সিয়াম সাধনায় কুরআনের উপদেশ
সংলাপ ॥ ‘হে
আমানুগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে
দেয়া হয়েছিল, সম্ভবত (এ দ্বারা) তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারবে।’ (সুরা বাকারাঃ ১৮৩)।
আল্লাহ সুবহানাহু
ওয়া তায়ালা সিয়ামের বিধান দিয়েছেন আমানুদের জন্য। তাই এ আয়াতে সম্বোধন করা হয়েছে ‘ইয়া
আইয়্যু হাল্লাযীনা আমানু - হে আমানুগণ!’ তাই প্রথমেই জানা দরকার আমানু কারা। কুরআন
মতে জন্মগতভাবে কেউ আমানু হয় না। আমানুর ঔরসে আমানু জন্মের কোন প্রাকৃতিক ব্যবস্থা
নেই। মানুষ তখনই আমানু হয় যখন গুরুর আনুগত্য গ্রহণ করে কুরআনের বিধানকে নিজ জীবনে রূপায়িত
করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় এবং গুরুর প্রদর্শিত পথে কর্মে নিয়োজিত হয়। খাজা মঈন উদ্দিন
হাসান চিশতি বলেন - ‘যে ব্যক্তির শায়েখ, মুর্শিদ বা পথ প্রদর্শক নেই তার দ্বীন নেই।
যার দ্বীন নেই তার মারেফাতে এলাহি নেই। যার মারেফাতে এলাহি নেই সত্যপথের পথিকদের সাথে
তার সম্পর্ক নেই। সত্যপথের পথিকদের সাথে যার সম্পর্ক নেই তার কোন শুভাকাঙ্খী নেই। যার
শুভাকাঙ্খী নেই তার কোন বন্ধু বা মুর্শিদ নেই।’ যার মুর্শিদ নেই তার সিয়ামও নেই। সিয়ামের
বিধান দেয়া হয়েছে আমানুদের জন্য, যে এখনও আমানু হয় নাই অর্থাৎ যার মুর্শিদ নেই সে প্রকৃত
অর্থে সিয়াম করতে পারে না।
এরপর কুরআন
বলছে - ‘কামা কুতিবা আলাল্লাযীনা মিন কাবলিকুম’ - যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে
দেয়া হয়েছিল - এ অংশ থেকে বুঝা যায়, সালাতের মতো সিয়ামও কোন নব বিধান নয় যা কেবল মোহাম্মদ
(সা.) -এঁর অনুসারীদের জন্য অবশ্য পালনীয়। কুরআনের মাধ্যমে সিয়াম অবশ্য পালনীয় হিসেবে
নির্দেশ এসেছে দ্বিতীয় হিজরি সনে কিন্তু এর আগেও সিয়াম ছিল। হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু
করে মোহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত যত নবী-রসুলগণ আবির্ভূত হয়েছেন প্রত্যেকেই সিয়াম ধারণ-লালন-পালনের
নির্দেশ দিয়েছেন। হিন্দু, খৃষ্টান, ইহুদি, বৌদ্ধ, প্রভৃতি সম্প্রদায়েও সিয়াম পালনের
রীতি প্রচলিত ছিল, এখনও আছে। বেদ অনুসারীগণ সংযম ব্রত পালন করেন। প্রত্যেক হিন্দী মাসের
১১ তারিখে ‘একাদশীর’ সংযম পালনের রীতি রয়েছে। কার্তিক মাসের প্রতি সোমবারেও সংযম পালনের
রীতি প্রচলিত আছে। বেদ অনুসারী সাধকগণ ৪০দিন পানাহার ত্যাগ করে ‘চল্লিশে ব্রত’ পালন
করেন।
নূহ (আ.) ১লা
শাওয়াল ও ১০ জিলহজ ছাড়া সারা বছর সিয়াম করতেন। ইব্রাহীম (আ.) এবং তাঁর ভক্তগণ বৎসরে
এক মাস সিয়াম পালন করতেন। তওরাতে আছে, মূসা (আ.) তূর পাহাড়ে ৪০ দিন পানাহার না করে
কাটিয়েছিলেন। তাই মূসা (আ.) -এঁর অনুসরণে ইহুদীরা ৪০দিন সিয়াম রাখা উত্তম মনে করেন।
এছাড়াও ইহুদী ধর্মশাস্ত্রে অন্যান্য সিয়ামের স্পষ্ট হুকুম রয়েছে। দাউদ (আ.) এর যুগেও
সিয়াম ছিল। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার নিকট সবচেয়ে প্রিয় ছিল দাউদ (আ.)-এঁর সিয়াম।
তিনি একদিন অন্তর অন্তর সিয়াম করতেন। অর্থাৎ দাউদ (আ.) বৎসরে ৬মাস সিয়াম করতেন। কুরআনে
আছে, ঈসা (আ.) - এঁর যখন জন্ম হয় তখন লোকেরা তাঁর মা মরিয়মকে তাঁর জন্ম সম্পর্কে প্রশ্ন
করলে তিনি বলেন, ‘আমি করুণাময়ের উদ্দেশে সিয়াম করছি। সুতরাং আজকে আমি কোন মানুষের সাথে
কথা বলবো না।’ (১৯ সুরা মরিয়মঃ ২৬ আয়াত)। ঈসা (আ.) জঙ্গলে ৪০ দিন সিয়াম করেছিলেন। একদা
ঈসা (আ.)-কে তাঁর অনুসারীরা জিজ্ঞেস করেন, আমরা অপবিত্র থেকে কিভাবে পবিত্র হবো? উত্তরে
তিনি বলেন, প্রার্থনা এবং সিয়াম ব্যতীত অন্য কোন উপায় নেই।’
ইতিহাস থেকে
জানা যায়, মোহাম্মদ (সা.) -এঁর পিতামহ আব্দুল মোত্তালেবও সিয়াম পালন করতেন। সিয়াম পালনকালে
আব্দুল মোত্তালেব হেরা গুহায় আরাধনা করতেন বলেও জীবনীগ্রন্থে উল্লেখ আছে। তৎকালে মক্কার
হানিফ সম্প্রদায় আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসী ছিল। হানিফগণ ৫৭০ খৃষ্টাব্দের পূর্ব থেকেই
রমজান মাসে মদ্যপান, যৌনকর্ম বন্ধ রাখতেন এবং সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সিয়ামব্রত
পালন করতেন এবং নির্জনবাসের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির সাধনা করতেন। কুরআনের আয়াত - ‘যেমন
বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে দেয়া হয়েছিল’ - উক্ত ঐতিহাসিক তথ্যগুলোর সত্যতা প্রমাণ
করে।
আয়াতের পরবর্তী
অংশে বলা হয়েছে - ‘লা আল্ল্লাকুম তাত্তাকুন’, তাত্তাকুন শব্দের যেসব অর্থ পাওয়া যায়
তা হলো - সংযম/সাবধান/সতর্ক থাকা, মুত্তাকীর গুণাবলী অর্জন করা, তাকওয়া অর্জন করা।
কোন কোন অনুবাদক ‘তাত্তাকুন’ শব্দের অর্থ করেছেন তাকওয়া। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তাকওয়া
অর্জন করাই লক্ষ্য। শুধু এক মাসের সংযমে তাকওয়া অর্জিত হয় না। আমানু থেকে মুত্তাকীর
স্তরে উন্নীত হতে হলে সংযমের চর্চা হতে হবে জীবনব্যাপী। কুরআন যে সিয়াম দর্শন উপস্থাপন
করেছে তাতে এক মাস উপবাসের কোন নিজস্ব মূল্য নাই। উপবাসের জন্য উপবাস নয়, তাকওয়া বা
মুত্তাকীর গুণাবলী অর্জনের লক্ষ্যে উপবাস একটা পদ্ধতি মাত্র। পানাহার ও যৌনসঙ্গম থেকে
বিরত থাকা কোন ইবাদত নয়, ইবাদতের বাহ্যিক রূপ বা আনুষ্ঠানিকতা।
‘তাকওয়া’ শব্দের
অর্থ ব্যাপক। বাংলায় এর ব্যাপকতাকে ধারণ করতে পারে ‘সাবধানতা’ শব্দটি। আল্লাহ্কে সামনে
রেখে বান্দা অতি সাবধানতার সঙ্গে তার যাবতীয় কর্ম সম্পাদন করবে। ফলে কর্মের মাধ্যমে
আল্লাহর উপর ‘তাওয়াক্কুল’ বা পূর্ণ নির্ভরতা আসবে।
তাকওয়া আত্মার
এমন এক শক্তি, যা ব্যক্তির আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। আত্মনিয়ন্ত্রিত ব্যক্তিই মুত্তাকী
হয়। মুত্তাকী সব সময় নিজ শাসনাধীন থাকে। যে কাজ মাওলার নৈকট্য লাভে সহায়ক হবে বলে তার
আত্মা অনুমোদন দেয়, কেবল সে কাজটিই সে করে। মুত্তাকী নিজেই বিধান। মুত্তাকীকে নিয়ন্ত্রণে
রাখতে কোন আইন-আদালত, বিধি-বিধান বা শাস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা নেই। এক শিষ্য রসুল (সা.)-কে
জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘হুজুর তাকওয়া কি?’ তিনি (সা.) নিজের বুকের দিকে ইশারা করে বলেছিলেন
- ‘তাকওয়া এখানে, তাকওয়া এখানে, তাকওয়া এখানে। তাকওয়া এমন একটা শব্দ যা অনেকগুলো গুণকে
ধারণ করে। সতর্কতা বা সাবধানতাও তাকওয়া। ওমর বিন খাত্তাব (রা.) উবাই বিন কা’ব -কে তাকওয়া
সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। উবাই (রা.) বলেন, ‘আপনি কি কাঁটাযুক্ত পথে চলেছেন? ওমর (রা.)
বলেন, ‘হাঁ’। উবাই বলেন, ‘কিভাবে চলেছেন’? ওমর বলেন, ‘গায়ে যেন কাঁটা না লাগে সে জন্য
চেষ্টা করেছি ও সাবধানতার সাথে চলেছি’। উবাই বলেন, ‘এ সাবধানতাই তাকওয়া’। কুরআন একাধিকবার
বলেছে ‘নিশ্চয় আল্লাহ্ সাবধানিদেরকে ভালোবাসেন’ (৩:৭৬, ৯:৭)। আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়াই
সর্বোচ্চ প্রাপ্তি।
লোভ-লালসায়
পূর্ণ বস্তুজগত যেন কণ্টকাকীর্ণ গিরিপথ। এ সরু গিরিপথের দু’ধারেই কাঁটা। প্রতিমুহুর্তে
বাহিরের জগত থেকে লোভ-লালসা, কামনা-বাসনা অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। অন্যদিকে নিজের ভিতরেও
চলতে থাকে শয়তানের কুমন্ত্রণা। ভিতরে এবং বাইরে চারিদিকে কাঁটা বিছানো পথে হাঁটতে হয়
গুরুভক্ত শিষ্যকে। তাই সাবধানতার এত গুরুত্ব। সাবধান না থাকলে কেউ এ পথে হাঁটতে পারবে
না। জগতের মায়ার কাঁটায় জড়িয়ে পথভ্রষ্ট হবে। নৌকা পানিতে চলে, নৌকার ভেতরে পানি ঢুকে
গেলেই নৌকাডুবির আশঙ্কা থাকে। সমাজের পাপ-পঙ্কিলতা, বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণা-প্রবঞ্চনাপূর্ণ
জগতে থেকে এসব হতে মুক্ত থাকতে আমানুকে সাবধানে দুনিয়াদারি করতে হয়। আমানু গুরুর আদেশে
কলুষযুক্ত সমাজে থেকেও নিজে থাকেন কলুষমুক্ত। গুরুর আদেশে পথ চলেন স্রোতের বিপরীতে।
তাই সাবধান না থেকে আমানুর পক্ষে সত্য পথে চলার আর কোন উপায় নেই। হুজুরে পাক (সা.)
বলেছেন, ‘ক্ষুধা ও তৃষ্ণা দিয়ে তোমরা নিজের সাথে যুদ্ধ করো।’ সাবধান থাকার জন্য ক্ষুধা-তৃষ্ণার
কষ্ট একটা কার্যকরী পদ্ধতি। ক্ষুধা ও তৃষ্ণা থাকলে ব্যক্তির চিন্তাজগতে একটা যুদ্ধ
চলতে থাকে - সেভাবে, ‘আমি ক্ষুধা ও তৃষ্ণার কষ্ট ভোগ করছি - মিথ্যা, অকল্যাণ ও অন্যায়
থেকে বেঁচে থাকার জন্য’। এই ভাবনা ভিতর থেকে বাইরে এবং বাইরে থেকে ভিতরের দিকে চাপ
প্রয়োগ করে, ফলে ব্যক্তির মধ্যে সাবধানতা আসে। এভাবে যে নিজের সাথে যুদ্ধের কণ্টকাকীর্ণ
পথের পথিক হয় সে প্রবৃত্তির ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ
প্রতিষ্ঠা করে। ফলে তার মধ্যে অশুভ শক্তিগুলো কার্যকারিতা হারায় এবং শুভ শক্তিগুলোর
কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়, জাগ্রত হয় মনুষ্যত্ব বোধ। মনুষ্যত্ব বোধ জাগ্রত হলেই মানুষ
প্রকৃত অর্থে ‘মানুষ’ হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। সুতরাং এক কথায় মনুষ্যত্বের পরিচর্যা,
তাকে পল্লবিত-কুসুমিত ও সুষমামন্ডিত করা সিয়ামের উদ্দেশ্য।
উক্ত আয়াতে
বলা হচ্ছে -‘সম্ভবত তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারবে’। অর্থাৎ, পানাহার থেকে বিরত থাকলেই
যে তাকওয়া অর্জিত হবে তা নয়, অনেকের তা হয়ও না। অনেক লোকই আছে যারা কেবল ক্ষুধা-তৃষ্ণার
কষ্ট ব্যতীত রোজা থেকে আর কিছুই পায় না। অনেকেই উপবাস করে কিন্তু কেন করে তা-ই জানে
না। এমনকি রমজান মাসে উপবাস থেকেও তারা আল্লাহর আদেশ অমান্য করে - মিথ্যা বলে, ওজনে
কম দেয়, পণ্যদ্রব্যে ভেজাল দেয়, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। তাই ‘সম্ভবত’ শব্দটির ব্যবহার।
সুরা বাকারার
১৮৪ থেকে ১৮৮ নং আয়াতে সিয়াম প্রসঙ্গে নির্দেশনা পাওয়া যায় যে, কেউ যদি অসুস্থ কিংবা
সফরে থাকে তবে সে যেন সুস্থ হয়ে গেলে কিংবা সফর থেকে ফিরে এলে তা আদায় করে নেয়। কারণ,
শারীরিক অসুস্থতা এবং সফর নিজের সাথে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।
সফরের উদ্বিগ্নতা এবং শরীরের যন্ত্রনা থাকলে সেদিকে মনোযোগ আকৃষ্ট হবে ফলে ব্যক্তি
তার মধ্যে বাহ্যিক জগত থেকে কি প্রবেশ করছে এবং নিজের মধ্যে কি ধরনের কুমন্ত্রণার সৃষ্টি
হচ্ছে এ সম্পর্কে সাবধান থাকতে পারবে না। আত্মশুদ্ধির পথে কোন জোর-জবরদস্তি চলে না।
তাই বলা হচ্ছে, কারো পক্ষে সিয়াম একান্ত কষ্টকর মনে হলে সে যেন একজন মিসকীনকে আহার্য্য
দেয়। যদি কোন ব্যক্তি এর অতিরিক্ত সৎকর্ম করে তবে তাকে অবশ্যই পুরষ্কৃত করা হবে। তবে
একথাও ঠিক যে, যারা সিয়াম করবে তারা এর উপকারিতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে এবং তারা নিশ্চয়ই
সিয়াম করবে।
পরবর্তী আয়াতে
রমজান মাসে কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার কথা বলা হয়েছে। শুধু কুরআনই নয়, অন্যান্য ন্যায়-অন্যায়ের
পার্থক্যকারী কিতাবও রমজান মাসেই নাজিল হয়েছে। হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সহিফা রমজান মাসের
১ তারিখে অবতীর্ণ হয়েছিল। রমজান মাসের ৬ তারিখে তাওরাত, ১২ তারিখে যাবুর এবং ১৩ তারিখে
ইঞ্জিল নাজিল হয়েছে। রমজানই কিতাব অবতীর্ণের মাস। আরবি ‘রমজ’ শব্দের অর্থ আগুন। রমজান
ও সিয়াম উভয় শব্দের মধ্যেই দহন করার উপাদান বিদ্যমান। সংযমের আগুনে পুড়ে আত্মশুদ্ধ
হয়ে মানস জমিন সত্যলাভের জন্য প্রস্তুত হয়। কদর অর্থ সম্মান। আত্মশুদ্ধির অনলে দগ্ধ
হয়ে মানুষ যখন নিজে নিজেকে সম্মান করতে পারে তখনই সম্মান লাভের যোগ্যতা অর্জন করে।
যোগ্যতা অর্জন করলে আল্লাহর রহমত প্রাপ্ত হয়। সিয়াম মানুষের মধ্যে ন্যায়-অন্যায় বোধ
জাগ্রত করে। সিয়াম সাধনার নগদ প্রাপ্তি হচ্ছে, ন্যায় অন্যায়ের পার্থক্যকারী জ্ঞান প্রাপ্তি
তথা ‘ফুরকান’ লাভ।
আল্লাহ্ বলছেন
- ‘আমি যেহেতু আমার দাসের ডাকে সাড়া দেই সেহেতু তাদেরও উচিত আমার ডাকে সাড়া দেয়া’,
অর্থাৎ সিয়াম পালন করা। ‘ফাআননি কারিবুন’ - ‘আমি আছি অতি নিকটে’ (সুরা বাকারাঃ ১৮৬)।
এ নিকটবর্তী আল্লাহ্কে দেখাই সিয়ামের একমাত্র লক্ষ্য। মানবজীবনের আর কোন লক্ষ্য নেই।
যারা সিয়াম পরিপূর্ণভাবে পালন করবে তারা অতি নিকটে অবস্থিত আল্লাহকে দেখতে পাবে। মানুষ
তার অতি নিকটে অবস্থিত আল্লাহকে দেখতে পায় না কারণ তার দৃষ্টি দিন-দুনিয়ার মোহে আচ্ছন্ন।
দ্বিনের আকাঙ্খা হচ্ছে - পরকালে বেহেশত লাভের আকাঙ্খা আর দুনিয়ার আকাঙ্খাগুলো হচ্ছে
- সম্পত্তি, সঞ্চয় বৃদ্ধি, যশ-প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা লাভের আকাঙ্খা। এই উভয় প্রকার আকাঙ্খা
নিকটবর্তী আল্লাহকে দেখতে পর্দার সৃষ্টি করে। দোজখের ভয় এবং বেহেস্তের লোভ থাকলে দোজখ
বা বেহেস্ত লাভ হতে পারে কিন্তু আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ হয় না। সায়েমের সকল আশা-আকাঙ্খা,
সকল চিন্তা ও কর্ম যখন তাঁর অন্তঃস্থিত আল্লাহ্ কেন্দ্রিক হয় তখনই সে তাঁর আল্লাহ্কে
দেখতে পায় এবং সিয়াম সার্থক হয়। সাধারণ মানুষ রোজা রাখে, রোজা ভাঙ্গে। কিন্তু তিনিই
প্রকৃত সায়েম যিনি তাঁর আল্লাহ্কে না দেখা পর্যন্ত সিয়াম ভাঙ্গেন না। এঁদের কাছে সিয়াম
এক মাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।
দিন-দুনিয়ার
মোহ থাকলে আল্লাহর দাসত্ব করা হয় না। দাসত্ব
করা হয় প্রবৃত্তির। সিয়াম প্রবৃত্তির ওপর আল্লাহ্কে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যম।
সিয়ামের মাধ্যমে প্রবৃত্তির উপর আল্লাহর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলে নিজের মধ্যে সুপ্ত
আল্লাহ্ প্রকাশিত হন। এ জন্যই রসুল (সা.) বলেছেন যে, সিয়াম হচ্ছে ‘ঢাল স্বরূপ’। ঢাল
যুদ্ধ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত এমন একটা উপাদান যা শত্রুর আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করে। মানুষের
মূল শত্রু তার নফস্। নফসের উপর ‘আমি’ রূপ রুহের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই সিয়াম।
কথিত আছে - মহান আল্লাহ্ তায়ালা নিজ থেকে তাঁর নফসকে পৃথক করে প্রশ্ন করলেন - আমি কে?
আর তুমি কে? নফস্ উত্তর দিল, তুমি - তুমি আর আমি - আমি। নফসের এ উত্তর শুনে আল্লাহ্
তায়ালা অসন্তুষ্ট হলেন এবং দীর্ঘদিন তাকে দহন করে পুনরায় প্রশ্ন করলেন, আমি কে? আর
তুমি কে? নফস এবারও একই উত্তর দিল। এবার অসন্তুষ্ট হয়ে তিনি নফসকে দীর্ঘকাল বরফ চাপা
দিয়ে রাখলেন। অতপর আবার একই প্রশ্ন করলেন। এবারও নফস একইভাবে উত্তর দিল - তুমি-তুমি
আর আমি-আমি। এবার অসন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর নফসকে অনাহারে রাখলেন। অনাহারে
থাকতে থাকতে নফস দুর্বল হয়ে পড়ল। এবার আল্লাহ্ তায়ালা নফসকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কে?
আর তুমি কে? এবার নফস্ বশ্যতা স্বীকার করে বিনীতভাবে জবাব দিল -‘তুমি আমার প্রভু এবং আমি তোমার দাস।’ কথনটি রূপক,
এর মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয়টি হচ্ছে উপবাসের ফলে নফসের স্বেচ্ছাচারীতা দূর হয় এবং নফস্
‘আমি’র বশ্যতা স্বীকার করে। নফসকে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করার একটি কার্যকর পদ্ধতি
হচ্ছে উপবাস। নফস্ অর্থাৎ কামনা-বাসনা, আবেগ-উচ্ছ্বাস, কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-মদ-মাৎসর্য
প্রভৃতি এমন কতগুলো প্রবৃত্তি রয়েছে যার তাড়নায় মানুষ তার ‘আমি’ সত্তার বিরোধী কাজে
লিপ্ত হয়। সিয়ামের উদ্দেশ্য হচ্ছে এ সব প্রবৃত্তিকে ‘আমি’র নিয়ন্ত্রণে আনা। প্রবৃত্তির
উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলে ব্যক্তি আল্লাহর ‘আমি’তে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং আল্লাহর কাছে
মর্যাদার আসন লাভ করে। আল্লাহ্ বলেন, ‘আমার নৈকট্য অন্বেষণকারীদের মধ্যে সংযমী ব্যক্তির
সমান নৈকট্য লাভ করা আর কারো দ্বারাই সম্ভব হয় নাই।’
পারিবারিক জীবনে,
সংযম পালনের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক হবে পোষাকের মতো। আল্লাহ্ বলছেন -‘তারা তোমাদের পোষাক এবং তোমরা তাদের পোষাক’ (সুরা
বাকারাঃ ১৮৭)। এখানে ‘পোষাক’ শব্দটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। পোষাক ব্যবহারের যেসব
তাৎপর্য রয়েছে সিয়ামের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কে সেই তাৎপর্য প্রতিষ্ঠার
নির্দেশনা রয়েছে এ আয়াতে। লজ্জা নিবারণ, শীত ও তাপ থেকে রক্ষা, সৌন্দর্য বৃদ্ধি মূলত
এ তিনটি কারণে মানুষ পোষাক পরিধান করে। সিয়ামের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক
সম্পর্ক যেন পোষাক তুল্য হয়। অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী যেন পরস্পরের মান-সম্মান ও ইজ্জত
রক্ষা করে, বাইরের আঘাত থেকে পরস্পরকে রক্ষা করে এবং একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায়
সম্পর্কের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। কামনা থেকে প্রবৃত্তি এবং চিন্তাকে মুক্ত রাখা সিয়ামের
অন্যতম উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্য অর্জিত হয় পারস্পরিক সম্পর্ক পোষাকের মতে হলে। কামনাকে
বিনাশ করা নয়, একে মানবীয় মর্যাদায় উন্নীত করা সিয়ামের লক্ষ্য।
কুরআন বলছে
- ‘ওয়া আনতুম আকিফুনা মাসাজিদি’ অর্থ - তোমরা যখন মসজিদে এতেকাফ-এ থাক’। সিয়ামের ফল
পেতে হলে এতেকাফের গুরুত্ব অপরিসীম। এতেকাফের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, সংসার হতে বিচ্ছিন্ন
হয়ে কিছুকালের জন্য ধ্যানে থাকা, কোন জিনিসকে আঁকড়ে ধরা এবং এর উপর নিজ সত্তাকে আটকে
রাখা। নির্জনতা ও নীরবতার মধ্যে কিছুকাল একান্তভাবে আল্লাহর স্মরণে থাকার নাম এতেকাফ।
যে যে সময় দুনিয়ার সকল কাজ ও ব্যস্ততা থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে শুধু মাত্র আল্লাহর স্মরণে
থাকে সে সময়ই তার জন্য এতেকাফ। এতেকাফের উদ্দেশ্য হলো সৃষ্টির সাথে সংযোগ স্থগিত রেখে
স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করা। আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক নির্ভর করে চিন্তার
একরৈখিকতার ওপর। হাজার বিষয়ে বিচ্ছিন্ন চিন্তা করলে আল্লাহর সাথে সংযোগ হয় না। মানুষের
মধ্যে চিন্তা প্রবেশ করে বাহ্যিক জগত থেকে তাই কিছুদিনের জন্য বাহ্যিক জগত থেকে নিজেকে
পৃথক করে এক চিন্তায় প্রতিষ্ঠিত থাকার প্রচেষ্টা করাই এতেকাফের উদ্দেশ্য। রসুল (সা.)
নিজেও এতেকাফ করতেন। ইন্তেকালের বছর তিনি একটানা ২০ দিন এতেকাফ করেছেন। এতেকাফ যত নির্জন
হয় এবং এতেকাফের সময় লোকজনের সাথে মেলামেশা যত কম হয় ততই উত্তম। এতেকাফে থেকে প্রত্যেককে
কদর রাতের সন্ধান করতে হয়। যে রাতে যার উপর আল্লাহর রহমত অবতীর্ণ হয় সে রাতই তার জন্য
কদরের রাত।
অন্যদিকে, ন্যায়
ভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নির্মাণের লক্ষ্যে সিয়াম অভ্যন্তরীণ তাগিদ সৃষ্টি করে।
পানাহার ত্যাগের উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজেকে অনিয়ন্ত্রিত ভোগেচ্ছা থেকে রক্ষা করা। একমাস
পানাহার থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে - যাদেরকে কখনোই খাদ্যের অভাবে ক্ষুধার্ত থাকতে হয়
না, তারাও যেন অনুভব করতে পারে ক্ষুধার যন্ত্রণা। আশা করা যায় রমজানের পরে তারা ক্ষুধার্তদের
প্রতি দয়াশীল হবে এবং ক্ষুধার্তদের খাদ্যের ব্যবস্থা করার জন্য নিজের দায়বদ্ধতা স্বীকার
করবে। বিত্তবানদের মনে বিত্তহীনদের জন্য মর্মবেদনা জাগ্রত হবে এবং বিত্তবানেরা নিজেদের
বিত্ত ন্যায়ভিত্তিক বন্টনে উৎসাহিত হবে। তাই অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান করাও সিয়ামের অন্যতম একটা উদ্দেশ্য। কুরআনের বাণী -
‘আর যে ব্যক্তির পক্ষে সিয়াম করা দুঃসাধ্য তার একজন অভাবগ্রস্তকে অন্নদান করা কর্তব্য।’
(সুরা বাকারা : ১৮৪) ও এ দিকেই ইঙ্গিত করে।
সিয়ামের অন্যতম
শর্ত হিসেবে সাবধান করে দেয়া হচ্ছে - ‘আর তোমরা একে অন্যের ধন অবৈধভাবে গ্রাস করো না।
আর মানুষের ধনসম্পদের কিছু অংশ জেনে-শুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশে বিচারকদের
ঘুষ দিয়ো না’ (সুরা বাকারাঃ ১৮৮)। যে ব্যক্তি অন্যের ধন-সম্পদ অবৈধভাবে গ্রাস করে সিয়াম
করার কোন প্রয়োজন তার নেই। উপার্জন হালাল না হলে আত্মশুদ্ধির প্রচেষ্টা বৃথা। সম্পদ
বা অর্থ উপার্জনে আল্লাহর আইনে নিষিদ্ধ সকল পন্থাই অবৈধভাবে গ্রাসের অন্তর্ভুক্ত। প্রতারণা,
ঘুষ, জুয়া, মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশে গুদামজাত করা, কালোবাজারী এবং সুদসহ যাবতীয় নিষিদ্ধ
বেচাকেনা এর আওতাভুক্ত। উল্লিখিত যে কোন পন্থায় হারাম ভক্ষণে শরীরে যে রক্ত, মাংস,
শক্তি, বুদ্ধি উৎপন্ন হয় তা দিয়েই জ্বালানো হয় জাহান্নামের আগুন। হারাম থেকে বেঁচে
থাকা সিয়ামের উদ্দেশ্য নয় - পূর্বশর্ত। এ শর্ত পূরণ না করে পানাহার থেকে বিরত থাকা
আত্মপ্রতারণা।
মোহাম্মদ (সা)
বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যাচার ত্যাগ করেনি তার পানাহার ও স্ত্রী-সম্ভোগ ছেড়ে দেয়াতে
আল্লাহ্র কোন প্রয়োজন নেই’। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, সিয়াম কেবল পানাহার ও যৌনসম্ভোগ
থেকে বিরত থাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। কেবল পেটের সিয়ামই সিয়াম নয়। প্রতিটি অঙ্গের সিয়াম আছে। তাই আমাদেরকে সিয়ামের প্রকৃত
মাহাত্ম্য অনুধাবন করে সিয়াম পালনে ব্রতী হতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন