বুধবার, ১১ নভেম্বর, ২০১৫

চিকিৎসা সেবা না মানবিকতা-বধ



চিকিৎসা সেবা না মানবিকতা-বধ

সাগর সগীর ॥ বাবা-মা। ভাই-বোন। ছেলে-মেয়ে। বাড়ী-ঘর। আবার, ছাত্র-ছাত্রী। কিংবা, স্বামী-স্ত্রী। দাদা-দাদী। নানা-নানী। এসবই যুগল শব্দ। একটি উচ্চারণ করতে গেলেই পেছনে জোড়া দশার মত যেমন আরও একটি শব্দটি এসে পড়ে, ঠিক তেমনি চিকিৎসা শব্দটি উচ্চারণ করতে গেলেই এর জোড়া শব্দ হিসেবে যে শব্দটি এসে পড়ে সেটি হচ্ছে ‘সেবা’। সেবা শব্দটির সঙ্গে মানবিক অধিকার, মানবিক সাড়া, মানবিক দায়বদ্ধতার প্রশ্নটি যেন সরাসরি জড়িত। মানুষ তথা মানব হলে মানবিকতা থাকতেই হবে। তেমনি মানবিকতা যেখানে থাকবে না, সেখানে মানুষও থাকবে না, থাকবে অমানুষ।
রোগগ্রস্থ মানুষটির মানবিক অধিকার চিকিৎসা পাওয়ার। ঠিক একইভাবে চিকিৎসা প্রদানে সক্ষম মানুষটির মানুষদের মানবিক দায়বদ্ধতা হল রোগগ্রস্থদের সর্বাগ্রে চিকিৎসা দেয়া। তাই চিকিৎসা সবচাইতে জরুরী সেবা, শ্রেষ্ঠ মানবিক সেবার তালিকায় শীর্ষে। কিন্তু এ দেশবাসীর, কার্যত আজকের পৃথিবীতে মানব জাতির চরম দুর্ভাগ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে যে চিকিৎসা ‘সেবা’র পরিবর্তে চিকিৎসা ‘বাণিজ্য’ হয়ে দাঁড়িয়েছে! আর তা করায়ত্ব করে নিয়েছে ‘আইনী অধিকার’, হয়ে পড়েছে ‘যৌক্তিক কারবার’!
এই আইনীর ‘আইন’টি নিয়ে প্রশ্ন করবার কিংম্বা যৌক্তিকতার ‘যুক্তি’টির অযৌক্তিকতা নিয়ে ভাববার কথাটি শোনা যায় না। যখন অর্থ আর শর্ত সামনে থাকে তখন কি ‘মানবিক সেবা’র প্রশ্নটি সামনে আসার সুযোগ পায়? অর্থ আর শর্ত ছাড়া কি বাণিজ্য চলতে পারে? যুক্তি-তর্ক আর আইনী বৈধতাকে প্রশ্নাতীত ধরে নিয়েই দেখা যাক বাস্তবতাকে। হাতের কাছে এই বাংলাদেশের চেনা চিকিৎসা পরিস্থিতির দিকে নজর দেয়া যাক। অন্তত আজকের বাংলাদেশে স্বাস্থ্য-বাস্তবতা হল, ‘দেহে-দেহে রোগ, ঘরে-ঘরে রোগী’। বাস্তবতা হল, হাসপাতাল ক্লিনিক ডায়োগনস্টিক সেন্টারের ছড়াছড়ি।
শহর-বন্দর, পাড়া-মহল্লা, গ্রাম-গঞ্জে সয়লাব। রমরমা বাণিজ্য। কেনই বা হবে না? পরিবার আছে রোগী নাই, ব্যক্তি আছে ব্যাধি নাই এ যে দুর্লভ! গোটা সমাজটাই যে ব্যধিগ্রস্থ! গোটা দেশটাই যে রোগগ্রস্থ!
বাণিজ্যিক উদ্যোগে গড়ে উঠা সারা দেশে হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার আর ডাক্তারের চেম্বার কত তার পরিসংখ্যান সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে চাইলে তার হিসাব আদৌ পাওয়া যাবে কি না, কিংম্বা কতটুকু পাওয়া যাবে সে প্রসঙ্গ এখন থাক। কেবল একটি ছোট চিত্র থেকেই চিকিৎসা বাণিজ্যের ‘মানবিকতা-বধ’ আখ্যানের আপাতত উপসংহার টানা যেতে পারে। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে দেশে সরকারী মেডিকেল কলেজের সংখ্যা যেখানে ৩০টি সেখানে সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারী মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৬৫টি। ডেন্টাল কলেজের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা যথাক্রমে ৯ ও ৩৩!
আসন সংখ্যার দিক থেকে সরকারী মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ৩৬৯৪টি, বিপরীতে বেসরকারী পর্যায়ে মোট আসন ৭৩৫৫টি। বেসরকারী এইসব কলেজে ভর্তির জন্য গড়ে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা নেয়া হচ্ছে। কোন কোন গুলোতে নামে বেনামে আরও বেশি। থাকা খাওয়াসহ অন্যান্য শিক্ষা ব্যয় মিলিয়ে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা লেগে যায় একজন শিক্ষার্থী ডাক্তারী সনদ নিয়ে বের হতে!
প্রশ্ন হচ্ছে, এই পাস করা একজন ডাক্তার চিকিৎসায় নেমে তার মাথায় কি রোগীকে সেবা দেয়ার কথা আগে আসবে, না তার অভিভাবকের বিনিয়োগকৃত টাকা তুলে আনার চিন্তা আসবে আগে? অভিযোগ রয়েছে, বাস্তবতাও তাই বলে, এই সব বাণিজ্যিক উদ্যোক্তারা ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মেধাকে বিবেচনায় নেন না, ভর্তির টাকা দেয়ার ক্ষমতা বা সামর্থকেই বিবেচনা নিয়ে থাকেন। কারণটা তো দিনের আলোর মত পরিষ্কার। তাদের উদ্যোগটি সেবাব্রতী না! রীতিমত কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ! যার চালকের আসনে বসা ‘মুনাফা-মহাশয়’।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই অনস্বীকার্য বাস্তবতাটি কি সরাসরি দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়? কেননা সংবিধান অনুযায়ী চিকিৎসা নাগরিকদের একটি মৌলিক অধিকার।
আরও জরুরী প্রশ্ন হচ্ছে দেশের এই বিদ্যমান চিকিৎসা বাস্তবতা কি ধর্মের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক নয়? যে দেশটির রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম! নবী মোহাম্মদ (স.) তাঁর পথে কাঁটা ফেলে রাখতো যে বুড়ি, তিনি যখন অসুস্থ হয়ে অসহায় শয্যাশায়ী, তখন রাসূল (স.) কি অর্থ বা শর্তের বিনিময়ে তাকে সুস্থ করেছিলেন? রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম এর অনুসারী দেশের মুসলমানরা বিষয়টি কি ভেবে দেখবেন?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন