বাংলাদেশের মানুষ
মান-কে নিজেই কাঠগড়ায়
দাঁড় করাচ্ছে!
নজরুল ইশতিয়াক ॥ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের
বয়স চুয়াল্লিশ বছর। চুয়াল্লিশ বছরের যুবক দেশটি অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নের নানা সুচকে
উর্দ্ধগামী। তলাবিহীন ঝুড়ি, ব্যর্থ রাষ্ট্র এসব কোন বিশেষণই এখন আর বলা হয় না। অগ্রসরমান
বাঘ, স্বর্নময়ী সম্ভারের বিশেষণ এদেশের সামনে।
জিডিপির গ্রোথ ছয়ের উপরে, সামাজিক সূচকে
দারিদ্রতা বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু ও মা সুরক্ষা, স্যানিটেশন, শিক্ষার হার বৃদ্ধি,
গড় আয়ু-পুষ্টি, সব ক্ষেত্রেই এসেছে দারুন সাফল্য। দেশের প্রতিটি জনপদে মিশেছে চকচকে
রাস্তা, ইন্টারনেট সুবিধা, মোবাইল নেটওয়ার্ক। যে কোন ঘটনা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।
ফেসবুক টুইটার অনলাইন ব্লগ সর্বত্র তারুণ্যের ছাপ। মাত্র চুয়াল্লিশ বছরে পাঁচ গুন বেড়েছে
কৃষি ও মৎস উৎপাদন, বিদ্যুৎ উৎপাদন দশ হাজার মেগাওয়াট ছুঁই ছুঁই। সাতশো কোটি টাকার
বাজেট এখন তিন লক্ষ কোটি টাকার বাজেট।
বিশ্বের নামি-দামি ব্র্যান্ডের জুতা, জামা,
প্যান্ট, পারফিউম, গাড়ী, মোবাইল, বিশ্বখ্যাত কোম্পানীগুলোর লোকাল সেলস্ সেন্টার ও
উৎপাদন কেন্দ্র, বিশ্বের সব নামী-দামী খাবারের পসরা এই দেশে। বিশ্বখ্যাত গাড়ী, স্মার্টফোন-কম্পিউটার-ল্যাপটপ,
চোখ ধাধানো সুরম্য প্রাসাদসম বাড়ি, বহুতল বিশিষ্ট আধুনিক মার্কেট, হোটেল-মোটেল যততত্র
চোখে পড়ে।
কর্ম জগতে নারীর অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটেছে।
গার্মেন্টস্, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, এনজিও, প্রাইমারী শিক্ষক, ডাক্তার-আইনজীবী ও
কর্পোরেট অফিসগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীর সরব উপস্থিতি।
সুপ্রীম ইলেকট্রনিক মিডিয়া, মিডিয়া ওয়ার্ল্ড,
শিল্প সংস্কৃতি অঙ্গনে, সেলস্ সেন্টার ও কাষ্টমার কেয়ারে পদচারনা রয়েছে বিপুল সংখ্যক
নারীর। দেশের শিক্ষিত মোট জনগোষ্ঠীর তিনভাগের একভাগ নারী। নারীর ক্ষমতায়ন তথা নারীর
রাজনৈতিক অগ্রগতি বিশ্ব রাজনীতিতেও প্রসংশিত।
বাঙালির জীবন দর্শন বিশ্ব সংস্কৃতির উপজীব্য
হয়ে দাঁড়িয়েছে। সূফীতত্ত্বের ঘরানায় বাঙালির অবদান খুব গভীরে। জাপান-জার্মান ফ্রান্স
ইটালি আমেরিকা পর্যন্ত বিস্তৃত। হ্যামিলিওয়নের বাঁশিওয়ালার টানে ফোক ফেষ্ট, সাধু ফকিরের
দরগায়, বাউল গানের আসরে, সভা সেমিনারে ইউরোপের হাজারো কৌতূহলী আগ্রহী অনুসন্ধানী মনের
আগমন ঘটে। আমেরিকা-ইটালি-ফ্রান্সে দুই বাংলার বাউলের ব্যাপক সুনাম রয়েছে। জাতিসংঘে,
আন্তর্জাতিক মিউজিকাল উৎসবে বাংলার ফোক চরম দাপুটে অবস্থানে। ক্রিকেটে বাংলা বাঘের
থাবায় কুপোকাত গোটা ক্রিকেট দুনিয়া।
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে বাংলাদেশ এগিয়েছে
বহুদূর, আমাদের অগ্রজরা কোন কোন ক্ষেত্রে শক্ত শেকড় গেড়ে দিয়েছেন। প্রশ্ন, পিছিয়েছে
কতদূর? অবকাঠামোগত উন্নয়ন, আর্থিক স্বচ্ছলতা, রং-বাহারি বিকিকিনির আসর, রঙিন ঝলমলে
আলোর বিপরীতে জীবন চিন্তার সামগ্রিক মান , মহানুভবতা, সৃজনশীলতা, মানবিক বোধ কোথায়
গিয়ে ঠেকেছে এই প্রশ্নও আজ খুব জোরালো হয়ে সামনে আসছে। বিচার ব্যবস্থা, গণমাধ্যম, সংস্কৃতি,
চিকিৎসা সেবা, শিক্ষকতা পেশার চিত্র এতটাই প্রশ্নবোধক যে তা নিয়ে বাড়ির বুয়া, বাগানের
মালি, রিক্সাচালকরাও বিরূপ মন্তব্য করে।
সব শিল্পই এখন বাজারি পণ্যের মত কিনতে
পাওয়া যায়। শিল্পের সৌখিন ক্রেতা অর্থ দিয়ে গায়ক হয়, নায়ক হয়, প্রদায়ক হয়, কবি সাহিত্যিক,
ঔপন্যাসিক, চালক পরিচালক, বিচারক সবই হতে পারে। রিয়েলিটি শো’র রিয়েল মালিকানাও বিকিকিনি
হয়। সম্প্রসারিত এই শিল্পের বাজার দাদা-দাদি, নানা-নানির পুথি পাঠকে নাতি-নাতনির জন্য
ব্যবসার দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধার কন্ঠে পাঠ করা পুথির দোকান খুলে বসেছেন
এমবিএ-বিবিএ করা শিল্প ব্যবসায়ী নাতি।
অন্যদিকে ওয়াজ মাহফিল ও বিভিন্ন জলসায়
আসমানী দাঁতের মাজন, হাড়ি-পাতিল মাজনার ছাই-লবঙ্গদানী মোমবাতি, আতর- গোলাপ, তসবিহ্,
বেহেস্তের তাবিজ-কবজ, মসল্লা, বই-পুস্তক, ধর্মীয় উপদেশ সমৃদ্ধ হাজারো হাজারো ফায়সালার
মোটা মোটা বই, আরব্য রজনীর জায়নামাজ, হজ্ব-কাফেলা, বহুমাত্রিক হজ, যাকাত-ফিতরা, সঞ্চয়
প্রকল্প’র নামে হাজারো ব্যবসা পেতে বসেছে ধর্মজীবিরা। ধর্মভীরু বাঙালির সহজ সরলতার
সুযোগ নিয়ে ধর্মজীবীরা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের মহা কুটকৌশলে ব্যস্ত। তাদের মুখরোচক বিভ্রান্তি
বুঝতে না পারাটা অবশ্যই আমাদের চিন্তার নিম্ন মানকেই প্রকাশ করে।
মাদ্রাসা শিক্ষা সহ ধর্মীয় শিক্ষার নামে
সুস্পষ্ট বিভাজন নিকট ভবিষ্যতে আরো রুগ্ন চেহারা নিয়ে হাজির হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
প্রতি তিনজন ছাত্রের একজন মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত, এরা জনসম্পদ না হয়ে পরাগাছায় পরিণত
হচ্ছে। কেউ কেউ টুপি-তস্বিহ, প্রেস-মুদি-বিকাশ-মোবাইলের দোকানদারি করে। মসজিদের ইমাম,
হাফেজ, ক্বারীদের প্রতি সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধাবোধ নেই বললেই চলে। অথচ একজন বাঙালি
মুসলিমই সবার শ্রদ্ধার পাত্র, সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী ব্যক্তিত্ব।
দেশ সংস্কৃতি ইতিহাস ঐতিহ্য বিমুখ বিশাল
জনগোষ্ঠীকে বিভ্রান্ত করে পুরোনো লুটেরা বণীকেরাই একটি মহাসংকট সৃষ্টির অপেক্ষায় বুদ
হয়ে আছে।
প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ-মনুষ্যতা, শিল্পবোধ,
নান্দনিকতা, সৃজনশীলতা, কাব্য রস হারিয়ে যেতে বসেছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রবল বাণিজ্য।
পঁয়ত্রিশ হাজার কোটি টাকার কোচিং বাণিজ্যের কথা আমরা জানি কিন্তু গোটা শিক্ষা ব্যবস্থায়
মোট বাণিজ্যের পরিমান কত তা জানি না। হাল আমলে এসো গণিত শিক্ষার নামে গনিত শিক্ষা বড্ড
কৌতুকপূর্ণ। সৃজনশীল মেধার নামে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা অর্থহীন হয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থীর
সৃজনী চিন্তাকে ধ্বংস করা হচ্ছে। সব ধরনের শিক্ষার মান তলানীতে এসে ঠেকেছে। যে কেউ
ডাক্তারি পড়তে পারবে এবং নিশ্চিত ডাক্তার হয়ে মেজর অপারশেন করতে পারবেন। ভুল অপারেশনে
রুগী মারা গেলে আইসিইউতে রেখে দেবার অধিকারও ডাক্তারদের রয়েছে।
যে কেউ টাকা থাকলে মনোনয়ন কিনে এমপি মেয়রও
হতে পারেন, পারেন সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কমিটির সভাপতি হতে।
পর্যবেক্ষনে দেখা গেছে তথাকথিত প্রগতিবাদী
মেরুদন্ডহীন তরুণেরা বারে, ক্যাসিনো, ক্যাফেতে মাতাল মাৎসর্যে, না হয় নেট ইন্টারনেটের
নষ্ট বিশ্বে ডুব দিয়ে হারিয়ে ফেলছে নিজেদের অস্তিত্ব চিন্তাকে। ইন্টারনেটের বিশাল পৃথিবীতে
শেখার হাজারো উপাত্ত থাকলেও অধিকাংশ তরুণ সেদিকে যায় না। শতকরা পঁচানব্বই জন তরুণ বাংলা
ও বাঙালির ইতিহাসের কিয়দংশও জানে না।
দশটুকরো লাশের ছবি, পিটিয়ে শিশু হত্যা,
কিশোরী ধর্ষণ, ধর্ষণের ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার বিবেক বর্জিত আস্ফালন প্রমাণ করে
বিবেকের সৌন্দর্য কোথায় যেয়ে ঠেকেছে। শিশু ও নারী হত্যা একটি ভিন্ন অবস্থাকে নির্দেশ
করে। এটি হচ্ছে রুগ্ন মনস্তত্বের সর্বনিম্ন স্তর। এটি প্রমাণ করে সবার সামনেই দ্রুত
বর্ধনশীল রুগ্ন বৃক্ষের বাগান গজিয়ে উঠছে । জ্বলন্ত বাসে আগুন দিয়ে দিনের পর দিন মানুষ
হত্যা আবার বার্ণ ইউনিটে যেয়ে অসহায় রুগীদের পক্ষে সাফাই গাওয়া দুটোয় রুগ্ন মানসিকতার
প্রমাণ দেয়। আগুন দিয়ে মানুষ পোড়ানোর ষড়যন্ত্র মানব সভ্যতাকেই হুমকীর মুখে নিয়ে গেছে।
সামাজিক প্রতিবাদ- প্রতিরোধ, শাসন নেই বললেই চলে। পরিবার ব্যবস্থা বাজারি মনস্তত্বের
হাওয়াই মিঠাই।
বাংলাদেশের টাকা চলে যায় কানাডা, আমেরিকা,
হাল আমলে মালয়েশিয়ায়। যারা টাকা পাচার করে তারা আবার দেশ সেবার আওয়াজ তোলে। দ্বি-চারিতা
কি মানুষের কাজ ! এসব দ্বি-চারি রাজনীতিক ব্যবসায়ী বুদ্ধিবিক্রেতার আস্ফালন প্রতিদিন
মঞ্চস্থ হয়। ছাত্র রাজনীতিতে পদ- পদবী জোটে কেবলই মুরুব্বী নেতাদের লেজুড়বৃত্তি করে।
দলের লক্ষ্য উদ্দেশ্য জানে না বললেই চলে।
সব পেশায় মিথ্যাচার এতই ভয়াবহ যে এ নিয়ে
কারো নতুন করে কিছু বলার নেই। সব সম্পর্কের সেতু বন্ধন অর্থ, ক্ষমতা নির্ভর, সব দায়বদ্ধতা
লেনদেন নির্ভর। সঙ্গত কারনে প্রশ্ন উঠছে শিক্ষা কি প্রকৃত পক্ষে মর্যাদা রক্ষায় কিছু
শেখাচ্ছে। রাজনীতি কি জননীতিতে পরিণত হচ্ছে। সব ধরনের সেবার নেপথ্যে কি কেবলই লোক দেখানো
প্রচার প্রপাগান্ডা আর অর্থ কামানো! হাসপাতালগুলো কি কেবলই বাণিজ্যিক ফার্ম। খোলা চোখে
যা দেখা যায় তা কি ভুল হতে পারে। একদিকে যেমন চরম বৈষম্য অন্যদিকে চরম প্রাচুর্যতা।
কৃত্রিমতা চাতুর্যতায় ভরা সমাজে সবই যেন
বাজারি পণ্যের বিশাল পসরা। যা মানকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন