সময়ের
দাবী
একই
সুরে একই তালে দেশ ও জাতির জয়ধ্বনি
সংলাপ ॥ ১২ মাসে তেরো পার্বন। কথাটি বহুল
প্রচলিত। বাংলার ১২ মাসে পর্যায়ক্রমে এই পালা-পার্বন আবহমানকাল থেকে চলে আসছে। ঐতিহ্যের
শেকড় থেকে, নাড়ির বন্ধন থেকে। বাস্তবে বাংলার হিন্দু, মুসলিম, খৃষ্টান, বৌদ্ধ সব ধর্মাবলম্বী
আপামর জনসাধারণ এই উৎসবগুলোর সাথে জড়িত। তাদের শরীরে এই মাটির সোঁদা গন্ধ, পায়ে পলি
মাটির কাঁদা, কপালে চিক্চিক্ করে পরিশ্রমী ঘাম। কর্মের পূর্ণতায়, অবসরের আনন্দে, সম্প্রীতিতে,
ভ্রাতৃত্বে, বন্ধুত্বতায় রাম-রহিম-জন এক হয়ে যায়। এরা বাংলার কৃষক, ক্ষেতমজুর, শ্রমিক
- এদের কন্ঠে আছে জারি-সারি, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, লালন, বাউল গানের সুর - এরা বাঙালি।
অবশ্য আমাদের শহুরে তথাকথিত আধুনিক প্যান্ট-শার্ট পরা ‘বঙ্গ’ সন্তানদের কথা আলাদা।
এরা সংস্কৃতিতে পরজীবী, কর্মে মধ্যসত্ত্বভোগী, পোশাকে আরাবিয়ান বা খৃষ্টান, উৎসবে জগাখিঁচুড়ী
- এরাও বাঙালি। এরা কথা বলে বাংলায়, স্বপ্ন দেখে কানাডা-লন্ডন-আমেরিকার বা আরবের। এরা
স্বাধীন দেশের মর্যাদা সম্পন্ন নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার চেয়ে অধিক পছন্দ করে পরদেশে
দ্বিতীয় শ্রেণীর পরাধীন নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকতে। এরা পরশ্রীকাতরতায় উন্মুখ। দুঃখজনক
হলেও সত্য, সমাজে এই শ্রেণীর লোকের সংখ্যা আজ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলছে। আর তারই ফলশ্রুতিতে
গড়ে উঠছে মিশ্র মানসিকতায় জাতিসত্তা। এই ভয়াবহ সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন করবে কে?
খুঁজতে হবে এর সূত্র আমাদের জন্মের পূর্ববর্তীকালে
প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় বিদেশী সংস্কৃতির অনুকরণের মধ্য দিয়ে। জন্মের পর পরই আমাদের
বেড়ি পড়ানো হয় ধর্মের শিকলে, নাম রাখার মধ্যে দিয়েই যার শুরু। তুমি রমেশ, তুমি কাশেম,
তুমি হ্যারিসন। তুমি হিন্দু, তুমি মুসলমান, তুমি খৃষ্টান - কিন্তু তুমি মানুষ না। তুমি
বাংলা ভাষায় কথা বলবে - কিন্তু তুমি বাঙালি না। কিন্তু কাশেম বুঝলো না, সে কেন কাশেম,
সে কেন মুসলমান? জন্মের পর থেকে নামের আদলে এই যে সাম্প্রদায়িকতার আবর্তে আমাদের বেড়ে
ওঠা, পরবর্তীকালে কি আমরা এর থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি? আমরা অনেকে অনেক প্রগতিশীল কথাবার্তা
বলি, এই সমাজ ভেঙ্গে নতুন সমাজ গড়ার কথা বলি। আমাদের মধ্যে কেউ কি এই সাম্প্রদায়িক
নামের উর্ধ্বে উঠতে পেরেছি? পেরেছি কি সাম্প্রদায়িক সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের উর্ধ্বে
উঠতে? হতে পেরেছি কি সংস্কারমুক্ত? আমরা অনেকে অনেক বড় বিপ্লবী, প্রগতিশীল, কিন্তু
তারপরেও মুসলমান, হিন্দু, খৃষ্টান। তত্ত্বে বিপ্লব সাধন করা যতটা সহজ তার চেয়ে অনেক
অনেক বেশি কঠিন নিজের জীবনে, পরিবারে, সংস্কারাচ্ছন্ন সামাজিক অনুশাসনের পরিবর্তন সাধনের
ভাঙ্গা-গড়ার খেলা খেলতে। আমাদের দেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, বিপ্লবীরা কি এই দিকে দৃষ্টিপাত
করবেন?
আসলে ধর্ম বলি আর দর্শন বলি তার মধ্যে
সাম্প্রদায়িকতার স্থান নেই। থাকার কোনো যুক্তিও নেই। সব মানুষ একই স্রষ্টার সৃষ্টি
কিংবা সব মানুষের মূল উৎস একই। তাহলে একের সঙ্গে অপরের বিবাদের যুক্তি কোথায়? সুতরাং
বিভেদ নয় ঐক্য, সংঘাত নয় সম্প্রীতিই হওয়া উচিত সব মানুষের জীবন দর্শন। এই কথাই বলা
হয়েছে প্রতিটি ধর্মশাস্ত্রে এবং এটাই সব দর্শনের নিগূঢ় কথা। তাই সাধক নজরুলের ভাষায়
বলি
‘গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই,
নহে কিছু মহীয়ান্’।
বাংলার ঐতিহ্য পাঁচ হাজার বছর প্রাচীন
হলেও এই ভাষার প্রাণের স্ফূরণ ঘটে চৌদ্দ শতকে। ওই সময়ের সঙ্গীতাবলীতে নিঃসৃত হয়েছিলো
জগৎ ও জীবনের তত্ত্ব বিষয়ক অনেক নিগূঢ় তত্ত্ব, সংঘবদ্ধ হয়েছিলো
বাঙালির জাতীয় ঐক্য ও মিলনের আকাংক্ষা অর্থনৈতিক কারণে নয়, নৈতিক দিক থেকে সময়টা ছিল
দুঃসময়। বাংলাদেশে তখন ধন ছিল, টোল-চতুস্পাটি ও পন্ডিত ছিলেন অজস্র। তবু সর্বত্র ধ্বনিত
হচ্ছিল হাহাকার। এই অবস্থারই এক সার্থক চিত্র পাওয়া যায় বিদ্যাপতির এই ছত্রে :
কত বিদগ্ধজন, রস অনুমানই
অভিনব কাহুক ন পেখঁ।
বিদ্যাপতি কহে, প্রাণ জুড়াইতে
লাখে না মিলে এক।
বিদ্যাপতির এই আক্ষেপ আজকের বাংলাদেশের
বেলায়ও যেন আক্ষরিক অর্থেই প্রযোজ্য। আজও চারিদিকে অজস্র পন্ডিত, বিশেষজ্ঞ, আলেম-ওলামা
রয়েছেন; তত্ত্বকথা শাস্ত্রকথাও আওড়ানো হচ্ছে হরহামেশা; কিন্তু এর অনেকটাই যেন শুধু
গালভরা বুলি। জীবনে ও সমাজে যার কোনো প্রতিফলন নেই। আর তা নেই বলেইতো সর্বত্র ধ্বনিত
হচ্ছে হাহাকার, সবাই উচ্চারণ করছেন মূল্যবোধের কথা, সামাজিক অবক্ষয়ের কথা, অনেকটা বিদ্যাপতির
আমলের মতো। আমরা পরিবর্তন চাচ্ছি আকুন্ঠ প্রাণে। কিন্তু পরিবর্তন চাচ্ছি বারবার ভুল
মানুষদের কাছে। বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতিবাজ বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে নিতে চাচ্ছি জ্ঞানের
খোরাক। তাইতো হোঁচট খাচ্ছি বারংবার। উন্নয়নের চাকা থমকে যাচ্ছে প্রতি পদক্ষেপে। আমরা
জানি একটি প্রদীপ যেমন রাতের অন্ধকার ঘোচাতে পারে না, তেমনি একক ব্যক্তির চেষ্টায়ও
সাধিত হয় না সমাজের ব্যাপক কল্যাণ। এর জন্য প্রয়োজন সব মানুষের সমবেত প্রচেষ্টা। এটাই
মানুষের পূর্ণতার সাধনা। আমরা সবাই কি এই সাধনায় লিপ্ত হতে পারি না? আমাদের সমাজের
বিজ্ঞজন, দিক নির্দেশনাকারীগণ, ধর্মজীবী,
বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, পণ্ডিত, রাজনীতিক এবং কল্পনার জগতে ভাসমান প্রগতিশীল বিপ্লবীরা
কি এই সাধনায় লিপ্ত হতে পারে না একই সুরে দেশ ও জাতির জয়ধ্বনি করতে?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন