পরিত্রাণ কি কোন ধর্মের একচেটিয়া
অধিকার?
দিগন্ত
॥ কোন একটা বিশেষ ধর্ম যখন ঘোষণা করে যে, যারা সেই ধর্মের অনুসারী হবে না তাদের ধ্বংস
অনিবার্য, তারা সৃষ্টিকর্তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য যত প্রচেষ্টাই করুক না কেন, যত ন্যায়পরায়ণ
ও সত্যবাদীই হোক না কেন তারা নিশ্চিতভাবে জাহান্নামী হবে তখন অন্য ধর্মের অনুসারীদের
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে। এই ধরণের কট্টর, সংকীর্ণ ও অসহিষ্ণু ঘোষণার ফলে সমাজে
উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং সামপ্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি হয়। দুঃখজনক যে, এখন ধর্মান্ধ মুসলমানরা
বেশ দৃঢ়তার সাথেই একই দাবি করে। ধর্মান্ধরা বলে - মোহাম্মদ (সা.) -এঁর অনুসারীগণ ব্যতীত
অন্য কেউ বেহেস্তে যাবে না। তাদের মতে মোহাম্মদ (সা.) এর আবির্ভাবের পর যারা ইসলাম
গ্রহণ না করে মারা যায় তাদের কোন পরিত্রাণ নেই, তারা অনন্তকাল জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে।
কুরআন সাক্ষী দেয় অতীতে ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা এমন দাবি করতো। এ বিষয়ে সুরা বাকারার ১১১,
১১২ এবং ১১৩ নং আয়াতগুলো বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। যেখানে বলা হয়েছে- “এবং তারা বলে,
ইহুদি বা খ্রিষ্টান ছাড়া অন্য কেউ বেহেস্তে প্রবেশ করতে পারবে না।’ এটি তাদের মিথ্যা আশা। বল! ‘যদি তোমরা সত্যবাদী
হও, তবে প্রমাণ পেশ কর’। হ্যাঁ, যে কেউ আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণরূপে
আত্মসমর্পণ করে এবং সৎ পরিশ্রমী হয় তার ফল তার প্রতিপালকের কাছে রয়েছে এবং তাদের কোনো
ভয় নেই ও তারা দুঃখিত হবে না। ইহুদিগণ বলে, খ্রিষ্টানদের কোনো ভিত্তি নেই; খ্রিষ্টানগণ
বলে, ইহুদিদের কোনো ভিত্তি নেই। অথচ তারা সবাই আল্লাহর কেতাব পাঠ করে। এভাবে যারা কিছুই
জানে না তারাও অনুরূপ কথা বলে। সুতরাং যে বিষয়ে তাদের মতভেদ আছে কিয়ামতের দিন আল্লাহ
তার মীমাংসা করবেন।”
“ভক্তগণ (মুসলিমগণ), ইহুদি, খ্রিস্টান
ও ছাবেঈনগণ যারাই আল্লাহ ও ভবিষ্যতে (পরকাল) বিশ্বাসী এবং সৎ পরিশ্রমী, তাদের জন্য
পুরস্কার রয়েছে তাদের প্রতিপালকের কাছে। তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা আযাবপ্রাপ্ত হবে
না।” (২ সুরা বাকারাঃ ৬২, ১৭৭) এবং
“যারা ইমান এনেছে (মুসলিম) এবং যারা ইহুদি, সাবেইন, খ্রিস্টান ও অগ্নিপূজক এবং যারা
মুশরিক অবস্থায় আছে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের বিচার-মীমাংসা করবেন। আল্লাহ সমস্ত
কিছুর সাক্ষী।” (২২ সুরা হাজ্জঃ ১৭)।
কুরআন
মতে পৃথিবীতে এমন কোন ধর্ম নেই যে ধর্ম পরিত্রাণের উপর একচেটিয়া অধিকার রাখে। ধর্ম
অনেক কিন্তু আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয়। কোন একটা নিদিষ্ট ধর্মমতের অনুসারী না হলেও যদি
কেউ সৎকাজ করে এবং এক ও অদ্বিতীয় সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস ও নির্ভর করে তবে সে তাঁর
পরিত্রাণ থেকে বঞ্চিত হবে না। বিষয়টি আরও পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে সুরা হাজ্জের ৬৭,
৬৮ ও ৬৯ নং আয়াতে - “আমি প্রত্যেক সমপ্রদায়ের জন্য নিয়মকানুন নির্ধারণ করে দিয়েছি যা
ওরা পালন করে। সুতরাং ওরা যেন তোমার সঙ্গে এ ব্যাপারে বিতর্ক না করে। তুমি ওদেরকে তোমার
প্রতিপালকের দিকে ডাক দাও। তুমি তো সরল পথেই আছ। ওরা যদি তোমার সঙ্গে তর্ক করে তবে
বলো, ‘তোমরা যা কর সে সম্বন্ধে আল্লাহ ভালো করেই জানেন। তোমরা যে বিষয়ে মতভেদ করছ আল্লাহ
কিয়ামতের দিন সে বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবেন।”
একইভাবে
সুরা মায়েদার ৬৯ নয় আয়াতে দৃঢ়তার সাথে বলা হয়েছে - “নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাসী, ইহুদি,
সাবেয়ি ও খৃষ্টান তাদের মধ্যে যে কেউ আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করবে ও সৎকাজ করবে তাদের
কোন ভয় নেই আর সে দুঃখিতও হবে না।”
যারা
ইসলামের পতাকাতলে আসেনি তাদের সবাইকে নির্বিচারে নিন্দা বা ভৎসনা করার বিরুদ্ধে কুরআনের
নির্দেশ হচ্ছে- “তারা সকলে একরকম নয়। তাহলে কিতাবের মধ্যে একদল আছে অবিচলিত। তারা রাত্রিতে
সিজদারত অবস্থায় আল্লাহর আয়াত আবৃত্তি করে। তারা আল্লাহ ও শেষদিনে বিশ্বাস করে, সৎকর্মের
নির্দেশ দেয়, অসৎকর্ম নিষেধ করে এবং তারা সৎকর্মে প্রতিযোগীতা করে। বস্তুতঃ তারাই সৎকর্মশীলদের
অন্তর্ভূক্ত এবং তারা যে কোন সৎকাজই করুক না কেন তাদেরকে প্রতিদানে কখনও অস্বীকার করা
হবে না। বস্তুতঃ আল্লাহ মুত্তাকীদের সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত।” (সুরা আল্- ই ইমরান : ১৩-১৫)। “এবং মুসার জাতির
মধ্যে এমন এক সমপ্রদায় আছে যারা সত্যের সাহায্যে হেদায়াত পাচ্ছে এবং তার সাহায্যে ন্যায়
বিচার করছে।” (৭ সুরা আরাফ : ১৫৯)।
সুতরাং,
কুরআনসূত্রে এটি প্রমাণিত যে, পরিত্রাণ কোন ধর্মের একচেটিয়া ব্যাপার নয়। যে কেউ প্রতিপালকের
কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং সৎ পরিশ্রমী হয় তার ফল তার প্রতিপালকের কাছে রয়েছে এবং তাদের
কোনো ভয় নেই ও তারা দুঃখিত হবে না। এমন কোন প্রমাণ কেউ উপস্থাপন করতে পারবে না যে,
কেবল তার সমপ্রদায়ই পরিত্রাণ পাবে আর অন্যরা বঞ্চিত হবে। আল্লাহর বিধান এই যে, যে কোন
ব্যক্তি তাঁর উপর নির্ভর করলে, তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করলে এবং কর্মের মাধ্যমে তাঁর
প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলে প্রতিদান অবশ্যই পাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন