পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন : বাঙালির বিশ্বযুদ্ধ
সত্যদর্শী
॥ খুঁটিনাটি নানান অংক কষে বলা যায় পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন বাঙালির বিশ্বযুদ্ধ। আত্মমর্যাদা
অর্জনে বিশ্বময় সুতীব্র প্রকাশ। দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্রকারীর মুখে চুনকালি মেরে দেশরত্ন
শেখ হাসিনার নৈতিক দৃঢ়তার বিজয় তথা বাঙালির বিশ্বজয়। অদম্য সাহসী, দৃঢ়চেতা অনন্য দৃষ্টান্ত
স্থাপনকারী এক দেশপ্রেমিকের অহংকার। ফলে স্বভাবতই সূত্র মিলিয়ে দেখার তাগিদ আসে। পৃথিবীতে
বহু কারণে বহু যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এসব যুদ্ধের কোনো কোনোটি বিশ্বযুদ্ধে রূপান্তরিত
হয়েছে যুদ্ধের ব্যাপকতা বিবেচনায়। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে চলছে অর্থনৈতিক যুদ্ধ। বিশ্বমোড়লদের
শত বাধা বিপত্তি মোকাবেলা করে বাঙালিরা যে অর্থনৈতিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে সেটি দেশের
মানুষের কাছে বিশ্বযুদ্ধ বৈ আর কিছু নয়। বাংলাদেশ তার অস্তিত্বের বিকাশ ও প্রকাশের
ধারাবাহিকতায় যে পথ পাড়ি দিয়েছে সেখানে ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীতে মানবতাবিরোধী
অপরাধীদের বিচার ও পদ্মাসেতুর মত বহুমাত্রিক মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করছে। এসব প্রত্যেকটি
অধ্যায় বাঙালির এক একটি বিশ্বযুদ্ধ।
স্মরণে
রাখতে হবে, পদ্মা সেতু নির্মাণের বাস্তবতা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় উন্নয়ন ষড়যন্ত্র।
সেই পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ ইতোমধ্যেই ৩৪ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য
দাতা সংস্থার অর্থায়ন ব্যতীত। চলতি বাজেটেও পদ্মা সেতুতে অর্থায়নকে অগ্রাধিকার দেয়া
হয়েছে।
পত্রিকায়
কাল্পনিক বৈঠকের ছবি কিংবা কোথাকার কোন রমেশের ডায়েরির কাহিনী কীভাবে একটি দেশের এত
বড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সে সব চুলচেরা বিশ্লেষণ
করে দেখতে হবে। বিশ্বব্যাংকের একজন কান্ট্রি ডিরেক্টর কেন কীভাবে প্রতিদিন গণমাধ্যমের
সামনে একটি স্বাধীন দেশের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করার দুরভিসন্ধিতে ঝাঁপিয়ে
পড়েছিল এ সবই গুরুত্বসহকারে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কোন দুর্নীতি না করেও একজন মন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট
আমলা পাঠার বলি হবার পরও বিশ্বব্যাংকের অপতৎপরতা কেন থামেনি সেটা গভীরভাবে ভেবে দেখার
অবকাশ রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা জাতির বৃহত্তর স্বার্থে পদক্ষেপ
নেবার পরও কেন বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন থেকে বিরত থাকলো, অর্থ মন্ত্রণালয় সেদিন বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের বিপরীতে কি কি বলেছিল
আর কতটুকু করেছিল তাও মিলিয়ে দেখা জরুরি।
স্বাধীন
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ষড়যন্ত্রের যোগসূত্র খুঁজতে সর্বত্র ঘুরেছেন বিশ্বব্যাংকের
অনুসন্ধানকারী দলের সদস্যরা। তারা কি পেয়েছেন তা জানানোর প্রয়োজন পর্যন্ত বোধ করেননি।
দুর্নীতি দমন কমিশন কিংবা কানাডার আদালত বিশ্বব্যাংকের কাছে আইনী প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয়
তথ্য সহযোগিতা চাইলেও তারা কোন জবাব দেননি। কেন দেয়নি, কেন দেবার প্রয়োজন বোধ করলেন
না, কোন দায়িত্বশীলতা তারা দেখালেন এখানে? না কি কেবলই বিশেষ চাপে, বিশেষ কারণে সংঘটিত
ওই নাটকের নেপথ্যের কারিগরদের নাম-ছবি প্রকাশ অযোগ্য! স্থানীয় একটি দৈনিকে পদ্মাসেতু
ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত একজন ব্যক্তির ব্যাক সাইডের ছবি ছাপা হয়েছিল সেই ছবিরই বা উৎস
কি ছিল? একাধিক দৈনিকে রম্য রচনা লেখা হয়েছিল সেগুলোর নেপথ্যে কি কোন উদ্দেশ্য ছিল?
বাজারে প্রচলিত আছে, একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ৬৬০০টি মেইল পাঠানো হয়েছিল বিশ্বব্যংকের
সদর দফতরে- সে সবও খতিয়ে দেখতে হবে। কেন নিজস্ব অর্থায়নে কিংবা প্রাইভেট পার্টনারশিপে
পদ্মাসেতু সম্ভব নয় বলেছিলেন আমাদের অর্থমন্ত্রী? বিশ্বব্যাংকের মত প্রতিষ্ঠানের অল্প
সুদের সুযোগ হাতছাড়া করা নেহায়েত মন্দভাগ্য এর জন্য তিনি অতিশয় হতাশ হয়ে পড়েন। যারা
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণের পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছিলেন তাদের সাথে তিনি একমত
পোষণ করেননি বরং চরম রুষ্ট হয়েছিলেন তাদের প্রতি। এমনকি বর্তমান যোগাযোগমন্ত্রী যখন
পদ্মাসেতুর কাজ অচিরেই শুরু হবে বলে বারবার গণমাধ্যমকে জানাচ্ছিলেন তখন অর্থমন্ত্রী
মহোদয় যোগাযোগমন্ত্রীর সেসব কথনকে ভাবাবেগ তাড়িত, অবাস্তব বলতেও দ্বিধা করেননি।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের
মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণে দেশরত্ন শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়িয়ে যেসব অর্থনীতি
বিশেষজ্ঞ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব বলে যুক্তি দেখিয়েছিলেন তাদের বর্তমান
পজিশন কোথায় সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে। বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন কান্ট্রি ডিরেক্টর যখন যা ইচ্ছা তাই বলছিলেন আর প্রতিদিনই বৈদ্যুতিন
মাধ্যমের শিরোনাম হয়ে আসছিলেন তখন অর্থমন্ত্রণালয় তার মুখের লাগাম টেনে ধরতে কি ভুমিকা
নিয়েছিলেন তা গভীর অনুসন্ধানের দাবি রাখে। তবে এটি কারো ভুলে যাবার কথা নয় মাননীয় অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংককে চিঠি লিখেছিলেন এবং কিছুকালের জন্য
বিশ্বব্যাংকের সদর অফিসে সময় কাটিয়েছেন। ওই চিঠির জবাবে বিশ্বব্যাংক কোন উত্তর দিয়েছিল
কি-না তা অর্থমন্ত্রী মহোদয় আজও জানাতে পারেননি।
পদ্মাসেতু
নির্মাণ দেশের টাকায় হচ্ছে। নদী শাসন, দুই পারে জমি অধিগ্রহণ, সেতুর তীরে নয়নাভিরাম
গ্রাম নির্মাণ, একটার পর একটা পাইল নির্মাণ চলছে জোর কদমে। পদ্মাসেতুতে রেল নির্মাণে
সরকার টাকা বরাদ্দ রেখেছে। এসবই আজ সত্য। তবু আগুনে যার ঘর পুড়েছে সিঁদুর রাঙা মেঘ
দেখে তার ভয়। বাংলার আকাশে ষড়যন্ত্রের মেঘ সব সময় দেখা দেয়। এরই মধ্যে পথ চলা বড়ই ঝুঁকিপূর্ণ,
বড়ই সতর্ক থাকার আহবান জানায়। ভুলে গেলে চলবে না বাংলা প্রবাদ বাক্য - ‘সর্ষের মধ্যে
ভূত আছে।’
সূত্র
মিলিয়ে দেখতে হবে, ৭১-এ বিশ্বের সবচেয়ে পরাক্রমশালী দেশ ও তাদের দোসররা যারা বাংলাদেশ
নামক রাষ্ট্রের জন্মের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাদের বর্তমান অবস্থান কোথায়? পাকিস্তানের
মত শক্তিশালী ঘাতকদের মোকাবেলা করে স্বাধীনতা অর্জন ছিল বাঙালির বিশ্বজয়। কি করা হয়নি
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মকে বাধা দিতে? জাতিসংঘকে অপব্যবহারের জোর প্রচেষ্টা, সপ্তম
নৌ বহর পাঠানো, পরবর্তীতে স্বীকৃতি না দেয়ার চরমতম বর্বরতা সবই তো করা হয়েছিল। বপন
করা হয়েছিল ঘাতকবৃক্ষ।
৭৫-এর
হত্যাকান্ড ছিল ৭১’র পরাজয়ের প্রথম সফল আঘাত। তারপর জেঁকে বসা ঘাতকদেরকে পরবর্তীতে
মহামান্য হাইকোর্ট যাদেরকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে তাদের দুঃশাসন দেখতে
হয়েছে বাঙালিকে।
দীর্ঘ
তিন দশক ধরে রাজনীতির নামে, ব্যবসার নামে, সেবা সৃজনশীলতা, ঈমান-আকিদা রক্ষার নামে
চরিত্র বদলের রাজনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য সম্ভাব্য সবই করা হয়েছে। দেশের পুরো কাঠামোকে
বদলে ফেলার জন্য শত শত প্রতিষ্ঠান, শত শত দল-উপদল সৃষ্টি করা হয়েছে। আর্থ- সামাজিক
কাঠামোর পরতে পরতে দারুণ বিন্যাস। সেই ঘাতকদের
একটি অংশের বিচার সম্পন্ন হচ্ছে সমস্ত বাধা স্বত্বেও। কারা কারা বাধা দেয়? এ বাধা কোন্
প্রেমের কোন যোগসূত্র থেকে? এসবই রাজনীতির মাঠে সচেতন প্রতিটি নাগরিকের চিন্তার খোরাক
যোগাবে। দেশরত্ন শেখ হাসিনা সব বাধা অতিক্রম করে একটার পর একটা মানবতাবিরোধী অপরাধের
বিচার সম্পন্ন করছেন। এটা বাঙালির আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ নয় কি?
তিনি
বাংলাদেশের একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যিনি বলিষ্ঠভাবে জাতিসংঘে বিশ্বব্যাংকের সংস্কার
দাবি করেছেন। এটা শেখ হাসিনা তথা বাংলাদেশের প্রতিটি বাঙালির নৈতিক জয় এবং অর্থনৈতিক
বিশ্বযুদ্ধ। আর এ যুদ্ধে বাঙালির বিজয় অবসম্ভাবী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন