হয়ে অত্যাচারে পতিত হয়। অত্যাচার একটা ‘পতিত অবস্থা যদিও কিছুকাল এর দম্ভ ও উত্থান বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। তাই কুরআন বলছে - ‘কেবল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে যারা মানুষের উপর অত্যাচার করে আর পৃথিবীতে অহেতুক বিদ্রোহ করে বেড়ায়। তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি। (৪২ সুরা শুরা:৪২)। আর, আমি কোন জনপদকে কখনও ধবংস করি না যতক্ষণ পর্যন্ত না তার অধিবাসীরা অত্যাচার (সীমালঙ্ঘন) না করে। (২৮ সুরা কাসাস:৫৯)।
আমরা বাস করছি অত্যাচারের সমুদ্রে। ঘরে-বাইরে অত্যাচার। ভেতর-বাহির, পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণে অত্যাচার চলছে তো চলছেই। প্রত্যেকেই সুযোগ পেলে কম-বেশি অত্যাচার  করছি - নিজের উপর, পরিবারের উপর, দেশের উপর, মানুষের উপর, প্রকৃতির উপর।
চিকিৎসক সেবার নামে রোগীর উপর অত্যাচার করছেন অহেতুক রোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষা চাপিয়ে।  শিক্ষিক ছাত্রদের উপর অত্যাচার করছেন কোচিং বাণিজ্য করে। ব্যবসায়ীরা খাদ্যে বিষ মিশিয়ে অত্যাচার করছেন ভোক্তাদের। ফুটপাত দখল করে বিক্রেতারা অত্যাচার করছে পথচারীদের। সরকারী দল অত্যাচার করছে বিরোধী দল ও জনগণের ওপর। বিরোধী দল অত্যাচার করছে সরকারী দল আর জনগণের ওপর। স্বামী অত্যাচার করছে স্ত্রী-কে, স্ত্রী অত্যাচার করছে স্বামীকে। পিতা-মাতা সন্তানের ওপর অত্যাচার করছে। সন্তান বড় হয়ে অত্যাচার করছে পিতা-মাতাকে। ধনীরা ধন-সম্পদ কুক্ষীগত করে অত্যাচার করছে গরিবদের। মোদ্দা কথা - যে যে স্তরে অবস্থান করছে সে স্তর থেকেই তার পক্ষে যতটুকু সম্ভব ততটুকু অত্যাচার সে চালিয়ে যাচ্ছে অন্যের ওপর। নিজের ওপর তো বটেই। প্রাবল্যই অত্যাচারের মূল কারণ। যে যেখানে প্রবল সে সেখানে দুর্বলের উপর অত্যাচার করে। অত্যাচারে প্রণোদনা দেয় - অর্থের লোভ, ক্ষমতার লোভ, হিংসা, ধর্মীয় বিদ্বেষ, ক্রোধ।
যে কোন প্রকারে অন্যের ধন-সম্পদ আত্মসাৎ করা, শ্রমিককে শ্রমের প্রকৃত মূল্য না দেয়া, মানুষকে কষ্ট দেয়া, মিথ্যা বলা, ওজনে কম দেয়া, ভেজাল দেয়া, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা ইত্যাদি সবকিছুই অত্যাচারের অর্ন্তভূক্ত। অত্যাচারের প্রশস্ত রূপ রাষ্ট্র শাসনে। যে শাসক মানুষের জান-মাল-ইজ্জতের নিরাপত্তা দিতে পারে না কিন্তু নিজের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ বাহিনী পোষে সে শাসক অত্যাচারী। যে শাসক জনগণের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে না কিন্তু নিজের সন্তানকে বিদেশে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে, যে শাসক জনগণের হক আদায় করে না, জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা দেয় না, সবল ও দুর্বলের মধ্যে সমতা রক্ষা করে না, স্বার্থপ্রণোদিত আচরণ করে -  সে অত্যাচারী শাসক। কষ্টকর বিষয় হলো - আমরা এমন একটা সমাজে বাস করছি যে সমাজে যে যত বেশি অত্যাচারী সে ততবেশি ক্ষমতা ও ধন-যশের মালিক হয়। দুর্বলরা অত্যাচার সইতে সইতে এতোই অভ্যস্ত হয়েছে যে অত্যাচার করে না এমন কোন ব্যক্তিকে তারা নেতা বা শাসক মনোনীত করে না। অত্যাচার এখন কোন অপরাধ হিসেবে তো গণ্য হয়ই না, বরঞ্চ যে অত্যাচার করে না তাকে দুর্বল, বোকা, ভীতু, বেচারা,  হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
কুরআন নিজের উপর এবং অন্যের উপর যে কোন রকম অত্যাচারকে হারাম করেছে। যে কোন মানুষ, এমনকি জীব, জন্তু, পশু, পাখি ও প্রকৃতির উপর অত্যাচার করাও হারাম। শুধু অত্যাচার করা নয়, অত্যাচারীকে সহযোগিতা করা, অত্যাচারীর সাথে সম্পর্ক রাখা এমনকি অত্যাচার নীরবে সহ্য করাও হারাম। কুরআন বলছে - ‘আর তোমরা অত্যাচারীদের প্রতি ঝুঁকে পড়বে না, অত্যাচারীদের সহযোগি হবে না, তাহলে আগুন (জাহান্নামের) তোমাদেরও স্পর্শ করবে (১১ সুরা হুদ:১১৩)। কুরআনের মোট একশ চৌদ্দটি সুরার মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ সুরায় অত্যাচার থেকে বিরত থাকার নির্দেশ আছে। বাংলাদেশ মুসলমান অধ্যুষিত দেশ। এদেশে মুসলমানদের সংখ্যা বাহুল্যের জন্য আমরা গর্ব করি। এটাও একটা অত্যাচার বটে। যারা যে ধর্ম মানে না, তা মানে বলে দাবি করা সে ধর্মের ওপর অত্যাচার।
যতক্ষণ অত্যাচার করার প্রবণতা থাকে ততক্ষণ কেউ আল্লাহকে স্মরণ করার যোগ্য হয় না। অত্যাচারীর জন্য আল্লাহ্‌কে স্মরণ না করাই উত্তম। আল্লাহ তায়ালা রসুল (সা.)-কে বলেন - ‘অত্যাচারীকে বলে দাও, সে যেন আমাকে স্মরণ না করে। কারণ যে ব্যক্তি আমাকে স্মরণ করে, আমিও তাকে স্মরণ করি। আর অত্যাচারীকে স্মরণ করার অর্থ হলো তার উপর আমার অভিশাপ বর্ষণ করা। অত্যাচারিত ব্যক্তি ক্ষমা না করা পর্যন্ত অত্যাচারী আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হতে পারে না। যে অত্যাচার করে সে অত্যাচার পাবে, যে দয়া করে সে দয়া পাবে - এটাই বিধাতার বিধি।
আল্লাহ তায়ালা অত্যাচারীকে কিছু সময় পর্যন্ত অবকাশ দিয়ে থাকেন। অবশেষে যখন পাকড়াও করেন তখন তাকে আর রেহাই দেন না।  সুরা ইব্রাহিমে বলা হয়েছে - ‘অত্যাচারীদের কর্মকান্ড সম্পর্কে আল্লাহকে কখনও উদাসীন মনে করো না। তবে তিনি তাদের শুধু একটি নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত অবকাশ দেন, যেদিন চক্ষুসমূহ বিস্ফারিত হবে, তারা মাথা ঊর্ধ্বমুখী করে উঠিপড়ি করে দৌড়াতে থাকবে, তাদের চোখ তাদের নিজেদের দিকে ফিরবে না এবং তাদের হূদয়সমূহ দিশাহারা হয়ে যাবে। মানুষকে আজাব সমাগত হওয়ার দিন সম্পর্কে সাবধান করে দাও, যেদিন তাদের কাছে আজাব আসবে। সেদিন অত্যাচারীরা বলবে, হে আমাদের প্রভু! অল্প সময়ের জন্য আমাদের অবকাশ দিন, তাহলে আমরা আপনার ডাকে সাড়া দেব (অন্যের ওপর অত্যাচার করব না) এবং রাসুলদের অনুসরণ করব। তোমরা কি ইতিপূর্বে কসম খেয়ে বলতে না যে তোমাদের পতন নেই! যারা নিজেদের ওপর অত্যাচার করেছে, তোমরা তো তাদের বাসস্থানেই বাস করছ এবং সেসব অত্যাচারীর সঙ্গে আমি কেমন আচরণ করেছি, তা তোমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। উপরন্তু আমি তোমাদের জন্য বহু উদাহরণ দিয়েছি (১৪ সুরা ইব্রাহিম:৪২-৪৫)। সুরা শোআরার শেষ আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘যারা অত্যাচার করে তারা শীঘ্রই জানতে পারবে তাদের যাবার জায়গা কোথায়। তাই কেউ যদি তার কারো ওপর অত্যাচার করে থাকে, তবে এখনই তার কাছ থেকে ক্ষমা নেয়া উচিত, ক্ষতিপূরণ দেয়া উচিত এবং সেই ভয়াবহ দিন আসার আগেই এটা করা উচিত, যেদিন টাকা-কড়ি দিয়ে কোন প্রতিকার করা যাবে না, বরং অত্যাচারীর কাছে কোন পুণ্য থাকলে তার অত্যাচারের পরিমাণ হিসাবে অত্যাচারিতকে উক্ত পুণ্য দিয়ে দেয়া হবে এবং অত্যাচারীর আর কোন অসৎ কাজ না থাকলেও অত্যাচারিতের অসৎ কাজ তার ওপর বর্তানো হবে।
মানবপ্রবৃত্তির অসংযত কাম-ক্রোধ, লোভ, মদ-মাৎসর্য থেকেই অত্যাচারের জন্ম। তাই শিষ্টাচার, সহিষ্ণুতা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, সহাযেগিতা ও সহমর্মিতার চর্চাই পারে অত্যাচারকে প্রতিরোধ করতে। কুরআন অত্যাচারকে প্রতিরোধ করার যে ব্যবস্থাপত্র দিয়েছে তা সিয়াম বা সংযম। নির্ধারিত সীমানাতে সন্তুষ্ট থাকার চর্চা করাই সিয়াম।
অত্যাচারই অশান্তি ও দুঃখের মূল কারণ। ব্যক্তিক, সামাজিক, আর্থিক ও রাষ্ট্রিক জীবন অত্যাচারমুক্ত হলে মানবজাতির কোন দুঃখ-কষ্ট থাকতো না। মানুষের মধ্যে অত্যাচার প্রতিরোধচেতনা জাগ্রত হলে মানবিক সমস্যাবলীর সমাধান হতো। অত্যাচারীকে প্রতিহত না করলে তার উদ্ধত্ত্য বেড়ে যায়। তাই বাধাহীন ভাবে অত্যাচারীকে অত্যাচার চালিয়ে যেতে দেয়া যায় না। অত্যাচারীর বিরুদ্ধে ‘সীসা ঢালা প্রাচীরের মতো অবিচল থেকে যে প্রচেষ্টা করে সে-ই মোমেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন