বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০১৩

ইমামতি পেশা হতে পারে না


ইমামতি পেশা হতে পারে না

 
সাদিকুল হক ॥ ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতি সম্মানের পদ। ইসলামের প্রাথমিক যুগে যারা সমাজের পথপ্রদর্শক হতেন তারাই মসজিদে ইমামতি করতেন। ইমামের দায়িত্ব কেবল নামাজ পড়ানো ছিল না। সমাজনীতি, অর্থনীতি, আল্লাহভক্তদের পারস্পরিক দায়িত্ব-কর্তব্য, শান্তি-শৃঙ্খলা, সভ্যতা-সংস্কৃতিসহ মানবজীবনের নানা বিষয়ে পথপ্রদর্শকগণ প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও নির্দেশনা দিতেন। তখন মসজিদও ছিল শিক্ষা-দীক্ষা ও মানবসেবার কেন্দ্রবিন্দু।

দিনে দিনে অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন ধর্মকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে সেবা, পারস্পরিক সহযোগীতা ও সহমর্মিতার মনোভাব। ইমামদের কর্মতৎপরতা এখন সীমিত হয়েছে মসজিদের চার দেয়ালের মাঝে। ইমাম অর্থ যে নেতা, তিনি যে নেতৃত্ব দেবেন কল্যাণমূলক কাজে, তিনি যে ভাবের সৃষ্টি করে অভাব দূর করবেন তা আমরা একেবারেই ভুলে গেছি। মসজিদের বাইরে ইমামরা এখন ব্যস্ত থাকেন মিলাদ, ঝাড়ফুঁক, বিয়ে, জানাজা নিয়ে। এসব প্রতিটি আনুষ্ঠানিকতায় তারা পুরোহিতদের মতো পারিশ্রমিক গ্রহণ করেন। তাই ইমামতি এখন নিছকই একটা পেশা। ইমামতির নামে একশ্রেণীর মানুষ এখন ধর্মজীবী হয়েছে। বর্তমান কালের অধপতিত মুসলিম সমাজও  মেনে নিয়েছে এই ধর্মজীবী শ্রেণীকে। অনেকেরই ধারণা ইমামরা বেতন না নিলে তাদের সংসার চলবে কী করে? অধিকাংশ মুসলমানরা ধরেই নিয়েছে যে, ইমাম সাহেব যৎসামান্য বেতনে মসজিদে নিয়মিত নামাজ পড়াবেন আর দাওয়াত খেয়ে, টিউশনি করে, মিলাদ পড়িয়ে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করবেন। এ ধারণা চরম অমূলক ও ইসলামের বিরুদ্ধে বড় পাপ। কুরআনে কঠোরভাবে ধর্মকর্মের বিনিময় করতে নিষেধ করা হয়েছে। সকল মুসল্লিরা যেমন নামাজ পড়ে এবং সংসার চালায় ইমামদেরকেও তেমনি করতে হবে। তাই ইমামতি হওয়া উচিত ঐচ্ছিক, জীবিকা উপার্জনের উপায় হিসেবে এটাকে গ্রহণ করা কুরআন বিরুদ্ধ। যে সমাজে যিনি যোগ্যতম তিনি হবেন মসজিদের ইমাম।

অথচ এখন ইমামতি হয়েছে স্বল্প বেতনের একটা অনিশ্চিত চাকরি। অন্যান্য ক্ষেত্রে চাকরি পাওয়া যেমন কঠিন, চাকরি যাওয়াটাও তেমনি কঠিন। ইমামদের বেলায় ব্যাপারটা আলাদা। মসজিদ কমিটি কেবল মুখ খুলে ‘না বললেই ইমামের চাকরি চলে যায়। জীবন নির্বাহের জন্য অন্য কোন দক্ষতা না থাকায় মসজিদ কমিটি কর্তৃক নির্ধারিত যৎসামান্য বেতন-ভাতার ওপর ইমাম সাহেব নির্ভরশীল হওয়ার দরুন তিনি ইচ্ছা করলেও পারছেন না তার আত্মসম্মান রক্ষা করতে। পারছেননা স্বাধীনভাবে বুক ফুলিয়ে সত্য কথাগুলো বলতে। ইমামের মর্যাদা যে সবার ঊর্ধ্বে, ইমাম যে সবার নেতা, এসব বেমালুম ভুলে গিয়ে তিনি হয়ে পড়ছেন মসজিদ কমিটির আজ্ঞাবহ। মান-মর্যাদা বিলিয়ে দিয়ে তিনি মসজিদ কমিটি ও মুসল্লিদের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত। এটা যে একজন ইমামের জন্য এবং দ্বীন ইসলামের জন্য কত লজ্জাকর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু তাই নয়, এ ধরনের ইমামের পেছনে নামাজ কতটুকু শুদ্ধ হবে, তাও ভেবে দেখা প্রয়োজন।

ইমামতি এক মহান দায়িত্ব। যে দায়িত্ব পালন করেছেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে, পালন করেছেন সাহাবা, খলিফা, আমির-ওমরারা, সে দায়িত্ব এখন পালন করছেন স্বল্প বেতনে নিয়োজিত ধর্মজীবীরা! 

আমাদের দেশে বিশেষ করে ঈদের দিন ইমামকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়, ইমামতি পদের মর্যাদাকে ছুড়ে ফেলা হয় মাটিতে। ঈদগাহে সব মানুষকে বসিয়ে রেখে ইমাম সাহেবের সামনেই তার নজরানার জন্য মুসল্লিদের কাছে হাত পেতে সাহায্য নেয়া হয়। এটা বড়ই দৃষ্টিকটু ও অবমাননাকর। বিষয়টি ভিক্ষাসদৃশ। ইমামের উচিত এ খয়রাতি নজরানার প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্য কর্মের মাধ্যমে ঈদের খরচ নির্বাহ করা। তাহলে ইমামের সম্মান কিছুটা হলেও প্রতিষ্ঠিত হতো। ইমামের পদের মর্যাদা এবং ইসলামের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ইমাম এবং মুসল্লিদের উদ্যোগী ও সচেষ্ট হতে হবে। এক্ষেত্রে ইমামের দায়িত্বই বেশি।

নিজেকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে হলে একজন ইমামকে অবশ্যই বেতন-ভাতার ওপর নির্ভরশীল না হয়ে জীবন নির্বাহের জন্য হালাল ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্য কোন পেশা গ্রহণ করতে হবে। দাওয়াত খাওয়া, টিউশনি, মিলাদ পড়া ও ঝাড়ফুঁক দিয়ে টাকা-পয়সা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ইমামের অবশ্যই মাতৃভাষায় গুছিয়ে প্রাঞ্জলভাবে কথা বলার দক্ষতা থাকতে হবে। জুম্মার দিন সমসাময়িক বিষয়ে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য উপস্থাপন করতে হবে। টাকা-পয়সা গ্রহণের ব্যাপারে তাকে থাকতে হবে খুবই সতর্ক। বিশেষ করে দান-খয়রাত গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ইমাম সাহেবের পোশাক হবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ব্যবহারে হবেন তিনি মার্জিত, ভদ্র ও শালীন। ইমামের কথা ও কাজ এক হতে হবে। সত্য বলায় থাকতে হবে সৎসাহস। ইমামকে নিজের কাজ নিজে করতে হবে। যথাসম্ভব পরনির্ভরতা পরিহার করতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে আদর্শ রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের জন্য, আদর্শ ও নীতিবান মানুষ তৈরির জন্য ইমামকে সচেষ্ট হতে হবে। আলোকিত সমাজ ও মানুষ গঠনের জন্য মসজিদকেন্দ্রিক শিক্ষা, চিকিৎসাসহ গণমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করে মসজিদকে কর্মচঞ্চল করে তুলতে হবে। তাহলে ইমামতি যেমন সম্মানজনক হবে তেমনি ইসলাম তার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন