সত্যের পূজারী -
শক্তিকে সঠিক পথ দেখায়
শাহ্ শাহনাজ সুলতানা ॥ আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর
আগে গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাব হয়েছিল। সেই সময়ে তিনি জোরের সাথে বলেছিলেন- স্ত্রীজাতি
পুরুষের মত আলোকপ্রাপ্ত হতে পারে। তিনি ধর্মের জড়তা ও প্রাচীনতা থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন।
বুদ্ধ বলেছিলেন - যদি দেখো কোন শিক্ষা হিতকারি
নয় এবং বাস্তবক্ষেত্রে তা লোকসান এবং দুঃখকে ডেকে আনে- তাহলে তাকে পরিত্যাগ করো। স্বামী
বিবেকানন্দ ভারতের অধঃপতনের অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি অন্যতম কারণ খুঁজে পেয়েছিলেন,
তা হল - স্ত্রীজাতির অসম্মান। তিনি স্ত্রীজাতির
শিক্ষা ও সম্মান প্রদর্শন এর প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন শুধুমাত্র তাঁর মাতৃভূমি
ভারতকে জাগিয়ে তুলবার জন্য।
আমাদের
দেশে ধর্মবেত্তা ও ধর্মজীবীদের একাংশ মুহম্মদী ইসলাম হতে সংযত দৃষ্টি, সংযমের শিক্ষা
কিভাবে দেয়া যায় তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
সম্ভবত
ব্যক্তি জীবনে তারা ওই শিক্ষা পাননি। পাননি বলেই স্বরোচিত ইসলাম অনুসারে ওয়াজ করে বেড়াচ্ছেন।
তথ্য-প্রযুক্তির
যুগে বাস করে ধর্মান্ধ ধর্মজীবীরা মেয়েদের
মাত্র প্রাইমারী পাস পর্যন্ত রেখে সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসাবে দেখার ফতোয়া দিচ্ছেন।
বাংলাদেশের প্রায় ৩৫ লাখ নারী শ্রমিক বিভিন্ন পোষাক শিল্প কারখানায় কর্মরত আছেন। যারা দেশের অর্থনীতির চাকাকে রেখেছেন
সচল। দেশের বাইরে পুরুষ শ্রমিকদের পাশাপাশী বাংলাদেশী নারী শ্রমিক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে
দেশে পাঠাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। অর্থনৈতিক কাঠামোকে করছে সুদৃঢ়। দেশের প্রধানমন্ত্রী
একজন নারী, বিরোধী দলের নেতা একজন নারী, সংসদের স্পীকার একজন নারী। দেশের বিভিন্ন সরকারি,
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, আদালতে নারীরা তাদের মেধা, যোগ্যতা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে । ঠিক
এমন সময়ে ইসলামের নামে মায়ের জাতকে নিয়ে কটুক্তি এবং অসম্মানজনক ফতোয়া দিয়ে ওয়াজ করার
কারণ জানা দরকার এবং দেশের আইন অনুসারে যথাযোগ্য শাস্তি দেয়া বর্তমান সরকারের নৈতিক
দায়িত্ব যেহেতু আমাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম।।
ইসলামে
নারীর মর্যাদা ও সম্মান দেয়া হয়েছে। সমাজ ব্যবস্থাতে নারী ও পুরুষ উভয়ের যথোপযুক্ত মর্যাদা দান করা হয়েছে । পবিত্র কুরআনে আছে, বিশ্বাসী
নর-নারী পরস্পরের বন্ধু - সহায়ক। (সূরা তওবা -৭১)
হে
ঈমানদারগণ - নারীদিগকে জবরদস্তি তোমাদের উত্তরাধিকার গণ্য করা বৈধ নহে। (সূরা নিসা-১৯)
।
ইসলাম
নারীকে দিয়েছে অধিকারের সমতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, উত্তরাধিকারের অধিকার, মোহোরা পাওয়ার
অধিকার, ধর্মীয় মর্যাদা ।
পুরুষ
অথবা নারীর মধ্যে কেহ সৎকাজ করিলে ও মোমিন হইলে তাহারা জান্নাতে দাখিল হইবে এবং তাহাদের
প্রতি অণু-পরিমাণও জুলুম করা হইবে না । (সূরা নিসা - ১২৪)
ধর্মীয়
বিধি বিধান পালনের অধিকার যেমন নারীর আছে তেমনি আছে পুরুষের । এমনকি ফললাভের অধিকারের
ক্ষেত্রে নর-নারীর উভয়ের ভূমিকা সমান।
জ্ঞান-বিজ্ঞান
চর্চায় মহানবী বলেছেন - জ্ঞান অন্বেষণ প্রত্যেক
মুসলিম নর-নারীর জন্য ফরজ ।
অথচ বাংলাদেশ যখন বিশ্বের সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলছে
ঠিক তখন ধর্মান্ধ রাজনৈতিক ইসলামপন্থীরা অশুভ শক্তির বলয়ে থেকে মায়ের জাতের লেখাপড়া
এবং ভোগ্য পণ্য হিসাবে দেখছেন। নারীকে কখনো কি তারা নিজের কন্যা, ভগ্নী, মাতা হিসাবে
দেখতে পেরেছেন? তাদের ঘরে কি মেয়ে আছে? তারা কি কোন মায়ের গর্ভে দশ মাস ছিলেন? নাকি
আসমান থেকে পড়ে বাংলাদেশে আছেন।
বাংলার
যত ভাইরা আছেন-আপনাদের বলছি ওদের কব্জায় মায়ের জাতের যারা আছেন তাদের 'উদ্ধার' করার
জন্য মা-বোনেদের সাথে আপনারাও মাঠে নামুন তবেই দেশে শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠিত হবে।
বাংলার যত পুত্র সন্তানগণ আপনাদের বলছি, বাংলার যত স্নেহময় পিতা- আপনাদের বলছি- শ্রদ্ধা, ভক্তি, স্নেহ
ও মমতার নিবিড় বন্ধনকে আরও দৃঢ় করুন এবং তথাকথিত ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।
ইসলাম শব্দকে অপব্যবহার করার অধিকার বাংলার মানুষ কাউকে দেয়নি। এরাই যুগে যুগে নারীদের
যথাযথ মর্যাদা দেয়নি। এদের কানে কখনো মহাকবি ইকবাল বা সাধক নজরুলের বাণী পৌঁছায়নি ।
'পৃথিবীর তসবির রঙ্গিন করেছে নারী
জীবন চিত্তের উষ্ণতা তারই সেতারের ধ্বনি।' .... ইকবাল
'বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর ,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।'.... নজরুল
বাংলার
বুকে সূফী সাধকগণ কিভাবে ইসলামের শান্তির বাণী প্রচার করে যাচ্ছেন ধর্মান্ধ ও ধর্মজীবীদের
মধ্যে যাদের চোখ থাকতে অন্ধ, কান থাকতে কালা - তাদের উপলব্ধিতে আসে না।
'কামের
তাড়ণায় মেয়েদের দিকে তাকাসনে। মাতৃভাবে তাকা। দেখবি মুক্তির পথ - শান্তির পথ - দয়াল
লাভের পথ খোলা।' - দয়াল বাবা জোহর আলী শাহানশাহ ।
'আল্লাহ বলেছেন - মুমিনদিগকে বল, তাহারা যেন তাহাদিগের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাহাদিগের
লজ্জা স্থান হিফাজত করে । ইহাই তাহাদের জন্য উত্তম ।' সূরা - নূর ৩০
ঠিক
একইভাবে নারীদের প্রতিও দৃষ্টি সংযত করার নির্দেশ কুরআনে আছে।
দৃষ্টির
ব্যভিচারীতা কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যায় সে পদ্ধতি এইসব ধর্মবেত্তাদের কাছ থেকে শেখা
ও জানা অসম্ভব। কারণ ইসলাম মানে শান্তির বারতা
ওলী সাধকগণ সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন অন্য ধারায়। তা হল নিজেকে জানা। আত্ম
বিশ্লেষণে আত্মসংযম আসে। সাধকদের কাছে না গেলে,
তাঁদের জীবনচরিত পাঠ না করলে সংযমের অনুশীলন কি এবং কিভাবে হয় তা বুঝা সহজ নয়। আদেশ,
উপদেশ এবং নিষেধ এই তিন আবর্তের মধ্যে ফেলে একজন সাধারণ উদাসীন, অন্তর ব্যাধিগ্রস্ত
অমনোযোগী মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যান আত্মউন্নতির ধাপে।
নারীজাতিকে
অমর্যাদাকর অবস্থায় যারা ফেলতে চায় তাদের বিরুদ্ধে নিজেদেরকেই সঠিক ভূমিকা পালন করতে
হবে। আত্ম সচেতনতা আর মান সম্মান কে সামনে
রেখে নারীজাতিকে প্রমাণ করতে হবে - আমি মানুষ । কুরআনে সূরা আন আমে সাধারণ মানুষদের
উচ্চতর গৃহপালিত পশু হিসাবে বলা হয়েছে। যে মানুষদের মধ্যে হুঁশ নেই - তার বিবেচনা
বোধ নেই । ভাল-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা নেই।
সুতরাং তাকে নিম্ন স্তরের জীবজন্তুর মতই জীবনযাপন করতে হবে।
হাক্কানী
সাধকদের কথা - 'স্মরণ রাখবে - তোমার দ্বারা কেউ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।' ক্ষতি অনেকভাবে
করা যায়। বাক শক্তির অপব্যবহার একধরনের ক্ষতি। কুচিন্তার ফসল কুতর্ক। যে কথার দ্বারা
মানুষের চিন্তা কলুষিত হয়, একটা সুস্থ সমাজ অসুস্থ হয়ে যায় - অসুস্থ হয়ে
যায় সেই সমাজে বসবাসরত কোটি জনতা, ভেঙ্গে যায় সম্পর্কের বেষ্টন, উন্নতির পথ হয় রুদ্ধ
তাদের পরিত্যাগ করতে হবে। যে শিক্ষা বাস্তবতা বর্জিত তাকে পরিত্যাগ করতে হবে । সাধক
প্রার্থনা - আমার ভেতরে যে আগুন জ্বলছে , তা
তোমাদের ভেতর জ্বলে উঠুক - তোমাদের চিন্তা ও মুখ এক হোক ।
সাধকদের
কাছে মানুষই সত্য । রানা প্লাজার ধ্বংস স্তুপ থেকে পাঁজাকোলা করে মৃত, অর্ধ মৃত, হাত
বিহীন-পা বিহীন শ্রমিকদের যারা বের করে নিয়ে এসেছে - তাদের কাছে শ্রমিকরা
ছিল মানুষ। নারী পুরুষ ছিলনা ।
আমরা
সত্যকে পূজা করি - শক্তিকে নয় ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন