বুধবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

যুগোপযোগী খোতবা সময়ের দাবী


যুগোপযোগী খোতবা সময়ের দাবী
সংলাপ ॥ ইসলামী পরিভাষায় খোতবার প্রচলিত অর্থ আল্লাহ্‌র প্রশংসা, রাসুলের প্রশংসা ও বক্তৃতা বুঝিয়ে থাকে। খোতবার উদ্দেশ্য আল্লাহ্‌র জিকির বা স্মরণ এবং উপদেশ প্রদান করা। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের নৈতিক সংশোধন ও সংস্কার।
খোতবার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইসলাম কর্তৃক নির্বাচিত ও নির্ধারিত ক্ষেত্রগুলো পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, জুম্মার নামাজের পূর্বে মসজিদে কিংবা ঈদগাহে দুই ঈদের নামাজের পরে, আরাফাতের ময়দানে হাজীদের উদ্দেশ্যে, বিবাহ অনুষ্ঠানে আক্‌তের সময় এবং জানাজার দোয়া ইত্যাদি কোনো না কোনোভাবে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় অনৱর্ভুক্ত। বাংলাদেশে ইমাম প্রশিক্ষণ একটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। সরকারীভাবে এই প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে দুই লক্ষাধিক মসজিদের কয়েক লাখ ইমামকে পর্যায়ক্রমিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তুলতে হলে প্রচুর সময়ের প্রয়োজন। এযাবৎ হাজার হাজার ইমাম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হলেও তাদের জীবনমান কতটুকু উন্নত হয়েছে এবং তারা সমাজের কতটুকু উন্নতি করেছেন কিংবা আত্মপ্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন অথবা সরকারী সুযোগ সুবিধা লাভ করেছেন - এ ধরনের অনেক প্রশ্নই রয়েছে।
ইমাম প্রশিক্ষণের সাথে খোতবা প্রশিক্ষণের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও খোতবা সংস্কারের বিষয়টি উপেক্ষণীয় নয়। আমাদের সমাজে ইমামগণের মর্যাদা সম্মান আগে যেমন ছিল, বর্তমানেও তা অক্ষুন্ন আছে। তারা সমাজের ধর্মীয় দর্পণ হিসেবে সকলের কাছে সম্মানের পাত্র। প্রতি জুমার ঈদাইন (দুই ঈদ) উপলক্ষ্য ছাড়াও মসজিদ হতে তারা তাবলীগ হেদায়েতের মূল্যবান বাণী প্রচার করে ইসলামের মহান সেবায় নিয়োজিত কিন্তু একটি বিষয় সকলকে ভাবিয়ে তুলছে যে, ইমাম প্রশিক্ষণের ধারা অক্ষুন্ন থাকলেও তাদের জন্য খোতবা সংস্কারের কোনো ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে কিংবা এ ব্যাপারে সময়োপযোগী বাস্তব কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কিনা-এসব প্রশ্ন থেকে যায়। উল্লেখ্য, বিগত ১৯৬০ সালে প্রথমবারের মতো ঢাকা সরকারী আলিয়া মাদ্রাসায় যখন ইমাম প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল তখন সংস্কারকৃত খোতবার বিষয়ও এসেছিলো।
মসজিদ ভিত্তিক সমাজ উন্নয়নের প্রক্রিয়ার সাথে সাথে ইমামদেরকে আরো বিভিন্ন মুখী কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত করার চিন্তাভাবনা চলছে। সমাজে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধিসহ সুপ্রতিষ্ঠিত করার দাবিও নতুন নয়। জনসাধারণের মধ্যে তাদের মসজিদ ভিত্তিক ধর্মীয় প্রভাবের কারণে তাদেরকে অবহেলা করার এবং তাদেরকে ন্যায়সঙ্গত অধিকার ও সুযোগ সুবিধা হতে বঞ্চিত করার কোনো অবকাশ নেই। দেশব্যাপী ইমাম প্রশিক্ষণের পরিধি সম্প্রসারিত করার সাথে সাথে মসজিদ ভিত্তিক ইসলাম (শান্তি) শিক্ষা জোরদার করার প্রয়োজনীয়তা বিভিন্ন কারণে বর্তমানে এখন সময়ের দাবী। ইমাম প্রশিক্ষণের সাথে খোতবা সংস্কারের কথাও নতুনভাবে চিন্তা করার সময় এসেছে। দেশে এক শ্রেণীর উগ্রবাদী মাদ্রাসা এবং এক শ্রেণীর অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত শিক্ষক সম্প্রদায় সাধারণ লোকদেরকে অর্থের লোভ দেখিয়ে সন্ত্রাসী বানানোর অপতৎপরতায় লিপ্ত সেখানে মসজিদের দেশ বাংলাদেশের ইমাম-উলামা সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে সত্য নিয়ে অপপ্রচার অপতৎপরতার বিরুদ্ধে। যারা নীরবে ধর্মীয় সন্ত্রাস করে চলছে ধর্মীয় উন্নয়ন ও কল্যাণের মুখরোচক স্লোগান উচ্চারণ করে ছদ্মাবরণে অপতৎপরতা চালাচ্ছে তাদের রোধে বিশেষভাবে মসজিদের ইমাম সমাজই সবচেয়ে বলিষ্ঠ ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন। আমাদের উলামা-ইমাম সমাজকে আরো সজাগ-সচেতন হওয়ার সময় এসেছে, তাদের দায়িত্ব ও ভূমিকা কিভাবে জোরদার করা তা পুনর্বিবেচনা করতে হবে এবং এজন্য প্রয়োজন তাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিকে সম্প্রসারিত ও সুবিন্যস্ত করা এবং খোতবা সংস্কারের মাধ্যমে তাদেরকে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য সক্রিয় করে তোলা। খোতবার মূল চরিত্র তথা ইসলামি রীতিনীতি অক্ষুন্ন রেখে নতুন সংযোজন, পরিবর্ধন, সংশোধন ইত্যাদি প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করা অর্থাৎ যুগোপযোগী করা। সারা দেশে একক খোতবা চালু করার বিষয়টি নতুনভাবে এবং গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা একান্ত আবশ্যক হয়ে পড়ছে। নব-নব পরিস্থিতিতে খোতবা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়া একটি স্বাধীন দেশে খুবই স্বাভাবিক।
নতুন শতকের নতুন পরিস্থিতিতে খোতবা সংস্কারের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার দাবি রাখে। যেহেতু এ সম্পর্কে অতীতে যথেষ্ট কাজ হয়েছে এবং বেশ অগ্রগতিও সাধিত হয়েছিল। তাই ধর্ম মন্ত্রণালয় বিষয়টি বিবেচনায় এনে সংরক্ষিত কাগজপত্র/রেকর্ড পত্রের আলোকে অথবা বিজ্ঞ আলিম সমাজের পরামর্শক্রমে পুনরায় খোতবা সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। পূর্বের গৃহীত উদ্যোগগুলোর সাথে যেসব বিজ্ঞ আলিম পণ্ডিত সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন, তাদের মধ্যে এখনো কিছু কিছু ব্যক্তিত্ব জীবিত আছেন, তাদের মূল্যবান পরামর্শ খোতবা সংস্কারে বিশেষ উপকারে আসতে পারে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
মসজিদের ইমাম-খতীবগণকে প্রশিক্ষণ দানের প্রশংসনীয় কর্মসূচির সাথে যুগোপযোগী খোতবার সংশ্লিষ্টতাকেও একীভূত করে প্রচলিত সব খোতবার মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে। খোতবায় বাড়তি কি কি বিষয় স্থান পাবে তা নির্ধারণ করে দেয়া এ কারণেই প্রয়োজন যে, অধিকাংশ ইমাম মুদ্রিত খোতবা পাঠে অভ্যস্ত, আরবীতে নিজ থেকে কিছু বানিয়ে পড়তে হয়তো পারবেন না। তবে খোতবার আলোচ্য বিষয়গুলো আরবীতে থাকলেও খোতবা পাঠের প্রথমে তা বাংলায় বলে দেয়ার নিয়ম সকল মসজিদে এখনো চালু হয়নি, এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে উন্নতি সাধন করতে হবে। খোতবা সংস্কার করে সারা দেশের মসজিদসমূহে এক ও অভিন্ন তথা সমন্বিত খোতবা সরবরাহ চালু করা হলে খোতবা নিয়ে নতুন বিতর্ক বা ফেৎনা সৃষ্টিরও অবকাশ থাকবে না। খোতবার ইসলামি ঐতিহ্য-চরিত্র বজায় রেখে যুগের চাহিদা অনুযায়ী খোতবা সংস্কারের প্রয়োজন নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। খোতবাকে কেন্দ্র করে কেউ যেন বিতর্ক সৃষ্টির সুযোগ না নিতে পারে সেদিকেও সকলকে সতর্ক থাকতে হবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে মসজিদের ইমাম-খতীবগণ সমাজের তৃণমূল থেকে ইসলামের প্রচার-প্রসার, ইসলামি আদর্শ শিক্ষার বিস্তার, বাস্তবায়ন, সামাজিক ধর্মীয় উগ্রবাদ ও অপরাধ-কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অভিযান, ধর্মজীবী ও ধর্মদ্রোহীদের অপপ্রচার বিভ্রান্তির অবসানে কার্যকর ও বাস্তবমুখী বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। রাজনৈতিক ইসলাম ও বিভ্রান্তদের প্রতারণা প্রচারণা এবং অপতৎপরতা রোধে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অপরিসীম। কাজেই ইমাম প্রশিক্ষণ সূচিকে জোরদার, গতিশীল ও সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে খোতবা সংস্কারের মাধ্যমে তাদের যুগ চাহিদা পূরণে প্রস্তুত ও অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন করে তুলতে হবে। প্রণীত খোতবাই যেন সমাজের অভ্রান্ত দিশারী হিসেবে, আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে তা নির্ণীত ও নিশ্চিত করতে হবে যাতে সবার মধ্যে খোতবার আবেদন সৃষ্টি হতে পারে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন