সময়ের সাফ কথা....
সংকীর্ণতায় জর্জরিত !!
শেখ উল্লাস ॥ ফেব্রুয়ারি মাস, ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত তথা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার মাস। আমাদের পত্র-পত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক টিভি মাধ্যমগুলোতে এ নিয়ে কত অনুষ্ঠান, টক শো,
সাক্ষাৎকার, নাটকই না প্রচারিত হয়। মাতৃভাষা বাংলার গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে কত কথাই না বের হয় পত্রিকার পৃষ্ঠায় আর টিভির পর্দায়।
কিন্তু স্বাধীনতার ৪৬ বছর এবং বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ৬৫ বছর পর আজকের বাংলাদেশের বাস্তবতা হচ্ছে মাতৃভাষা বাংলা আজ অতীতের যে কোনো সময়ের চাইতে অনেক বেশি অবহেলিত। পারতপক্ষে আজকের দিনের শিক্ষিত ও সমাজের কথিত উপরতলার মানুষেরা বাংলা মাধ্যমে তাদের ছেলেমেয়েদেরকে পড়ান না। এইসব ভদ্রলোক তাদের বড়ত্ব, পান্ডিত্য ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে ইংরেজি শব্দ ও বাক্য উচ্চারণে দক্ষতার পরিচয়টি দিতে ভুল করেন না। খুব সচেতনভাবেই কথায় কথায় ইংরেজি বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। অথচ তাদেরই কেউ কেউ আবার সরকারী বা বেসরকারী টাকা খরচ করে পুষ্পস্তবক নিয়ে একদিনের জন্য মাতৃভাষা প্রেমিক সেজে শহীদ মিনারে যান। কিন্তু প্রায় ষোল কোটি মানুষের এই দেশে এইসব ভদ্রলোকের সংখ্যা কত আর হবে!
ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। দেশকে, দেশের মানুষ ও মাতৃভাষাকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসেন, জনগণের কল্যাণ কামনা করেন এমন শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা কম হলেও তারাই আবার অন্ধকারে আলোকবর্তিকা হিসেবে সমাজে ভূমিকা পালন করে চলেছেন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের কাছে সে আলো পৌঁছুতে পারছে না। একদিকে বিশ্বায়ন, অপরদিকে অনিয়ন্ত্রিত উৎস থেকে আসা অঢেল পুঁজির জোয়ারে, মিডিয়ার ঝলমলে রঙিন ও কৃত্রিম আলোর কাছে ফিকে হয়ে উঠেছে সত্যানুসন্ধানীদের অকৃত্রিম আলোকবর্তিকা। অধিকাংশ সাধারণ মানুষেরই আজ ধারণা এমন হয়েছে যে, ‘ইংলিশ মিডিয়াম-এ না পড়ালে সন্তানকে আর মানুষ করা যাবে না। শিক্ষাকে বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে ব্যবহার করার এমন দূরাবস্থা বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনো কেউ দেখেছে কিনা জানা নেই।
লাখো শহীদের তাজা রক্তে কেনা পলাশ-শিমুলের এই দেশে আজ একটু চিন্তাশীল দৃষ্টি নিয়ে তাকালেই দেখা যায় যে কোনো উপায়ে যার কাছেই কিছু নগদ পয়সা এসেছে তারা তাদের সন্তানকে ‘শিক্ষিত’ করে তোলার স্বপ্ন নিয়ে ‘ইংলিশ মিডিয়াম’ স্কুলে পাঠিয়ে দিচ্ছে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে কোনো কোনো মা-বাবা এমনও আছেন যাদের ইংরেজি ভাষা কেন বাংলা ভাষাতেই কোনো দক্ষতা নেই, শুদ্ধ করে বাংলা বলার কোনো চর্চা তাদের পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশে নেই। তারা তাদের ছেলেমেয়েদেরকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পাঠিয়ে দিয়ে ভাবছেন মা-বাবা হিসেবে নিজেদের সঠিক ও পূর্ণ দায়িত্ব শেষ করে ফেলেছেন। কিন্তু পরিণামে দেখা যাচ্ছে তার সন্তানের বাংলাও শেখা হচ্ছে না, ইংরেজি শেখা তো দূরের কথা। উপরন্তু শৈশবের আনন্দ-উচ্ছ্বাস থেকে তাকে বঞ্চিত করে বাংলাদেশেই তাকে ‘নিজ দেশে পরবাসী’ করে তোলার একটি মহড়া দিয়ে চলেছে। অপরদিকে যে পরিবারের ছেলেমেয়েরা অপেক্ষাকৃত বেশি সুবিধাভোগী তারা ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে বাংলাদেশের সুনাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠতে পারছে না। সময়-সুযোগ বুঝে তারা ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি জমাতে নিজেদের সর্বশক্তি নিয়োগ করছে। বাংলা মাধ্যম থেকে পাস করে আসা স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের তুলনায় তারা নিজেদেরকে উন্নত ও অগ্রসর প্রজন্ম হিসেবে গণ্য করতে শিখছে। দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, জনসেবাসহ যাবতীয় মানবীয় মূল্যবোধ যা আমাদের আবহমানকালের শিক্ষা-সংস্কৃতির উৎস, এ ক্ষেত্রে উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে। সমাজ ও দেশকে শান্তি, সাম্য ও সত্য ধর্মের পথে চালিত করার ক্ষেত্রে এ ধারার পরিবর্তন অবশ্যই করা উচিত বলে মনে করে সত্যানুসন্ধানীরা। ঔপনিবেশিক ইংরেজ আমলে শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি লক্ষ্য করে বিগত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে ব্রতচারী আন্দোলনের প্রবর্তক মহীয়ান বাঙালি গুরু সদয় দত্ত লিখেছিলেন -
‘মোরা শিক্ষা বলি কাকে?
পরীক্ষা দিয়ে ভিক্ষা করা,
চাকরি ঝাঁকে ঝাঁকে
এই পরের উপর হুকুম ঝেড়ে
নবাবী করাটাকে
আর ওই ঘি-ভাত খেয়ে ভুঁড়ি
গজিয়ে ভদ্র বনাটাকে।
এই গতর খাটে যারা তাদের ঘেন্না করাটাকে।’
একটি স্বাধীন দেশের, যে দেশের অভ্যুদয়ের পেছনে আপামর জনগণের সমান সমান অবদান, সেখানে কেউই কাউকে ঘেন্না করতে শিক্ষা গ্রহণ করবে এমনটা কোনো বিবেকবান মানুষ কখনো কামনা করতে পারে না। যারা দেশ-জাতিকে পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন তারা এ বিষয়টি যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করতে পারবেন ততই দেশের মঙ্গল। আর তা না হলে ভাষার মাসের জন্য যাবতীয় আয়োজনই হবে মায়াকান্নার শামিল। সত্যানুসন্ধানীদের জিজ্ঞাসা তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের এই সংকীর্ণতা দূর হবে কবে ?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন