কৃতজ্ঞতা স্বীকার ধর্মীয় উপদেশ
শেখ উল্লাস ॥ ইসলাম ধর্মের উপদেশ অনুসারে
দেশ ও জাতির প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন
প্রতিটি মুসলমানের জন্য যেমন অবশ্যই করনীয় তেমনি জীবন চলার পথে সত্যের সৈনিক হয়ে সর্বস্তরে
কৃতজ্ঞতা স্বীকার করার স্বভাব গড়ে তোলা নৈতিকতার উত্তম বহিঃপ্রকাশ। বাংলাদেশের সুবিধাভোগী
মানুষরা কি দেশের প্রতি কৃতজ্ঞ, সর্বোপরি আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ? শিক্ষিত মানুষরা জীবনের
গুরুত্বপূর্ণ সময়টা নিজের ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধার নেশায় সরকারি চাকুরি করেন। বৈধ-অবৈধ
ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতিপত্তি লাভ করে অথবা এনজিও’র নামে দেশি-বিদেশি অর্থ কামিয়ে অবসর
জীবনটা বিভিন্ন সভা-সমিতি এবং হাল-আমলের ‘টক-শো’তে অংশ নেন। অথবা বিভিন্ন ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায়
নানান প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন বিষয়ে মতামত রাখতে পারছেন যারা তারাই নিজেদেরকে তথাকথিত
সুশীল সমাজের অন্তর্ভুক্ত বলে দাবি করছেন। এরা শহরবাসী, রাজধানীবাসী। আজকের দিনে পেশাগতভাবে
যারা রাজনীতিজীবী, তাদের কারো কারো সঙ্গে এই তথাকথিত সুশীল সমাজের পার্থক্য তেমন নেই।
তারা হুট করেই জনগণের সাথে মিশে যেতে পারেন না, কারণ, দেশ ও জনগণের সঙ্গে উঠা-বসা করার
অভ্যাস তাদের তেমন নেই, যেমনটা তারা কথায় পারদর্শী। এক্ষেত্রে রাজনীতিকদের সুবিধা অনেক
বেশি; দেশ, জাতি ও মানুষের কল্যাণে নিবেদিত হয়ে কাজ করার সুযোগের সদ্ব্যবহার করলে তারা
নিজেদেরকে আরও ধন্য করতে পারতেন যেমনটি করে গেছেন পূর্ব-প্রজন্মের অনেক রাজনীতিবিদ।
সেই ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ও পাকিস্তানী আমলে দেশ-জাতি ও সমজের কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ রাজনীতিকরা
আজও সে কারণে মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র, চিরস্মরণীয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে কী যে হলো,
যারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী, তারাই যেন সবচেয়ে বেশি অতৃপ্ত। বোধোদয় তাদের নেই। ফলে তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে জানেন
না, পারেন না, বরং তাদের চাওয়া-পাওয়ার তলে পিষ্ট হয়ে যায় সাধারণ মানুষের সাধারণ চাওয়া-পাওয়াগুলো।
পরিণামে সর্বস্তরে আজও প্রতিষ্ঠা পায়নি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, আছে ঔপনিবেশিক আমলের শাসন-শোষণের
নানা বেড়াজাল, আর এ সুযোগকেই কাজে লাগাচ্ছে ধর্মজীবী ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠী।
এদেশের প্রতিষ্ঠাতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমান আজ বেঁচে থাকলে কী বলতেন জানা নেই। তবে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন,
‘আমি তোমাদের তিন বছর কিছুই দিতে পারবো না। আরো তিন বছর যুদ্ধ চললে, তোমরা যুদ্ধ করতে
না?’ (উত্তর, ‘করতাম, করতাম’), তাহলে মনে কর যুদ্ধ চলছে, তিন বছর যুদ্ধ চলবে। সেই যুদ্ধ
দেশ গড়ার যুদ্ধ। অস্ত্র হবে লাঙ্গল আর কোদাল’।
বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক নির্দেশনার আলোকে
সরকারি কর্মচারিদেরকে জনগণের সেবায় নিয়োজিত হতে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি
পুনরায় গ্রহণ এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। নতুন বেতন স্কেল বাস্তবায়নের মাধ্যমে সুযোগ-সুবিধা
প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বর্তমানে সরকারি কর্মচারিরা আরও অনেক দূর এগিয়ে গেলেন। উচ্চ পদস্থ
কর্মচারিদের সুযোগ-সুবিধা তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ায় তাদের ক্ষেত্রে এই উদ্বুদ্ধকরণ
কর্মসূচি বেশি জরুরি। দেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত গত সপ্তাহে সচিবালয়ে
বেতন বৈষম্য নিরসন সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকের পর এক ব্রিফিং-এ জানিয়েছেন,
সরকারি চাকরিজীবীরা বর্তমানে যে সব সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন, অষ্টম বেতন কাঠামোতে তার
কিছুই কমানো হবে না। বরং তা আরও কীভাবে বাড়ানো যায়, সে চিন্তা করা হচ্ছে। সিলেকশন গ্রেড
ও টাইমস্কেল বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকেও এই নির্দেশনা এসেছে
যে, কারও সুযোগ-সুবিধা কমানো যাবে না। বরং সুবিধা আরও বাড়ানো যায় কি-না সে চিন্তা করতে
বলা হয়েছে’।
একটি দেশের গণমুখী সরকার তার কর্মচারিদেরকে
সুযোগ-সুবিধা দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই সরকারি কর্মচারিরা কতটুকু গণমুখী,
তারা সরকার, জনমানুষ ও দেশের প্রতি কতটুকু কৃতজ্ঞ ও নিবেদিতপ্রাণ সে বিষয়টিও দেখার
দায়িত্ব সরকার তথা রাষ্ট্রেরই। চরম ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই দেশের সংবিধানের ২১ নং
অনুচ্ছেদের ২ নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রে
কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য’। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের সরকারি
কর্মচারিদের সকলকে মহান সংবিধানের এই চেতনায় এখনও পরিপূর্ণ উদ্বুদ্ধ করা যায়নি, যার
খেসারত দিতে হচ্ছে দেশ ও জাতিকে। দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুটপাটের সঙ্গে প্রত্যক্ষ
ও পরোক্ষভাবে জড়িত হয়ে চাকুরি জীবন শেষ করে এরাই আবার তথাকথিত সুশীল সমাজের সদস্য সাজেন।
জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়টুকু জনগণের সেবার চেষ্টা না করে ধর্মীয় প্রাতিষ্ঠানিকতায় নিজেকে
সম্পৃক্ত করে হজ্বে যাচ্ছেন এবং স্বয়ং নিজের সঙ্গে নিজে দ্বিচারিতা করে নিজ নিজ কামনায়
ধরা পড়ছেন দেশ ও জাতির কাছে। দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য আজ তাই প্রয়োজন সরকারি কর্মচারিদেরকে
দেশ সেবায় উদ্বুদ্ধকরণ, জবাবদিহীতা প্রতিষ্ঠাকরণ এবং এই চেতনায় যারা উদ্বুদ্ধ হবেন
না তাদেরকে অকৃতজ্ঞদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে তাদের চাকুরির যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা
কেটে নেয়ার। এটাই আজ সময়ের দাবি। দেশে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা তথা সর্বস্তরে সুশাসন
প্রতিষ্ঠার জন্য এই উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি এখন জরুরি হয়ে উঠেছে। এই কর্মসূচির মধ্য দিয়ে
সরকারি কর্মচারিরা দেশ ও জাতির প্রতি কৃতজ্ঞ হবেন - প্রতিষ্ঠিত হবে একটি কৃতজ্ঞ সমাজ-এটাই
আজ জাতির প্রত্যাশা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন