বৃহস্পতিবার, ৮ নভেম্বর, ২০১৮

পরগাছা-আগাছামুক্ত রাজনীতি



সংলাপ ॥ গাছ-গাছালির মধ্যে যে ক্ষতিকর ও অপ্রয়োজনীয় গাছ বেড়ে উঠে সেটাই আগাছা। গাছের যতœ নেয়া না হলে আগাছাই সেখানে বড় হয়ে দেখা দেয়। এমনকি প্রয়োজনীয় গাছটিকে প্রায় নিঃশেষও করে দিতে পারে আগাছা আর স্বর্ণলতার মতো পরগাছারা। অযত্ন-অবহেলায় থাকা এদেশের যে-কোনো ফসলের জমি, বাগান বা বাগানের গাছের দিকে তাকালে এমন দৃশ্য চোখে-পড়ে সহজেই। গাছের মতো রাজনীতির অঙ্গনেও আগাছা ও পরগাছা জন্মে। কয়েকশ’ বছর ধরে এই বাংলা তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অসংখ্য বিপ্লবী, স্বাধীনতা সংগ্রামীর নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন ও লড়াই সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু ১৯৭১’র ৭ মার্চে লক্ষাধিক মানুষের সামনে এসে ঘোষণা দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এরই ধারাবাহিকতায় বহু আত্মত্যাগে এলো ১৬ ডিসেম্বর, বিশ্বের মানচিত্রে স্থান পেলো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লাখো জনতার সমাবেশে বললেন, ‘আমার স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে’।
২৪ জানুয়ারি কাদেরিয়া বাহিনীর অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি তোমাদের তিন বছর কিছু দিতে পারবো না। আরো তিন বছর যুদ্ধ চললে, তোমরা যুদ্ধ করতে না? (উত্তর, ‘করতাম, করতাম’) তা হলে মনে কর যুদ্ধ চলছে, তিন বৎসর যুদ্ধ চলবে। সেই যুদ্ধ দেশ গড়ার যুদ্ধ। অস্ত্র হবে লাঙ্গল আর কোদাল।’-তারপর যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে চললো ব্যাপক আয়োজন। সেদিন সবই হয়তো ঠিক ছিল, কিন্তু রাজনীতিতে যে আগাছা ও পরগাছা রয়ে গিয়েছিল এবং নতুন করে জন্ম নিচ্ছিল সেদিকে খেয়াল দেয়ার সময় পাননি তিনি, কারণ তিনি সার্বক্ষণিক নিয়োজিত ছিলেন বাংলা ও বাঙালি জাতির উন্নতির ভাবনায়। কিন্তু এরই মাঝে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কত আগাছা ও পরগাছা জন্ম নিয়েছিলো তা জাতি বুঝতে পেরেছিল ৭৫’র ১৫ আগষ্টের পর।
বঙ্গবন্ধু সরকারকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির গাছ ধরলে সেই গাছেই আগাছা ও পরগাছা হিসেবে খন্দকার মোশতাক গং (বঙ্গবন্ধু সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী!) যে কীভাবে পেঁচিয়ে ধরে জীবনীশক্তি শোষণ করেছিল এবং আজও করছে তা বাঙালি জাতির উপলব্ধিতে আজও বিদ্যমান। বঙ্গবন্ধু সরকারের কোনো মন্ত্রী, সশস্ত্রবাহিনীর কেউ তাঁর দলের কোনো নেতা-কর্মী, সেদিন সেই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ করার সৎ সাহস দেখায় নাই। রাজনীতির আগাছা-পরগাছাগুলো বড় হয়ে যাওয়ার কারণে সেদিন বাঙালি জাতি হয়ে পড়েছিল নেতৃত্বহীন এবং বাকরুদ্ধ। মোশতাক স্বাধীনতার পর কীভাবে বঙ্গবন্ধু সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠেছিল, মুজিবনগর সরকারের নির্ভিক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে তৎকালীন সরকার থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল, সেই ঘটনাগুলোকে বাস্তবতার নিরীখে উপলব্ধি করা আজও বড় বেশি প্রয়োজন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেশরত্ন কন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবারের জাতীয় শোক দিবসের এক অনুষ্ঠানে দুঃখ করে বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করে যে জাতি বীরের জাতিতে পরিণত হয়েছে, ৭৫’এর ১৫ আগষ্টে তাঁকে হত্যার মধ্য দিয়ে সেই জাতির একাংশ দেশ ও জাতির কাছে ঘাতক হিসেবে  পরিচিতি লাভ করেছে। বঙ্গবন্ধুর সাথে একজন মেজরকে তুলনা করার ধৃষ্টতা দেখানো হয়েছে, যা শান্তি (ইসলাম) ধর্মের পরিপন্থী। দুঃখের বিষয় এখনো ষড়যন্ত্র চলছে। দীর্ঘ একুশ বছর খোদ্ বঙ্গবন্ধুর নামটিকেই বাংলাদেশে সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে রাজনীতির পরগাছা ও আগাছাগুলোই ডালপালা মেলে এদেশের গণমানুষের রাজনীতি ও রাষ্ট্রের চালিকা শক্তিকে আদর্শহীন ও লুটপাটতন্ত্রে পরিণত করেছিল। এর সংক্রমণ দেশের প্রশাসনসহ সর্বস্তরে আজও বর্তমান। জিয়াউর রহমানের আমলে দেশের ছাত্র-যুবসমাজের চরিত্রকে কলংকিত করার জন্য যে ইয়ুথ কমপ্লেক্স গঠন এবং হিজবুল বাহার জাহাজে চড়ানো হয়েছিলো সেই ধারাবাহিকতা অর্থাৎ, রাজনীতিতে আগাছা তৈরির যে বীজ বপন করা হয়েছিল তার পরিণতি আজও বহন করতে হচ্ছে দেশ ও জাতিকে। এদেশের যে রাজনীতি একদিন ছিল সমাজসেবা, আজ তাই হয়ে উঠেছে ব্যক্তি ও কায়েমী স্বার্থ উদ্ধার এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের হাতিয়ার। এরই ধারাবাহিকতায় ছাত্র রাজনীতির নামে আজ দেশসেবা নয়, সন্ত্রাস ও নিজের আখের গুছানোর রাজনীতি হচ্ছে। আর এ কাজটি করার জন্যই আগাছা-পরগাছা রাজনীতিক ও ছাত্র-যুবকেরা ছাত্রলীগ তথা আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী একটি সংগঠনের ভেতরে ঢুকে পড়েছে, কলংকিত হচ্ছে ছাত্রলীগ আর আওয়ামী লীগ এর রাজনীতিকরা।
রাজনীতির অঙ্গনে এই দুরাবস্থার জন্য যারা শুধুমাত্র ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগকে দোষারূপ করে এর সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছে তারা বিভ্রান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে শুধুমাত্র রাজনীতির পানি ঘোলাটে করছে, তাই রাজনীতির অঙ্গনে সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের গোটা রাজনৈতিক অঙ্গনকেই আগাছা ও পরগাছা মুক্ত করা আজ জরুরি হয়ে পড়েছে। এর জন্যে সব অঙ্গনেই যত ত্যাগের প্রয়োজন তা দৃঢ় প্রত্যয়ী হয়ে বাঙালি জাতিকেই করতে হবে দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই, যেহেতু তিনি জাতির কাছে ওয়াদাবদ্ধ।
ইংরেজী শব্দ ‘পলিটিক্স-এর বাংলা ‘রাজনীতি’ শব্দটির সংস্কার প্রয়োজন। ইংরেজ আমলের তথাকথিত বাঙালি পন্ডিতদের করা অনুবাদ ‘রাজনীতি’র পরিবর্তে এখন ‘জননীতি’ শব্দটি চালু করলে অনেক বেশি প্রান্তিক মানুষের কাছাকাছি আসা যাবে এবং এর কার্যকারিতা জাতিকে আরও বলিষ্ঠ করবে। নিজের সমাজ ও দেশ গঠনে মনোনিবেশ না করে যারা শুধুমাত্র নিজেদের আখের গোছানোর জন্য রাজনীতিতে প্রবেশ করে তারাই লাখো শহীদের আত্মার সাথে বিশ্বাসঘাতকতাকারী এবং নিজ নিজ কামনায় ধরা পড়ে তারাই রাজনৈতিক অঙ্গনে আগাছা হয়ে আজও বর্তমান। এরাই ‘ইন্দুরের’ মতো ধানের গোলা থেকে ধান নষ্ট করে ফেলছে। সার্বিক অঙ্গনে এইসব আগাছা-পরগাছাদের সংস্কারের মাধ্যমে যতো বেশি সম্ভব উপড়ে ফেলা যাবে এবং নির্মূল করার চেষ্টা করা যাবে, দেশ ততো দ্রুত ক্রমোন্নতির দিকে এগিয়ে যেতে পারবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন