সময়ের সাফ কথা....
সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস
সত্যদর্শী ॥ বাংলায় বহু পুরোনো একটি প্রবাদ
আছে - সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। সঙ্গ দোষে মানুষ বিপথগামী হয়। সঙ্গ দোষেই
সৎ হয়। সততার সৌন্দর্য আছে, সততার মর্যাদা সর্বত্র। অসৎ এর সঙ্গ কিছু লুকোচুরি জারিজুরি
যাদুকরি মন্ত্রজাল সাময়িক তৈরি করে। পরিণাম যে কত ভয়াবহ তা সবার জানা। নিশ্চিত অপঘাতে
মৃত্যু অথবা ঘৃণিত জীবন। নেশাখোরের সাথে মিশলে নেশাখোর হয়, খুনির সাথে বন্ধুত্ব করলে
খুনের দায় কাঁধে পড়বেই।
পাড়ার বখাটে যুবকদের সাথে মিশতে মিশতে
বখাটের দল ভারী হয়। মান সম্মত শিক্ষকের সাহচর্য পেলে শিক্ষার্থীর মান উন্নত হবেই।
আপনি যার সাথে যাদের সাথে সঙ্গ দিচ্ছেন
আপনি প্রকৃতই তার বা তাদের মত হয়ে উঠবেন। সমভাবাপন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠে সমচিন্তার
মানুষের সাহচর্যে। জীবন একটি বর্তন প্রক্রিয়াকে অনুসরণ করেই চলে। যাদের সাথে যে কাজে
মানুষ যত বেশি সময় দেয় সেটিই তাকে নির্মাণ করে।
বর্তনের বহুমাত্রিক পর্যায় রয়েছে। পরিবারের
কোটরে, শৈশবে, শিক্ষাজীবনে, সমাজনীতি, রাজনীতিতে, বুদ্ধিবৃত্তিক সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে
সর্বত্রই রয়েছে বর্তনশীল নানা পর্যায়।
শৈশবেই একটি শক্তিশালী বর্তনমান গড়ে উঠে।
যা ব্যক্তিত্ব, রুচি, চরিত্র, দেখা ও জানার ক্ষমতা গড়ে তোলে। পরবর্তী জীবনে মানুষের
প্রতিটি কর্মে মানুষ সবকিছুকে দেখার চেষ্টা করে অর্জিত বর্তনের মান অনুযায়ী।
পূর্বধারণা সব কিছুকে আলাদা করে দেখায়।
একজন ব্যক্তি প্রথমত পিতা-মাতার মস্তিস্কের কার্যকারণ বহন করে নিয়ে আসে। তার অভিরুচির
অনেকটাই এক সংকেতলিপির উপর নির্ভর করে।
জন্মের শুভক্ষনে গ্রহ নক্ষত্রের প্রভাব,
পিতা-মাতার মনন মেজাজ অনুভূতি সুস্পষ্টভাবেই সন্তানের মস্তিস্কের মধ্যে ঢুকে যায়। উপরন্তু
পারিবারিক শাসন কাঠামো, পারিপার্শ্বিক প্রেক্ষিত, প্রেক্ষাপট চাল-চলন, এবং অভিভাবকের
শাসন ক্ষমতা চাপিয়ে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ রেখা তৈরি করে দেয়।
পারিবারিক ঐতিহ্য বংশীয় গৌরব, নানা উত্থান-পতন,
গ্রুপ, সার্কেল, পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব মিলেই ব্যক্তির চিন্তাজগত গড়ে উঠে। পারিবারিক
বিদ্যালয়ই প্রথম বিদ্যালয়, পরবর্তীতে সমাজে কাদের সাথে কোন্ কাজে তাদের সন্তান জড়িত
হয়ে পড়েছে, কাদের সাথে মিশছে, কি দেখছে, কি করছে সব ব্যাপারে খোলামেলা দৃষ্টি রাখতে
হবে পিতা-মাতাকে। মাতৃকুলের শিক্ষা সন্তানের বুনিয়াদ গড়ে দেয়। পরবর্তী জীবনে যত ঝড়
আসুক সে ঝড়ে সন্তান ঘুরে দাঁড়াতে জানে, যত ফাঁদ সৃষ্টি করা হোক সে ফাঁদ থেকে বের হবার
কৌশল বের করতে পারে। স্কুলে, কোচিং সেন্টারে,
মসজিদে মাদ্রাসায়, নেট-ইন্টারনেটে, বন্ধুদের আড্ডায় সতর্ক দৃষ্টি রাখলে কোন সন্তানই
বিপথগামী হবে না। দেশ, সংস্কৃতি, ইতিহাস, বিজ্ঞানকে জানার সুযোগ শিশুকালে করে দেয়া
গেলে প্রত্যেকটি সন্তানই যোগ্য মানুষ হয়ে গড়ে উঠবেই।
প্রায়শই কিছু তরুণের নির্মম অমানবিক কর্মকাণ্ডে শিহরিত হয় গোটা
জাতি। টকশো পত্র- পত্রিকায় এ নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠে। বিকৃত মনস্তত্বের দিকেই যাচ্ছে নব
প্রজন্ম এমন কথা জোরে সোরে বলা হয়।
গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে এর
জন্য প্রধানত দায়ী পরিবার, দ্বিতীয়ত সামাজিক অবস্থা। পরিবার কাঠামোর মধ্যেই অসততা,
ভন্ডামী, অজ্ঞতায় ভরা। সীমাহীন অস্থিরতা উন্মাদনার মধ্যে থাকেন পিতা-মাতা তদরুপ সুযোগ
পান সন্তানরাও।
পরিবার ব্যবস্থাপনার সব কিছুই গড়ে উঠছে
বাজার কেন্দ্রীক। ফলে শরীর ও প্রযুক্তি নির্ভর জীবন আর কিই বা উপহার দিতে পারে। পরিবারের
কোন মুরুব্বী আর নীতিবাক্য, সত্যভাষণ শোনানোর প্রয়োজন বোধ করেন না বরং কিভাবে বেশি
টাকা উপার্জন করা যাবে, কোন্ কোন্ পোশাক পরতে হবে, কোন্ কোন্ পারফিউম-সাবান, নেইলপলিশ-স্নো
ব্যবহার করতে হবে, সেটা নিয়ে সময় পার করে দেয়। অভিভাবকরা যদি সন্তানের জীবনের মানে
তুলে না ধরেন তবে সন্তানতো ভুল করবেই। টিভি সিরিয়ালে যে সময় ব্যয় হয় তার শতকরা দশভাগ
সন্তানের দিকে দিলে অনায়াশে সন্তান সঠিক পথ খুঁজে পাবে। অন্যদিকে সমাজের নেতৃস্থানীয়
অভিভাবকরা কোন দায় অনুভব করেন না । সামাজিক দায়বদ্ধতা জাগ্রত করা না গেলে অসৎ সামাজিক
কাঠামো শত-শত অসৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেই। সব সংকটের শুরু হচ্ছে সমাজে। সমাজে অসৎ,
খারাপ, লুটেরা, ঘুষখোর, মাস্তানদের মাথা উঁচু করে চলার সাধারণ মানুষ সুযোগ দেয় বলেই
এরা শক্তি পায়। সমাজে বিপরীতমূখী সাংঘর্ষিক একাধিক মনগড়া ধর্মীয় মতবাদ ছড়িয়ে দেয়া হয়
বলেই সমাজ অশান্ত অস্থির-রক্তাক্ত হয়। সামাজিক শাসন সুসংহত না হলে রাষ্ট্রীয় শাসনের সুফল কোন কালেই পাওয়া যাবে
না।
অফিসের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা অসৎ হলে দিন
দিন তার আশপাশে থাকা অনেকেই তাল মেলাতে মেলাতে অসৎ হয়ে উঠে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা
প্রবিধান অনুযায়ী খুবই ক্ষমতাধর। পরিদর্শক, সহকারী পরিদর্শক, অতিরিক্ত পরিদর্শক, হাবিলদার,
সিপাহী এসব পদ থাকলেও প্রত্যেকটি থানায় একাধিক কোষাধ্যক্ষ রয়েছে। এসব কোষাধ্যক্ষ ফুটপাতের
সব দোকান, মদ ও নেশার দোকান থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে। ফলমূল, শাক-সব্জি, অতিথি পাখি,
বাগানের বড় বড় লিচু, খাল বিলের বড় বড় মাছ এসব কিছু চলে আসে ক্ষমতাধর কর্তার কাছে। থানার
কোষাধ্যক্ষ মাঝে মধ্যে মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দেখা দেয়, মাসোহারা ঠিকমত না পেলে। ট্রাফিক সিগন্যালের ট্রাফিক ভ্যান রিক্সা ট্রাক
থেকে প্রকাশ্যে উৎকোচ নেয়। এই যে এতসব নেয়ার চিত্র তুলে ধরলাম এগুলো এখন পদ্ধতি। অসৎ
বলয়ে সবাই অসহায়। উর্দ্ধতনদের ঘুষ দিয়ে নিয়োগ, উর্দ্ধতনদের সাথে সাথে থাকতে হলে পুরো
দস্তর অসৎ হয়ে যাওয়ায় সবই অসৎ সঙ্গে সর্বনাশের মত। তাই সবাই বন্ধু নয়, সবাই সহপাঠী
নয়, সবাই প্রেমাস্পদ কিংবা প্রেমিক নয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন