দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাতীয় উপলব্ধি!
সংলাপ ॥ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ
গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা জাতি উপলব্ধি করলেও দেশের পরিস্থিতি কেমন ছিলো এবং বর্তমানে
কেমন আছে তা নিশ্চিত করেই পদক্ষেপ নিতে হবে রাজনীতিকদের।
অর্থনৈতিক দুর্নীতির চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক
দুর্নীতি বাংলাদেশের জন্য বড় সমস্যা। এখানে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। এমন কোনো
রাষ্ট্রীয় অঙ্গন পাওয়া যাবে না যেখানে দুর্নীতি নেই। মানুষের আত্মিক উৎকর্ষের জন্য
যে শিক্ষা ব্যবস্থা, সেখানেও প্রতিষ্ঠানের আপাদমস্তক বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতিতে নিমজ্জিত।
রাজনীতিকদের এক বিরাট অংশের দুর্নীতি এখন
আর গোপন নেই। রাষ্ট্রীয় টাকা খরচ করে দুর্নীতিবাজদের সাধুতে রূপান্তরিত করা যাবে কিনা
সেটা নিয়ে চিন্তাবিদরা চিন্তায় মগ্ন থাকতে পারেন। বছরের পর বছর ধরে দুর্নীতিপরায়নতার
কলঙ্ক নিয়ে আজও বিশ্বের বুকে একমাত্র সাহসী জাতি হিসেবে টিকে আছে বাঙালি।
এদেশে দুর্নীতির বিরোধী কাজ করার প্রভূত
সুযোগ রয়েছে। প্রথমত মিথ্যা ও মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত
দুর্বার সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি। যেখানেই মিথ্যা ও মিথ্যাচার সেখানেই এলাকার
সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে প্রতিরোধ করার জন্য। রাজনীতিকদের দুর্নীতির মূলোৎপাটন
সম্ভব না হলেও এর বিপক্ষে শক্তিশালী সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে জনগণকেই এগিয়ে আসতে
হবে। প্রতিরোধটা কিভাবে গড়ে তোলা সম্ভব এবং এ রোগের উৎপত্তি কোথায় ও কিভাবে এ নিয়ে
তাত্ত্বিক আলোচনা-সমালোচনা অনেক করা যায়। কেউ কেউ বলেন, রাজনীতিই সমাজকে দুর্নীতিমগ্ন
করেছে। আবার কারো কারো মতে আমলাতন্ত্র, আবার অনেকে দায়ী করেন শিক্ষাব্যবস্থাকে। আদর্শহীন
শিক্ষিত লোকেরা সমাজের যেখানেই যাচ্ছে, সেখানেই চলছে চরম অনৈতিকতা। বাংলাদেশের সামাজিক
বর্তমান অবস্থায় দুর্নীতি বা নীতিহীনতার প্রসার নানা দিক থেকেই ঘটে যাচ্ছে। বাংলাদেশে
আমলা নাকি রাজনৈতিক সমাজ বেশি দুর্নীতিবাজ-এর হিসাব বের করাও কঠিন। বাস্তবে দুর্নীতিবাজ
আমলা এবং একই মনোবৃত্তির রাজনীতিক-এরা পরস্পর ভাই-ভাই। সরকারি আমলাদের সাহায্য ছাড়া
ক্ষমতাবান রাজনীতিক দুর্নীতি করতে পারেন না। আবার ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের প্রশ্রয় কিংবা
দুর্বলতা ছাড়া কোনো আমলার পক্ষে দুর্নীতি করে পার পাওয়া সম্ভবপর হতে পারে না। অপরদিকে
আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা যে আদর্শ ও নীতিভ্রষ্ট এবং দক্ষ মানুষ তৈরির মোটেও উপযোগী
হয়ে উঠেনি সে কথা বিদেশে গিয়ে বাঙালিদের অবস্থা স্ব-চোক্ষে দেখলে উপলব্ধি করা যায়।
বাংলাদেশে শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ
দিয়ে বাজেট করতে হবে । নতুন প্রজন্মকে আদর্শিক শিক্ষায় ব্রতী করে গড়ে তোলার জন্য আদর্শিক
শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীগণ যারা শিক্ষার সঙ্গে জড়িত তাদের প্রতি সরকারের কঠোর নজরদারি রাখতে
হবে।
শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে ব্যক্তির
নৈতিক উৎকর্ষ সাধন। উপমহাদেশীয় পৌরাণিক শিক্ষাতত্ত্বে ন্যায়শাস্ত্রই শিক্ষার মূল বলে
বিবেচনা করা হয়েছে। আর এই ন্যায়শাস্ত্র সমাজ, রাজনীতি এবং অর্থনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে
জড়িত। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিকতার দিকটি এখন আর গুরুত্ব
পাচ্ছে না। এ অবস্থায় নৈতিক অবক্ষয়ের জন্য শিক্ষাব্যবস্থাকে মোটাদাগে দায়ী করা যায়।
মূলে দোষ শিক্ষা ব্যবস্থারই হোক আর আমলাতন্ত্রেরই হোক, রাজনীতিকদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাবার
কোনো সুযোগ নেই। রাজনীতি এবং অর্থনীতির সাথে ন্যায়শাস্ত্রের নিগূঢ় সম্পর্ক রয়েছে। ইংরেজিতে
পলিটিক্ শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে বিচক্ষণ অর্থে। কাজেই যারা রাজনীতি করেন তাদের বিবেক
ও প্রজ্ঞা-বিবর্জিত হওয়ার সুযোগ নেই। পৃথিবীর সব দেশেই রাজনীতি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে।
দেশের আমলাতন্ত্র কিভাবে চলবে, শিক্ষা ব্যবস্থা কি রকম হবে - রাজনৈতিক সমাজই তা নির্ধারণ
করেন।
কাজেই রাজনীতি সংশোধিত হয়ে আদর্শিক না
হলে, রাজনীতিকরা প্রজ্ঞাবান না হলে, কর্মে দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে না পারলে- একটি দেশ,
একটি সমাজ কোনোমতেই সুগঠিত এবং সুন্দর হয়ে উঠতে পারে না। প্রত্যেক ব্যক্তি এবং প্রতিটি
সমাজের মধ্যে ভাল-মন্দ, সত্য-মিথ্যা দু’টোর প্রবণতাই বিদ্যমান। এটা প্রকৃতিরই নিয়ম।
সমাজে কিছু মানুষ থাকে যারা সব সময়ই সত্য ও
নীতি-নৈতিকতায় দৃঢ়। পক্ষান্তরে কিছু লোক থাকে মিথ্যা ও অনৈতিক প্রবণতা যাদের
প্রবল। এই বাস্তবতায় সমাজের আসল চেহারাটি কি রকম হবে, সেটা নির্ভর করে কারা সমাজের
বা রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনার ভার নিয়ে দেশের জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করছে। নীতিহীনরা
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা না বুঝে শুধুমাত্র নীতিবানদের মুখোশ পরে শাসন করলে সমাজে অনৈতিকতার শক্তিই প্রবল হবে। পক্ষান্তরে
নৈতিকশক্তিতে যারা বলীয়ান তারা সমাজ ব্যবস্থাপনায় দৃঢ় প্রত্যয়ী হলে দুর্নীতির শক্তি
অবদমিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। সমাজে কোন শক্তি প্রবল হবে-সেটা অবশ্যই নির্ভর করে রাজনৈতিক
সমাজের আদর্শ, নৈতিকতা ও সৎ সাহসের সঙ্গে দেশের আপামর জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততার ওপর।
একই সঙ্গে প্রয়োজন আইনের কঠোর প্রয়োগ। আইনের শাসন কায়েম, জবাবদিহিতা এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে
সত্য প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর
মধ্যে কিছু রয়েছে সাংবিধানিক, কিছু প্রশাসনিক। বেসরকারি পর্যায়েও আছে অনেক প্রতিষ্ঠান।
রাজনৈতিক দলগুলো একেকটি প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র ও সমাজের প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের নিজ
এখতিয়ারের মধ্যে নিয়মানুযায়ী দায়িত্ব পালনের পথে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে ফলে সমাজে অনৈতিকতার
স্রোত প্রবল ও নির্বিঘ্ন।
বিচার বিভাগ, প্রশাসনিক বিভাগ তথা প্রতিটি
প্রতিষ্ঠান এবং সাংবিধানিক সব প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করে রাখার দায়িত্ব নিঃসন্দেহে
রাজনীতিকদের, বিশেষ করে যারা ক্ষমতায় থাকেন তাদের। কিন্তু, পরিতাপের বিষয় আমাদের দেশে
বিগত সাড়ে তিন দশকে প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতিকরাই হীনবল করে দিয়েছেন। তারাই শিক্ষা
ব্যবস্থার মূলে আঘাত করেছেন ছাত্র এবং শিক্ষকদের দলীয় নীতিহীন রাজনীতিতে টেনে এনে।
তারাই পুলিশকে ক্ষমতাসীন দলের লাঠিয়ালে পরিণত করেছেন দলীয়করণের মাধ্যমে। তারা নির্বাচন
কমিশন ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেননি।
প্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে ওঠেছিল ক্ষমতাসীন দলেরই বাড়তি অংশ যদিও এসব প্রতিষ্ঠান হচ্ছে নীতি
নির্ধারণী সর্বোচ্চ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। দুঃখের বিষয়, ক্ষমতাসীনরা বাংলাদেশে এসব
নীতি ও নৈতিকতার ধার ধারেন নাই। আমলাদের তারা ব্যবহার করেছেন ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থে।
তারাই সংসদকে পরিণত করেন নেতা বা নেত্রীর বন্দনা এবং প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে অমার্জিত
বাক্যবান নিক্ষেপের অবাধ কেন্দ্রে যেহেতু দেশাত্ববোধ ও দেশপ্রেম তাদের উপলব্ধিতে জায়গা
পায়নি। তাই একটু একটু করে সমাজের সর্বত্র বাসা বেঁধেছে নিয়মের জায়গায় অনিয়ম। অনিয়মের
প্রাবল্যে দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছে স্থায়ী রূপ নেয়ার পথে। রাজনীতিকদেরই
বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলার সময় এসেছে যে রাজনৈতিক সমাজই কেবল পারে সকল পর্যায়ে দুর্নীতির পথ
ধীরে ধীরে বন্ধ করে দিতে। কাজেই রাজনীতির অঙ্গনকে মিথ্যা ও মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আদর্শিক
সংস্কার-সংশোধন ছাড়া দুর্নীতি বন্ধ বা কমানো যাবে এমন চিন্তা করা বা বলা হলে তা হবে
শুভংকরের ফাঁকি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন