বুধবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৫

বামপন্থী রাজনীতিকদের বোধোদয়!



সময়ের সাফ কথা....
বামপন্থী রাজনীতিকদের বোধোদয়!

সাগর সগীর ॥ ধর্মীয় মতাদর্শের বাইরে যে কয়েকটি মতাদর্শ পৃথিবীতে এসেছে তার মধ্যে পরীক্ষিত একটি হচ্ছে সাম্যবাদী মতাদর্শ। কমিউনিজম হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত এই দর্শনটি মূলত ঊনবিংশ শতকে আবির্ভূত হলেও গোটা বিশ্বকে চিন্তায় ফেলেছিল বিশ শতকের গোড়ায়। দার্শনিক কার্লস মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস সূচিত এই মতাদর্শটি দুরদর্শী লেনিনের নেতৃত্বে বাস্তবায়নের পথে এগোয় রাশিয়ায়। গোটা বিশ শতক ধরে গোটা পৃথিবী জুড়ে ঝড় তোলে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ বলে পরিচিত এই মতাদর্শ। বাদ যায়নি ভারতবর্ষ, এই বাংলাদেশও। পূর্ব বাংলা তথা আজকের বাংলাদেশ, পশ্চিম বাংলা, ত্রিপুরা তথা বৃহত্তর বঙ্গদেশ হয়ে ওঠে কমিউনিজমের উর্বর জমিন। তরুণ প্রজন্মের সবচেয়ে মেধাবী, সাহসী আর অগ্রসর অংশ ঝাঁকে ঝাঁকে সমবেত হয় বামপন্থী বলে পরিচিত কমিউনিজমের পতাকাতলে। কৃষক, শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষের মাঝে সঞ্চার করে আশা-ভরসা, জাগায় প্রত্যাশা আর বুনে যায় দেশ গড়ার স্বপ্নের বীজ।
সাম্যবাদী দর্শনের মূল কথা সাম্যের সমাজ, যা প্রতিষ্ঠিত হয় শোষণ বঞ্চনা বৈষম্যের অবসানের মধ্য দিয়ে; চূড়ান্তভাবে উৎপাদন যন্ত্রের, উৎপাদন ব্যবস্থার ব্যক্তি মালিকানা বিলোপের মাধ্যমে। বিশের দশকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতায় বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় বহু সমাজতান্ত্রিক দেশ, সাধারণভাবে যা পরিচিত হয়ে উঠে ‘সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব’রূপে। শতাব্দীর গোড়াতে প্রতিষ্ঠিত এই সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতন ঘটে শতাব্দীর শেষে এসে। একুশ শতকে এসে সেই বিশ্ব বাস্তবতা হচ্ছে অনেকটা ‘সেই রামও নেই, সেই অযোদ্ধাও নেই’! অর্থাৎ সেই পরাক্রমশালী সোভিয়েত ইউনিয়নও নেই, সমাজতান্ত্রিক বিশ্বও নেই! কিন্তু পৃথিবী থেকে কি শোষণ নেই? বঞ্চনা নেই? বৈষম্য নেই? সম্পদ বা উৎপাদনের উপায়সমূহের ব্যক্তিগত মালিকানা নেই? উত্তর সবার জানা- এসবই আছে গোটা বিশ্ব জুড়ে; বরং আরো বেশি, আরো তীব্র, আরো প্রকট হয়ে! গোটা বিশ্বের মত এই উপমহাদেশে, এই বাংলাদেশেরও চিত্রও একই।
দূর রাশিয়ায়, দূর ইউরোপের কোন কোন দেশে কেন ভেঙে পড়লো সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা, মুখ থুবড়ে কেন পড়ল ‘সাম্য যাত্রা’ তা গবেষকদের বিষয়, গভীর বিচার বিশ্লেষণ, বিপুল অর্থ আর সময় সাপেক্ষ ব্যাপার! অনেকটা ‘আদার ব্যাপারী-দশা থেকে জাহাজের খবর’ নেয়ার/দেয়ার মত। কিন্তু, এই উপমহাদেশে, বিশেষ করে এই বাংলাদেশে এত বৈষম্য, অত্যাচার অনাচার সত্ত্বেও এদেশের বামপন্থীরা কেন লাগাতার ব্যর্থতার চোরাবালিতে ডুবে রইলেন তা বুঝার জন্য গবেষক হওয়ার প্রয়োজন পড়েনা। প্রতীকীভাবে তা বুঝা যায় এদেশে বামপন্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত বহুল প্রচলিত একটি কথার সূত্র থেকে। বলা হতো এদেশের বামপন্থীরা ‘মস্কোতে বৃষ্টি হলে ঢাকায় ছাতা ধরেন’! অর্থাৎ, এদেশের বামপন্থীদের মগজ বন্ধক দেয়া ছিল মস্কো বা পিকিং (আজকের বেইজিং) এর নীতি নির্ধারকদের কাছে! সমালোচনাটির সত্যতা ধরা পড়লো যখন সোভিয়েতরাজের পতনের পর ধপাস করে নিভে গেল এদেশের বামপন্থীদের তেজ, টুকরো টুকরো হয়ে শক্তি হারালো বামশক্তি, বাম দলগুলো; দলবদল আর চরিত্র বদলের প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে পড়লেন বাম নেতারা। দিক বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ইউরোপ আর আমেরিকায় ঘোরাঘুরি করছেন নেতারা, আর কর্মীরা বিভিন্ন আন্দোলনের নামে রাজপথে নেমে গা গরম করছেন অহেতুক। হারিয়ে যাচ্ছে অগুন্‌তি কর্মী - সংগঠক - সমর্থক শুভানুধ্যায়ী। অথচ শোষণ আজও অব্যাহত, লুণ্ঠন চলছে সমান তালে অথবা তার চেয়েও বেশি; বৈষম্য আরও প্রকট আরও বিকট - এদের মধ্যে বামেদের একাংশ বিদ্যমান ভোগে মোহাচ্ছন্নতায়! 
ফাঁকটা কোথায়? ফাঁকিটা কেন? ফাঁকি হচ্ছে আজকের বামপন্থী নেতারা নিজেরা যা বলেন নিজেরাই তা করেন না, বলায় আর করায় ফাঁকি। ফাঁক হচ্ছে এদেশের বামপন্থীরা বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে, বাংলা আর বাঙালি চেনে না এমনকি বোঝেও না। যদিও বামপন্থী রাজনীতির আরেকটি পরিচয় ছিল ‘বস্তুবাদী দর্শন ভিত্তিক রাজনীতি’। এদেশের মানুষের সুখ-দুঃখ আবেগ অনুভূতির বাইরে বাস্তবতা বিবর্জিত তাত্ত্বিক ঘোরের মধ্যে আবর্তিত তাদের চিন্তা ভাবনা, আচরণ-বিচরণ। এদেশের কৃষ্টি সংস্কৃতি সর্বোপরি এদেশবাসীর জীবন বাস্তবতার বাইরে বাম নেতা সংগঠকদের অবস্থা-অবস্থান। জনসম্পৃক্ততা নয় জনবিচ্ছিন্নতাই আজ বাম নেতা কর্মীদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ত্যাগের নয় ভোগের স্রোতেই ভাসছেন তারা। ব্যতিক্রম হাতে গোণা যাও, পাওয়া যাবে তাদের ত্যাগও অবাস্তব জীবন যাপন আর রাষ্ট্র ও সমাজের মূল স্রোতধারার বাইরে সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ।
শোষণ বৈষম্যমুক্ত সমাজ গঠন আজও সময়ের দাবি। সাম্যের প্রতিষ্ঠা কেবল নৈতিক বা মানবিক দাবিই নয়, সাংবিধানিক বাধ্য বাধকতাও বটে। সম্পদের ব্যক্তি মালিকানা উচ্ছেদ সত্য প্রতিষ্ঠার পূর্ব শর্ত। এটাই বাস্তবতা এটাই সত্য। এদেশের বামপন্থী রাজনীতিকরা এই সত্য অনুধাবন করবেন কবে??

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন