বাংলার বুকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বিকল্প নেই
সংলাপ ॥ ধর্মীয় রাজনীতির জন্য বাংলার উর্বর
ভূমিতে মধ্যপ্রাচ্যের বিপুল পেট্রো-ডলার পেয়ে জামা ইসলামীরা ইতোমধ্যেই নিজেদের বহু
নামে সংগঠিত দল হিসাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। যদিও তথাকথিত ইসলামী শাসনব্যবস্থার স্বরূপ
নিয়ে তাদের মধ্যেও তীব্র মতবিরোধ বিদ্যমান। আমেরিকার মদদপুষ্ট সৌদি বাদশাহী ও মধ্যপ্রাচ্যের
শেখদের টাকায় পরিচালিত বিভিন্ন ইসলামী এনজিও, মসজিদ ও মাদ্রাসাগুলোর প্রধান কাজ হলো
ধর্মীয় দলগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করা যাতে করে ধর্মভীরু মুসলমানদের উত্তেজিত করে সামাজিক
বিশৃঙ্খলা সর্বদা বজায় রাখা যায়। মধ্যপ্রাচ্যের টাকায় উপরোক্ত রাজনৈতিক ইসলামপন্থী
দলগুলো এ দেশের সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে আল্লাহ্র দুনিয়ায় আল্লাহ্র
শাসন কায়েমের জিগির তুলে দেশের শাসনব্যবস্থায় এবং বিশেষভাবে গ্রামের দরিদ্র ও অশিক্ষিত
জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি সমর্থকগোষ্ঠী সৃষ্টি করতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এজন্য তারা টার্গেট
করেছে গ্রামের মসজিদ ও মাদ্রাসাগুলোকে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যের সুযোগে তারা
তাদের কিশোর ও তরুণ ছেলে-মেয়েদের সহজে প্রলুব্ধ করতে পারছে। নগর সভ্যতার বিকাশ ও পাশাপাশি
গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার সীমাহীন দারিদ্র্য ও পশ্চাদপদতা, শহরের সাথে গ্রামের বৈষম্য
ধর্মীয় উগ্রতার ধারণা প্রসারের জন্য উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে চলেছে।
রাজনৈতিক ইসলামপন্থীদের ধর্মীয় উগ্রতা
প্রসারের মূল কারণ হচ্ছে বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতিকদের শান্তি
(ইসলাম) এবং ধর্ম বিষয়ে সীমাহীন অজ্ঞতা, নিজেকে চেনার ব্যর্থতা এবং কাপুরুষতা। স্বাধীনতার
দীর্ঘ চার দশকে আমাদের দেশে যেমন রাজনীতিকদের মিথ্যাচারের জন্য একটি দেশোপযোগী গণতান্ত্রিক
ব্যবস্থা বিকশিত হয়নি, তেমনি দেশের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানেও তারা অজ্ঞতা ও চরম ব্যর্থতার
পরিচয় দিয়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতিকে উন্নয়নের মডেল হিসাবে গ্রহণ করা হলেও বস্তুতঃ
দেশে কাঙ্ক্ষিত শিল্পায়ন ঘটেনি। ফলতঃ সমাজে যেমন শ্রেণী বৈষম্য তীব্র হচ্ছে তেমনি বৃদ্ধি
পাচ্ছে গ্রাম ও শহরের মধ্যে বৈষম্য। উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কহীন এক শ্রেণীর শহুরে
লুটেরা ধনীদের সীমাহীন জৌলুস-আধুনিক জীবনযাপন আর অন্যদিকে গ্রামের বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর
জীবন-জীবিকার প্রাণান্তকর আদি সংগ্রাম - এ স্ববিরোধী কোনো সমাজ কখনো স্থিতিশীল হতে
পারে না এবং ইসলাম পরিপন্থী। ফি বছর ২১/২২ লক্ষ শিক্ষিত বেকার শ্রমের বাজারে প্রবেশ
করছে। বিভিন্নপন্থী ধর্মীয়বাদ ও দুর্নীতি সর্বগ্রাসী রূপ পরিগ্রহ করে পুরো সমাজকে গিলে
ফেলছে। স্বাধীনতার পর হতে আমাদের দেশের শাসকগোষ্ঠীর ধারাবাহিক ব্যর্থতার ফলশ্রুতিতে
আজ গ্রামীণ ও শহরে নিম্ন-মধ্যবিত্ত দরিদ্র যুবশ্রেণীর মধ্যে যে হতাশা দানা বেঁধেছে
তাকেই সুপরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাবার প্রয়াস পাচ্ছে ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো। স্বরচিত
ইসলাম দ্বারা পরিচালিত যে সমস্ত মুসলমান অধ্যুষিত দেশ পৃথিবীর মানচিত্রে আছে তাদের
ধর্মীয়-আর্থ-সামাজিক ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করলে আমরা একই রকম চিত্র দেখতে পাবো যে, সে
সব দেশেও সামাজিক বৈষম্য ও দারিদ্য দূরীকরণে মূল রাজনৈতিক শক্তিগুলোর অজ্ঞতা ধর্মীয়
উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসের উদ্ভব ও বিকাশের উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে। এহেন একটি আর্থ-সামাজিক
প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাসীন চক্র রাজনৈতিক ইসলামকে মোকাবেলার পরিবর্তে তাদের কর্মসূচীকেই
গোপনে আত্মীকরণ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দুঃখের বিষয় এ ক্ষেত্রে বৃহৎ রাজনৈতিক
দলগুলো কে কতটুকু বক-ধার্মিক, তা প্রমাণের প্রতিযোগিতায় সদালিপ্ত।
জামা ইসলামপন্থীদের এবং রাজনৈতিক ইসলামকে
কেবল রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করে রোখা যাবে না। চূড়ান্তভাবে ঠেকাতে হলে তাকে রুখতে হবে
আদর্শিকভাবে। সারা দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা মসজিদ ও মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার
নামে যা ছড়ানো হচ্ছে তা মূলত ধর্মাশ্রয়ী কূপমন্ডুকতা ও অজ্ঞতা। ধর্মীয় উগ্রবাদ বা সন্ত্রাসের
প্রধান আশ্রয় হলো এই অজ্ঞতা। বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ও নারী শিক্ষার বিস্তার সে অজ্ঞতা
রোধে প্রধান ভূমিকা নিতে পারে। বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিক শিক্ষা অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক
চেতনার প্রসার ঘটাবে ও তার লালন রাজনৈতিক ইসলামের অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে বর্ম হিসাবে
কাজ করবে। জামা ইসলামীদের বা রাজনৈতিক ইসলামপন্থীদের সন্তুষ্ট করার জন্য সরকার একের
পর এক মূল্যবোধ বিবর্জিত আনুষ্ঠানিক ধর্ম পালনের দায়িত্ব যখন নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছে,
তখন ধর্মের নামে মিথ্যাচারিতার ভিত্তি কেবল শক্তই হচ্ছে। তাই যুক্তি বিস্তারের মাধ্যমে
সর্বাগ্রে আমাদের মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণার অসারতা, অপ্রাসঙ্গিকতা-পশ্চাদপদতা ও গণবিমুখতা
তুলে ধরতে হবে আম জনগণের কাছে - বিশেষভাবে বর্তমান প্রজন্মের কাছে। সেজন্য একটি সাংস্কৃতিক
আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া বাঙালি জাতীয়তাবাদী দলগুলোর সামনে কোনো বিকল্প নেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন