মঙ্গলবার, ৭ জুন, ২০১৬

পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন : বাঙালির বিশ্বযুদ্ধ



পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন : বাঙালির বিশ্বযুদ্ধ

সত্যদর্শী ॥ খুঁটিনাটি নানান অংক কষে বলা যায় পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন বাঙালির বিশ্বযুদ্ধ। আত্মমর্যাদা অর্জনে বিশ্বময় সুতীব্র প্রকাশ। দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্রকারীর মুখে চুনকালি মেরে দেশরত্ন শেখ হাসিনার নৈতিক দৃঢ়তার বিজয় তথা বাঙালির বিশ্বজয়। অদম্য সাহসী, দৃঢ়চেতা অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী এক দেশপ্রেমিকের অহংকার। ফলে স্বভাবতই সূত্র মিলিয়ে দেখার তাগিদ আসে। পৃথিবীতে বহু কারণে বহু যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এসব যুদ্ধের কোনো কোনোটি বিশ্বযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছে যুদ্ধের ব্যাপকতা বিবেচনায়। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে চলছে অর্থনৈতিক যুদ্ধ। বিশ্বমোড়লদের শত বাধা বিপত্তি মোকাবেলা করে বাঙালিরা যে অর্থনৈতিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে সেটি দেশের মানুষের কাছে বিশ্বযুদ্ধ বৈ আর কিছু নয়। বাংলাদেশ তার অস্তিত্বের বিকাশ ও প্রকাশের ধারাবাহিকতায় যে পথ পাড়ি দিয়েছে সেখানে ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীতে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার ও পদ্মাসেতুর মত বহুমাত্রিক মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করছে। এসব প্রত্যেকটি অধ্যায় বাঙালির এক একটি বিশ্বযুদ্ধ।
স্মরণে রাখতে হবে, পদ্মা সেতু নির্মাণের বাস্তবতা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় উন্নয়ন ষড়যন্ত্র। সেই পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ ইতোমধ্যেই ৩৪ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দাতা সংস্থার অর্থায়ন ব্যতীত। চলতি বাজেটেও পদ্মা সেতুতে অর্থায়নকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।  
পত্রিকায় কাল্পনিক বৈঠকের ছবি কিংবা কোথাকার কোন রমেশের ডায়েরির কাহিনী কীভাবে একটি দেশের এত বড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সে সব চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। বিশ্বব্যাংকের একজন কান্ট্রি ডিরেক্টর কেন কীভাবে প্রতিদিন গণমাধ্যমের সামনে একটি স্বাধীন দেশের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করার দুরভিসন্ধিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এ সবই গুরুত্বসহকারে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে।  কোন দুর্নীতি না করেও একজন মন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট আমলা পাঠার বলি হবার পরও বিশ্বব্যাংকের অপতৎপরতা কেন থামেনি সেটা গভীরভাবে ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা জাতির বৃহত্তর স্বার্থে পদক্ষেপ নেবার পরও কেন বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন থেকে বিরত থাকলো, অর্থ মন্ত্রণালয়  সেদিন বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের বিপরীতে কি কি বলেছিল আর কতটুকু করেছিল তাও মিলিয়ে দেখা জরুরি।
স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ষড়যন্ত্রের যোগসূত্র খুঁজতে সর্বত্র ঘুরেছেন বিশ্বব্যাংকের অনুসন্ধানকারী দলের সদস্যরা। তারা কি পেয়েছেন তা জানানোর প্রয়োজন পর্যন্ত বোধ করেননি। দুর্নীতি দমন কমিশন কিংবা কানাডার আদালত বিশ্বব্যাংকের কাছে আইনী প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় তথ্য সহযোগিতা চাইলেও তারা কোন জবাব দেননি। কেন দেয়নি, কেন দেবার প্রয়োজন বোধ করলেন না, কোন দায়িত্বশীলতা তারা দেখালেন এখানে? না কি কেবলই বিশেষ চাপে, বিশেষ কারণে সংঘটিত ওই নাটকের নেপথ্যের কারিগরদের নাম-ছবি প্রকাশ অযোগ্য! স্থানীয় একটি দৈনিকে পদ্মাসেতু ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত একজন ব্যক্তির ব্যাক সাইডের ছবি ছাপা হয়েছিল সেই ছবিরই বা উৎস কি ছিল? একাধিক দৈনিকে রম্য রচনা লেখা হয়েছিল সেগুলোর নেপথ্যে কি কোন উদ্দেশ্য ছিল? বাজারে প্রচলিত আছে, একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ৬৬০০টি মেইল পাঠানো হয়েছিল বিশ্বব্যংকের সদর দফতরে- সে সবও খতিয়ে দেখতে হবে। কেন নিজস্ব অর্থায়নে কিংবা প্রাইভেট পার্টনারশিপে পদ্মাসেতু সম্ভব নয় বলেছিলেন আমাদের অর্থমন্ত্রী? বিশ্বব্যাংকের মত প্রতিষ্ঠানের অল্প সুদের সুযোগ হাতছাড়া করা নেহায়েত মন্দভাগ্য এর জন্য তিনি অতিশয় হতাশ হয়ে পড়েন। যারা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণের পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছিলেন তাদের সাথে তিনি একমত পোষণ করেননি বরং চরম রুষ্ট হয়েছিলেন তাদের প্রতি। এমনকি বর্তমান যোগাযোগমন্ত্রী যখন পদ্মাসেতুর কাজ অচিরেই শুরু হবে বলে বারবার গণমাধ্যমকে জানাচ্ছিলেন তখন অর্থমন্ত্রী মহোদয় যোগাযোগমন্ত্রীর সেসব কথনকে ভাবাবেগ তাড়িত, অবাস্তব বলতেও দ্বিধা করেননি।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণে দেশরত্ন শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়িয়ে যেসব অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব বলে যুক্তি দেখিয়েছিলেন তাদের বর্তমান পজিশন কোথায় সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে। বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন কান্ট্রি ডিরেক্টর  যখন যা ইচ্ছা তাই বলছিলেন আর প্রতিদিনই বৈদ্যুতিন মাধ্যমের শিরোনাম হয়ে আসছিলেন তখন অর্থমন্ত্রণালয় তার মুখের লাগাম টেনে ধরতে কি ভুমিকা নিয়েছিলেন তা গভীর অনুসন্ধানের দাবি রাখে। তবে এটি কারো ভুলে যাবার কথা নয় মাননীয় অর্থমন্ত্রী  বিশ্বব্যাংককে চিঠি লিখেছিলেন এবং কিছুকালের জন্য বিশ্বব্যাংকের সদর অফিসে সময় কাটিয়েছেন। ওই চিঠির জবাবে বিশ্বব্যাংক কোন উত্তর দিয়েছিল কি-না তা অর্থমন্ত্রী মহোদয় আজও জানাতে পারেননি।  
পদ্মাসেতু নির্মাণ দেশের টাকায় হচ্ছে। নদী শাসন, দুই পারে জমি অধিগ্রহণ, সেতুর তীরে নয়নাভিরাম গ্রাম নির্মাণ, একটার পর একটা পাইল নির্মাণ চলছে জোর কদমে। পদ্মাসেতুতে রেল নির্মাণে সরকার টাকা বরাদ্দ রেখেছে। এসবই আজ সত্য। তবু আগুনে যার ঘর পুড়েছে সিঁদুর রাঙা মেঘ দেখে তার ভয়। বাংলার আকাশে ষড়যন্ত্রের মেঘ সব সময় দেখা দেয়। এরই মধ্যে পথ চলা বড়ই ঝুঁকিপূর্ণ, বড়ই সতর্ক থাকার আহবান জানায়। ভুলে গেলে চলবে না বাংলা প্রবাদ বাক্য - ‘সর্ষের মধ্যে ভূত আছে।’
সূত্র মিলিয়ে দেখতে হবে, ৭১-এ বিশ্বের সবচেয়ে পরাক্রমশালী দেশ ও তাদের দোসররা যারা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাদের বর্তমান অবস্থান কোথায়? পাকিস্তানের মত শক্তিশালী ঘাতকদের মোকাবেলা করে স্বাধীনতা অর্জন ছিল বাঙালির বিশ্বজয়। কি করা হয়নি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মকে বাধা দিতে? জাতিসংঘকে অপব্যবহারের জোর প্রচেষ্টা, সপ্তম নৌ বহর পাঠানো, পরবর্তীতে স্বীকৃতি না দেয়ার চরমতম বর্বরতা সবই তো করা হয়েছিল। বপন করা হয়েছিল ঘাতকবৃক্ষ।
৭৫-এর হত্যাকান্ড ছিল ৭১’র পরাজয়ের প্রথম সফল আঘাত। তারপর জেঁকে বসা ঘাতকদেরকে পরবর্তীতে মহামান্য হাইকোর্ট যাদেরকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে তাদের দুঃশাসন দেখতে হয়েছে বাঙালিকে।
দীর্ঘ তিন দশক ধরে রাজনীতির নামে, ব্যবসার নামে, সেবা সৃজনশীলতা, ঈমান-আকিদা রক্ষার নামে চরিত্র বদলের রাজনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য সম্ভাব্য সবই করা হয়েছে। দেশের পুরো কাঠামোকে বদলে ফেলার জন্য শত শত প্রতিষ্ঠান, শত শত দল-উপদল সৃষ্টি করা হয়েছে। আর্থ- সামাজিক কাঠামোর পরতে পরতে দারুণ বিন্যাস।  সেই ঘাতকদের একটি অংশের বিচার সম্পন্ন হচ্ছে সমস্ত বাধা স্বত্বেও। কারা কারা বাধা দেয়? এ বাধা কোন্ প্রেমের কোন যোগসূত্র থেকে? এসবই রাজনীতির মাঠে সচেতন প্রতিটি নাগরিকের চিন্তার খোরাক যোগাবে। দেশরত্ন শেখ হাসিনা সব বাধা অতিক্রম করে একটার পর একটা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সম্পন্ন করছেন। এটা বাঙালির আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ নয় কি?  
তিনি বাংলাদেশের একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যিনি বলিষ্ঠভাবে জাতিসংঘে বিশ্বব্যাংকের সংস্কার দাবি করেছেন। এটা শেখ হাসিনা তথা বাংলাদেশের প্রতিটি বাঙালির নৈতিক জয় এবং অর্থনৈতিক বিশ্বযুদ্ধ। আর এ যুদ্ধে বাঙালির বিজয় অবসম্ভাবী।

সময়ের সাফ কথা.... বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা



 

সময়ের সাফ কথা....
বৃষ্টির জন্যঅপেক্ষা


নজরুল ইশতিয়াক ॥ বৃষ্টি কি প্রাণী কুলের জন্য আর্শীবাদ! শুষ্ক জমিনে একফোটা বৃষ্টি প্রাণ ফেরায়। পরিত্যক্ত জমিনে বৃষ্টি আনে নব জীবনের উত্থান। জীর্ণতা উবে যায়, প্রাণে ফিরে আসে প্রাণ। বৃষ্টি বাঁচিয়ে রেখেছে সবুজ এ বিশ্বকে। আর প্রাণী জগতের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার মানুষ তার দেহে-অন্তরে-অন্তরীক্ষে বৃষ্টির মাতম অনুভব করে। দেহের নদীতে জোয়ার আসে, বৃষ্টি নামে, সেই বৃষ্টির কারণ রূপ সন্ধান মানুষের দেহ পৃথিবীকে ছান্দসিক আনন্দে নিয়ে যায়। দেখতে না পারলে আনন্দ কোথায়! অনুভব করতে না পারলে জাগরণ কোথায়! বৃষ্টিকে ধরতে না পারলে প্রাণের গভীরের প্রাণ কোথায়! প্রেম বৃষ্টি বর্ষণের অপেক্ষা তো সারাজীবনের সাধনাযজ্ঞ। ‘কবে হবে সজল বরষায়/আমি বসে আছি সেই ভাবনায়/ চাতক বাঁচে কেমনে মেঘের বরষন বিনে/ বিনে নব ঘন বারি/ খায় না চাতক অন্য বারি’।
বৃষ্টির জন্য আজীবন প্রার্থনা এই সবুজ বন-বনানী, পাখ-পাখালী, এই বিশ্বচরাচরের প্রতিটি প্রাণীর।
গানে উপমায় প্রেক্ষিত প্রেক্ষাপণে বৃষ্টির উপস্থিতি প্রধান হয়ে আসে বারবার। জানা দরকার বৃষ্টি ভাল লাগে কেন? বৃষ্টির ছন্দ আছে বলে। শীতল করে, সতেজ করে, শিহরণ তোলে, তনু মনে আনন্দ-বিরহ আনে কিছুক্ষণের জন্য। বৃষ্টির সৃষ্টি, সৃষ্টির আনন্দে ছন্দ ভাবাবেগ বয়ে নিয়ে আসে। বৃষ্টির কি বাড়াবাড়ি আছে? থাকলেও তাতে কি বিরক্তি অনাসৃষ্টি করে?
উর্দ্ধশ্বাসে ছুটে চলা মানুষেরা বৃষ্টিতে ভিজতে চায় না। বৃষ্টি ভাললাগে না বলে ভিজতে চায় না এমন মানুষের সংখ্যা কম। রোগ বালাই অসুখের ভয়ে ভিজতে পারেন না বলে কিছু মানুষের আফসোস রয়েছে বটে। শৈশবের বৃষ্টি, প্রেমিক হৃদয়ের বৃষ্টি, দম্পতি জীবনের বৃষ্টি, নরম স্বভাবের বৃষ্টি, কাব্য হৃদয়ে বৃষ্টির আবেদন কখনো ফিকে হয়ে যায় না।
আরেক কিসিমের মানুষের কাছে বৃষ্টির ছন্দ বড্ড বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। যারা ছন্দ উপলব্ধি করেন না, শুনতে পান না, সংযোগ ঘটে না, ভাসতে পারেন না, সাঁতার কাটতে জানেন না, শরীয়তের বেদাত ফতোয়ার আওয়াজ নিয়ে ঘুমাতে যান। সীল মোহর মারা হৃদয়ে বৃষ্টি কষ্ট হিসেবে আবির্ভূত হতেই পারে। বৃষ্টি কি কোন শাস্ত্র কিতাবের ধার ধারে? যত প্রার্থনা করা হোক না কেন, বৃষ্টির ছন্দ বন্ধ হলে, বৃষ্টি কয়েক বছর একটানা না হলে বিরান মরুভূমিতে পরিণত হবে যে কোন ভূমি। বৃক্ষ বাঁচবে না, ফসল ফলবে না, মারা যাবে জলজ প্রাণী ও জীব সম্প্রদায়। মরুভূমির মত রুক্ষ হয়ে উঠবে চারপাশ। শাস্ত্রকারদের সব লম্প-ঝম্প থেমে যাবে। কঠিন কঠোর জটিল মনস্তত্বের কাছে বৃষ্টি বাড়তি কোন আবেদন সৃষ্টি করে না। অনুরাগী সাধক, সৃষ্টিশীল-গতিশীল মানুষের কাছে বৃষ্টি স্রষ্টার আশীর্বাদ। বৃষ্টি অনুরাগী মানুষ বৃষ্টির অপেক্ষায় প্রহর গুনেন।
শহরে বৃষ্টি তেমন কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। উন্মাদনা বাড়ায় বৈকি তাও সাময়িক বিড়ম্বনার সুখানুভূতি। হাল আমলে বৃষ্টির আগমন নিয়ে নিরাসক্ত বক্তব্যবাজী ও সঙ্গীত আয়োজন চোখে পড়ে। তাও বৃষ্টি আসার আগে বৃষ্টি আসলে সব আয়োজন চুকে যায়। মোবাইলে বৃষ্টি ভেজা সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড করার জন্যও উঠতি তরুণদের সৌখিন বৃষ্টিতে ভেজা। এফ.এম.রেডিওতে বৃষ্টি আড্ডায় বৃষ্টি নিয়ে যেসব আলাপচারিতা হয় তা শোনার আগ্রহ বৃষ্টিপ্রেমিদের থাকার কথা নয়। নাগরিক যান্ত্রিক জীবন বছরে দু-এক পশলা বৃষ্টির প্রার্থনা করে। বেশিক্ষণের বৃষ্টি ভয়াবহ যানজট-পানিজট সৃষ্টি করে। রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের মানুষের কাছে দু’একদিনের টানা বৃষ্টি অনাহত বিড়ম্বনা বাড়ায়।
রাজধানীর আশপাশের খাল-নদী-সোয়ারেজ দখল হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির পানি আটকা পড়ে। যারা নামে বেনামে এসব দখল করেছে তাদেরই প্রতিনিধিরা দখল জলাবদ্ধতা নিয়ে সভা সমিতি সেমিনার করে।
ভূমি দখলের সাথে পাল্লা দিয়ে রাজধানীর সব খাল-নদী বহু পূর্বেই দখল হয়ে গেছে। ফলে জলাবদ্ধতা আর কোনভাবেই সমাধান করা যাচ্ছে না। অদ্ভুত সত্য হলো যেসব গণমাধ্যমের মালিকরা ভূমি ও নদী দখল দস্যু হিসাবে পরিচিত তাদের মালিকানাধীন টিভি -পত্রিকা জলাবদ্ধতা নিয়ে লিড ষ্টোরী করে। বৃষ্টির ভিডিও চিত্রের জন্য নাটক সিনেমা মিউজিক ভিডিও’র জন্য কারো কারো অপেক্ষা থাকে। কৃত্রিম বৃষ্টির অর্গানাইজ শর্ট রিয়েলিটি তৈরী করে না।
আবার বৃষ্টির পরের সূর্যালোতে ভিন্ন ইমেজ তৈরী হয়। তবু শহরে নাগরিক মন ব্যালকুনিতে হেলান দিয়ে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকে। যা পায় তাতেও যদি নষ্টালজিক প্রাপ্তি ঘটে। শিশুদের কাছে বৃষ্টি এক ভিন্ন আনন্দ নিয়ে আসে। বৃষ্টির পানি ছুয়ে দেখার জন্য চঞ্চল শিশু ব্যাকুল হয়ে উঠে। শহরে গ্রামে সবখানেই শিশু বৃষ্টির গানে নেচে উঠে। শিশুর সাথে বৃষ্টির পরিচয় কতই না অপূর্ব সংযোগ। প্রতিটি পিতা-মাতা শিক্ষকের উচিত বৃষ্টির সাথে শিশুদের পরিচয় করিয়ে দেয়া। বর্ষায় গ্রামের বাড়িতে শিশুদের নিয়ে যাওয়াকে বড্ড বাড়াবাড়ি মনে হলেও নিশ্চিত এটি হবে শহুরে নাগরিক শিশুদের জন্য মাহেন্দ্রক্ষণ।
বৃষ্টি আসে গ্রামে, অজপাড়া গায়ে, সবুজের সমারোহে-বিস্তীর্ন মাঠে। টানা দু-একদিনের বৃষ্টি, পাহাড়ী ঢল হয়ে নেমে আসা বৃষ্টির প্লাবনে শস্য ক্ষেত ডুবে যায়, এক পুকুরের পানি অন্য পুকুরে গিয়ে মেশে, পাহাড় ধ্বসে-বন্যার পানিতে ডুবে-ঘরবাড়ি চাপা পড়ে কিছু প্রাণহানী ঘটে। বৃষ্টি জনিত ক্ষতির পরিমান নিয়ে অংক কষেন দেশপ্রেমিক অর্থনীতিবিদরা। তবু একটি সহজ প্রশ্ন করা যেতেই পারে, বৃষ্টির কারণে যে পলির আস্তরণ পড়ে, মাছের বংশ বিস্তার ও বৃদ্ধি ঘটে,  সেচের জন্য বৃষ্টি যে পরিমান পানি বয়ে আনে, বিদ্যুৎ সাশ্রয় করে সেসবের অর্থনৈতিক মূল্য কত? বৃষ্টির কারণে জমির শক্তি বৃদ্ধি পায়, বৃক্ষ দ্রুত বর্ধনশীল হয় তার কি কোন অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণ করা গেছে? অতি বৃষ্টিতে যে পরিমাণ ফসলের ক্ষতি হয় তার চেয়ে কতগুণ সম্পদ কুক্ষিগত করে অর্থনীতির বারোটা বাজানো হয়েছে। টাকা পাচারের পরিমাণ কি এক মৌসুমের বৃষ্টি জনিত ক্ষতির চেয়ে বেশি?  তবু আনাড়ী প্রশ্ন জাগে বৃষ্টির প্লাবণে যে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে, মাদক ও সড়ক দুর্ঘটনা জনিত মৃত্যুর পরিমান তার কত গুন? দ্বীন প্রতিষ্ঠা খেলাফত প্রতিষ্ঠা, মার্কিন বাহিনীর সন্ত্রাস ও জঙ্গী দমনের নামে মৃত্যুর পরিসংখ্যানটা কতগুণ ব্যাপক! 
বৃষ্টি ধুয়ে মুছে সব সাফ করে দেয়, হাজারো জীবানু ধ্বংস করে, ক্ষতিকারক কীট পতঙ্গের বংশ ধ্বংস হয় আবার ভুয়া সড়ক মেরামতের ক্ষত সামনে এনে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় লুটপাটের প্রকৃত চেহারা। বর্ষায় প্রয়োজনমত বৃষ্টি হলে কত লক্ষ টন মাছ ও কি পরিমাণ ফলজ উদ্ভিদের, ফসলের বৃদ্ধি ঘটে তার পরিসংখ্যান না জানা থাকলেও অনুধাবন করা যায় এর অর্থনৈতিক মূল্য নিরূপন করেনা কেউ। অথচ অতিবৃষ্টি জনিত ক্ষতির মূল্য নিরূপণ উদগ্রীব হয়ে হিসেব  হয়। বৃষ্টি কোনকালেই কোন জনপদে ক্ষতির কারণ হয়নি বরং বৃষ্টির স্বল্পতা বিরান করেছে জনপদকে। বৃষ্টি স্রষ্টার অপূর্ব লীলা নিকেতন ছন্দময় আর্শীবাদ। প্রকৃতির এই পবিত্র দানের মর্মার্থ অনুধাবন না করে আল্লাহ্র আইন ও ইসলামের হেফাজতের নামে বিভৎস বর্বরতা, রুক্ষতা, ক্ষুদ্রতা কতই না বেমামান? মানুষের সব সমস্যা ক্ষুদ্রতার কারণ কি প্রকৃতি বিমুখতা নয়? উগ্রপন্থি এসব ধর্মজীবীরা কোন কালেই প্রকৃতির একটি দানের অন্তর্নিহিত সত্য অনুধাবনে সক্ষম হয়নি। এরাই সুরা আর রাহমানের ভাষায় অবদান অস্বীকারকারী। বৃষ্টি জমিনের প্রাণকে জাগিয়ে তোলে। ধরনীকে কোমল, মোহনীয়, সৌন্দর্যময় করে। 
কালিদাস, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, হাল আমলের শামসুর রাহমানের চিন্তা-চেতনে বৃষ্টি যেসব অনাহত সৃষ্টি করেছে তা পাঠক মাত্রই জানে। কিন্তু নবী মোহাম্মদ, যীশু, গৌতম বুদ্ধ, কৃঞ্চ’র কাছে বৃষ্টি কেমন ছিল ?
বৃষ্টির পানিতে মাছের বাধভাঙা আনন্দ, কি যে আনন্দ মাছের স্বভাব না হলে কি অনুভব করা যায় ? মাছ কেন বৃষ্টির ছন্দে দারুন আনন্দে মৎস শিকারীর ফাঁদে পা দেয় সেটা আবিস্কার করা জরুরী। গৃহিণীর কড়াইয়ে মাছের দোপেয়াজী বর্ষার বৃষ্টির দিনেও দারুন স্বস্তি বয়ে আনে। বৃষ্টির খিচুড়ি অন্য দিনের খিচুড়ির মত নয়।
ঘরের চালার ফুটো দিয়ে ঘরে ঢুকে ঘুমানোর - ঘোরাফেরার, রান্নাকরার স্থান ভিজিয়ে দেয় বলে অতি বৃষ্টি সাময়িক বিড়ম্বনা বাড়ায়। বেশিক্ষণের  ভারি বৃষ্টি খেটে খাওয়া দিনমজুরের খাদ্য আহরন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে বলে তারা সাময়িক দুচিন্তায় পড়েন। ঘরে চাল-ডাল না থাকলে, শুকনো কাঠ খড়ি ভিজে গেলে রান্নার কষ্ট ষ্পষ্ট হয়ে উঠে। জীবনটা যে ভাঙ্গা গড়া তাও বোঝে নদী তীরের  মানুষজন বৃষ্টি যখন প্লাবন হয়ে উঠে। মানুষ যে শরনার্থী তা অতি প্লাবনে নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের মানুষেরা টের পায়।
বর্ষায় গাছের সবুজ পাতা একেক রকম রূপ নেয়। সবুজ কিন্তু অনেক রকম সবুজ। লাল টুকটকে ফুল, পাতাবাহার, কদম, কেয়া, গোলাপ তবু অন্য সময়ের চেয়ে একটু পরিনত, সতেজ। গাছপাতারা বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে প্রকৃতিতে যে আভা ছড়িয়ে দেয় তা সব জীর্নতাকে, ধুলোমলিনতা ও সব বার্ধক্যকে হার মানায়। বৃক্ষরা পূর্ণ মায়াবী নান্দনিক যৌবনা হয়ে উঠে। বর্ষার বৃষ্টি বৃক্ষের বসন্ত যৌবন। যৌবনের সৌন্দর্য মেলে ধরে বৃক্ষরা। বৃক্ষের শাখায়, কোটরে বৃষ্টিভেজা পাখির অনুরাগী চাহনী কি বলে, কি বলতে চায় তা জানা হয়নি আজও। ঘন বৃষ্টিতে পাখিদের মন কোন ব্যাকুলতায় উড়ু উড়ু করে, কোন বিরহ আর্তনাদ সুর তোলে? পাখিদের পৃথিবী কি বৃষ্টিস্নাত, ভরা বর্ষায় প্রকৃতির সুর ছন্দে দারুন নিরুদ্বেগ হয়ে উঠে? দারুন এক ঐক্যতানের সুর অনুভব করে পাখিরা। 
রঙিন প্রজাপতি গাছের পাতায় পাতায় আটোসাটো হয়ে মিশে যায়, হারিয়ে যায়, অবিচ্ছেদ্য সংযোগে নিজের অস্তিত্বকে বিলীন করে দেয়। প্রেমিক-শাস্ত্রীয় সঙ্গীত অনুরাগীর কাছে বৃষ্টির দিনে রাগ মেঘ মাল্লার দারুন আবহাওয়া তৈরী করে। তনুমনে এক দারুন অনুরনন তোলে। বৃষ্টির ছন্দ রাগ হয়ে অপরূপ রূপ নেয়। রাগ হয়ে যায় রূপ। প্রকৃতির ভিতরে লুকানো সব হাহাকার-আর্তনাদ মানবিক সৌন্দর্যে এসে আশ্রয় নেয়। বিরহ যে সব যাত্রার প্রাণ শক্তি তাও বলে যায় বর্ষার প্রকৃতি। 
প্রকৃতির অনবদ্য সৃষ্টি বৃষ্টি মৃদুমন্দ পায়ে এসে কোন সে অজান দূরে নিয়ে যায়! দূরের মাঠে, ঘন পল্লবিত বাগানে, মেঠো রাস্তায়, কর্মক্লান্তিতে বৃষ্টি বুনন ছন্দ গেথে দেয়। প্রেয়সীর জন্য ব্যকুলতা চরমে পৌঁছায়। নদীমাতৃক, উর্বর মাটির বাংলায় নদী ও বৃষ্টি একই সুরের যুগলবন্ধি। এই মহাযাত্রায় বৃষ্টির ছন্দ অনুভূতি-অনুভবের হৃদয়ে পরম আনন্দের বার্তা বয়ে নিয়ে আসে, কর্কশ কঠিন জটিল মনস্তত্বের বিরুদ্ধে বৃষ্টির এই নান্দনিক বার্তা বলে উঠে-এই বিশাল প্রকৃতিতে বৃষ্টির ছন্দের মত ছন্দশীল হও, সহজ হও, সবার হও, সমগ্র সৃষ্টির বন্দনা করো, মানবিক হও, প্রেমময় হও, সতেজ হও। বৃষ্টি বলে তোমাদের বাহাদুরি জমিনে মসজিদে মন্দিরে যতই করো এই বিচ্ছিন্নতা থেকে বের হয়ে সবার হয়ে উঠো। প্রকৃতির সুরে সুর মেলাও, সব মানুষের অন্তরকে প্রশস্ত করো মানবিক প্রেম দিয়ে, প্রেম প্রাচুর্যতা দিয়ে। কল্যানব্রতী হয়ে উঠো, জমিনের সব সৌন্দর্যকে জাগিয়ে তোলো ছন্দ সুরে। বিভাজন বিভেদ নয়, ঐক্যতানের মালা গাথো। জমিনকে প্রাণ, নদীকে যৌবন-স্রোত-প্রবাহ, বদ্ধ ডোবা-পুকুর-খাল-বিল-বৃক্ষ-লতাপাতায় সঞ্জীবনী রূপ সবই বয়ে আনে বৃষ্টি।‘কবে হবে সজল বরষা/ আমি চেয়ে আছি সেই ভরসায়/ আমার এই আধলা দশা, মিটবে কত দিন পরে’- লালন সাঁইজীর এই বাণীর বৃষ্টিই সত্য অনুসন্ধানী মানুষের কাছে বৃষ্টির  জন্য প্রকৃত অপেক্ষা।

যে সৃজনশীলতায় সত্য নেই

যে সৃজনশীলতায়সত্য নেই

শাহ্ শাহনাজ সুলতানা ॥ ২০০৯ সালে কোমলমতি প্রাথমিক পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মেধা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, শিক্ষার মান না ভেবে এবং কোন ধরণের গবেষণা ছাড়াই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছিলো বাংলাদেশ সরকার। সে সময়ের একজন ভুক্তভোগী অভিভাবক হিসাবে খুব কাছে থেকে দেখেছিলাম এক শিক্ষাথীর্র অসহায় অবস্থা! বছরের প্রথম তিন মাস শিক্ষার্থীরা জানতেই পারেনি তাদের প্রশ্ন পদ্ধতি কেমন হবে? বিশেষ করে গণিত এবং ইংরেজী বিষয়। এরপরে ছিলো গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার জ্বালা আর তা হলো প্রশ্নপত্র ফাঁস। মেয়ে প্রশ্ন করেছিলো - এত পরিশ্রম করলাম, কি লাভ হলো? এই প্রশ্নের কোন যুৎসই উত্তর দিতে পারিনি সেদিন। শুধু এতটুকুই বলেছিলাম - বই পড়লে বিফলে যায় না।
সম্প্রতি একটি বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলে এক সাংবাদিকের কিছু মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সাথে সাক্ষাৎকার মূলক প্রতিবেদন নিয়ে সামাজিক গণমাধ্যমে চলছে তোলপাড়। ফেসবুকে তা হয়েছে ভাইরাল। শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করা হয়েছিলো কিন্তু উত্তর তারা দিতে পারেনি। তাদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল পীথাগোরাস কে? শিক্ষার্থীরা জবাবে বলেছিল তিনি একজন ঔপন্যাসিক। তাদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির নাম, রাজধানীর নাম কিন্তু তারা তা বলতে পারেনি। তাদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা কে? তাদের একজন জবাবে বলেছে - কাজী নজরুল ইসলাম। বাকিরা কেউ জবাব দিতে পারেনি। জিপিএ ফাইভ পাওয়া একজন ছাত্রীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো -‘আমি জিপিএ ৫ পেয়েছি এর ইংরেজী অনুবাদ কি’? উত্তরে বলেছে - ‘আই এম ফাইভ’। জানতে চাওয়া হয়েছিলো- ‘আমাদের রণসঙ্গীত কোনটি? তারা জানেনা বলে জবাব দিয়েছে।
কে লিখেছেন রণসঙ্গীত? তাও তারা জানেনা। বিজ্ঞানের ছাত্রের নিকট নিউটনের সূত্র জানতে চাওয়া হয়েছিলো-উত্তর জানেনা। এ নিয়ে চলছে পাল্টা মতামত দেয়ার প্রতিযোগিতা। একপক্ষ বলছে - সাংবাদিক সাহেব যা করেছে ঠিক করেছে। আরেক পক্ষ বলেছে - এভাবে গণমাধ্যমে ছেলেমেয়েদের ছবি দেখানো ঠিক হয়নি; এতে তাদের মনোজাগতিক সমস্যা হতে পারে! 
গল্পটা এখানেই শুরু। বছর কয়েক আগে প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ রচিত ও পরিচালিত একটি নাটক দেখেছিলাম। গ্রামের সহজ-সরল স্কুল পাস দেয়া এক ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেয়া হবে। কি কি প্রশ্ন করা হবে তা আগে থেকেই শিখিয়ে পড়িয়ে দেয়া হলো। সবকিছু প্রস্তুত। লাইট  ক্যামেরা  অ্যাকশান বলতেই দেখা গেল লোকটির মুখ দিয়ে কোন আওয়াজই বের হচ্ছে না। উনি বোবা হয়ে গেছেন। দ্বিতীয় দফা জিজ্ঞেস করা হলো - আপনি কি ভয় পাচ্ছেন? লোকটি দৃঢ়তার সাথে বললো - এতে ভয় পাওয়ার কি আছে? এইটা তো কোন ব্যাপারই না। আবার লাইট ক্যামেরা অ্যাকশান। আগের মতই ফ্যালফ্যাল করে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছেন উনি। লা জবাব। এই হলো ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার যোগ্যতা ও সাহস! অনেক গুছানো কথা অগুছালো হয় বা হয়ে যায়! মাত্র ১২ থেকে ১৩ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে যে সচিত্র প্রতিবেদন সাংবাদিক দেখিয়েছেন তাতে ক্ষতি ছাড়া কোন লাভ দেখছি না।
পত্রিকায় প্রকাশিত সূত্র মোতাবেক চলতি বছরে ১৪ লাখ ৫২ হাজার ছাত্রছাত্রী মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। এদের মধ্যে ৭ লাখ ১১ হাজার মেয়ে। ১২ বছরের শিক্ষাজীবনে একজন শিক্ষার্থীকে মোট ৪ টি পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়। যা একমাত্র বাংলাদেশে চালু আছে। পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলে (আগে বলা হতো ফল) ছেলে-মেয়েদের ভি চিহ্ন দেখানো, ঢোল পেটানো সবই দেখি। কিন্তু কোথায় যেন একটা গড়মিল থেকে যাচ্ছে। বরেণ্য শিক্ষাবিদ ড. জাফর ইকবাল গত ২৬ মে সিরডাপ মিলনায়তনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে ‘মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বলেন - ‘নবম শ্রেণীর বিজ্ঞান বই আমিই বুঝিনা, ছাত্ররা বুঝবে কি করে? (সূত্রঃ বাংলা মেইল ২৪.কম, ৩ জুন ২০১৬)। মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, ড. ফরাস উদ্দিন, অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ, সুলতানা কামাল, রাশেদা কে চৌধুরী প্রমুখ। ড. জাফর ইকবাল আরো বলেছেন, ‘এমসিকিউ তুলে দেয়া উচিত! এর কোন প্রয়োজনীয়তা নেই!’ দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত এই মতবিনিময় সভা থেকে জাতি কি কিছু পাবে? নাকি বিনিময় পর্যন্তই সার!
সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছিলো বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটি বিশেষ কমিটি মাধ্যমে। কিন্তু এর বর্তমান পরিস্থিতি কি তা জানা দরকার এবং এর গভীরে যাওয়া দরকার। খোদ রাজধানী কিংবা বিভাগীয় পর্যায়ের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলো হাতে গুণে লাভ নেই। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকিয়ে প্রকৃত সত্য বের করে নিয়ে আসা দরকার এখনই। শিক্ষার্থীরা বইমূখী হবে এই চিন্তা করেই সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছিলো। শিক্ষার্থীরা মুখস্ত বিদ্যা নির্ভর হবেনা। চিন্তা করার একটা ক্ষেত্র তৈরি করার জন্যই এ পদ্ধতি চালু করা হয়েছিলো। অথচ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরাই আজ বলছেন - সৃজনশীল পদ্ধতি শিক্ষকরাই বুঝে না। প্রশ্ন থেকেই যায় - কেন এ পদ্ধতির ভালো-মন্দ দিক শিক্ষকদের মগজের মধ্যে না ঢুকিয়ে চালু করা হলো ?
শিক্ষা বিষয়ক মনোবিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ব্লুম ১৯৫৬ সালে একটি হাতবই বের করেন। এতে তিনি নিম্নতর চিন্তার স্তরকে ৩ ভাগে ভাগ করেন। জ্ঞান, অনুধাবন, ও প্রয়োগ। উচ্চতর চিন্তার স্তরকে ৩ ভাগে ভাগ করেন। বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ ও মূল্যায়ণ। ২০০১ সালে ব্লুমের ছাত্র লরিন এন্ডারসনের নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। তারা চিন্তার স্তর গুলো ঢেলে সাজান এবং নামবাচক শব্দের পরিবর্তে ক্রিয়াবাচক শব্দ প্রয়োগ করেন। যেমন: জ্ঞান - মনে করা বা স্মরণ করা; অনুধাবন - বুঝতে পারা; প্রয়োগ - প্রয়োগ করা; বিশ্লেষণ - বিশ্লেষণ করা; সংশ্লেষণ - মূল্যায়ণ করা; মূল্যায়ণ - সৃষ্টি করা।
সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাঠ্য বই থেকে একটি অনুচ্ছেদের সাথে মিল রেখে বাইরের কোন বই থেকে, গল্প কিংবা কবিতা থেকে অংশবিশেষ নিয়ে তৈরী করা হয় উদ্দীপক। উদ্দীপক অনুসারে জ্ঞান, অনুধাবন, এবং প্রয়োগ এই তিন স্তরের উপর ভিত্তি করে প্রশ্ন সাজানো হয়। যার জন্য দরকার অনুশীলন। আগের মতো ৫ বছরের বোর্ড প্রশ্ন ঘাটলেই বড় প্রশ্ন, ছোট প্রশ্ন বা ব্যাখ্যা কমন পড়বে - সে দিন আর নেই। পাঠ্য বইয়ে আছে জীবনানন্দ দাশের কবিতা -
‘আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে এই বাংলায়,
হয়তো মানুষ নয় - হয়তোবা শঙ্খচিল শালিকের বেশে
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়’।
উদ্দীপক :
‘গাঁয়ের ধারে বিলের পারে পদ্মভরা জলে
শাপলা শালুক কলমি কমল সবুজ থরে ফলে
সেথায় চরে হাজার পাখি নিতুই দিবস ভর,
সাঁঝের মায়ায় কল্পপুরীর নামে তেপান্তর।”
প্রশ্ন থাকছে এরকম : জীবনানন্দ দাশের আবার আসিব ফিরে এবং উদ্দীপকের সাথে কি সাদৃশ্য আছে - বিশ্লেষণ কর।
এখানে এসে ছাত্ররা খেই হারিয়ে ফেলছে। কারণ অনুধাবন মানে বুঝতে পারা। শিক্ষার্থীকে পাঠ্যবই পড়তে হবে। বুঝতে হবে এবং সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে কী ঘটছে? কোচিং ও গাইড বই নির্ভর জীবনকে কেন্দ্র চলছে তাদের শিক্ষাজীবন। এককথায় সবকিছু অচল। সৃজনশীল তৈরি করছে গাইড প্রণেতারা, বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নয়। আর করলেও তাদের  কাছে প্রাইভেট যারা পড়ে তারা অতি সামান্য হলেও সুবিধা পায়। বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে পড়ার জন্য সরাসরি বলা হয় আজকাল। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা ও জেএসসি পরীক্ষার সময় অধিকাংশ বিদ্যালয়ে কোচিং করা করানো হয়। এর জন্য আলাদা ফি দিতে হয় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। কোচিং ঠিকঠাকমত হলে অভিভাবকগণ বাইরের কোচিং সেন্টারে সন্তানকে দিতেন না। এটাও পর্যাপ্ত না। এরপর চলে বাসায় আলাদা করে শিক্ষক রেখে বিষয়ভিত্তিক পড়ার সমস্যাগুলো দূর করা। এটা কি সব ছাত্রছাত্রীর জন্য সম্ভব? মডেল টেস্ট এর নামে চলে অর্থ কামানোর মহোৎসব। এই মহোৎসবে যোগদান না করলে নিবিত্তের একটা মেধাবী মেয়ে কিংবা ছেলে কখনোই ভালো রেজাল্ট করার আশা করতে পারে না। কারণ: প্রশ্ন পদ্ধতির ধরণ। শুধুমাত্র রাজনৈতিক কুটকৌশলের কারণে (চিন্তার একমুখীতা যেখানে নেই) শিক্ষারমান কোথায় যেতে পারে তার ছোট্ট একটা নমুনা বেসরকারী টেলিভিশনের ওই সাংবাদিক সাহেব (!) দেখিয়ে দিলেন। সরকারী অনুদানপ্রাপ্ত  প্রত্যেক বিদ্যালয়ের কমিটিতে থাকেন সম্মানিত সংসদ সদস্যগণ। তাদের মধ্যে অনেকের কার্যকলাপ কত সুন্দর তা প্রতিদিনের সংবাদ পাঠ করলে জানা যায়। এমন সোনার মানুষ পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার যিনি রাজনীতির সাথে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ট্রাম্প কার্ড হিসাবে নেন না।
সুতরাং যারা দেশের রাষ্ট্রপতির নাম জানেনা বা বলতে পারেনি তাদের দোষ দেয়া যায় না। সেই পরিবেশ দিতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। যে পরিবেশে তারা শুধু একজন পরীক্ষার্থী হবে না, তারা হবে সত্যিকারের একজন শিক্ষার্থী। বানিজ্যিকীকরণের খাতায় নাম লিখিয়েছে - জিপিএ ফাইভ। জিপিএ ফাইভের সংখ্যা যত বেশী সে বিদ্যালয়ের সুনাম তত বেশী। ছাত্ররা বই পড়–ক বা না পড়ুক। বিদ্যালয়ের পাশে আরেকটি প্রতিষ্ঠান - বিদ্যালয়ের ছায়া বেনামে। সেই ছায়া বিদ্যালয়ে চলছে রমরমা শিক্ষা ব্যবসা। তার নাম কোচিং সেন্টার (কোথাও এই শব্দের বাংলা ব্যবহার দেখা যায় না)। সরকারের সেবামূলক কাজে রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের পদটি কোচিং সেন্টারের মালিকদের দেয়া দরকার। কারণ তারা সেবা দিচ্ছে। কি সেবা যে তারা দিচ্ছে তা একমাত্র জানেন অর্থ প্রদানকারী অভিভাবকরা। 
আমরা নিরাশাবাদী নই। আমরা চাইনা আমাদের ছেলেমেয়েরা বিবেকহীন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হোক। তারা মানুষের মতো মানুষ হোক। তাদের মধ্যে জানার প্রতি আগ্রহ তৈরীর কাজটি করবে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা। বলার অবকাশ নেই এতে মা বাবার ভূমিকা মুখ্য। যে মা সারা দিন জি সিনেমা বা  স্টার জলসার সিরিয়ালের মধ্যে ডুবে থাকে তার ছেলে মেয়েরা রাষ্ট্রপতির নাম বলতে  না পারলে অসুবিধা নেই। কারণ যারা এই সিরিয়াল নামের নেশার মধ্যে থাকে, তাদের কাছে বাংলাদেশের রাজধানী নেপাল বা ঢাকা  দুটোর মধ্যে একটা হলেই তো হয়! নেশা বলে কথা!
মূল্যায়ণ মানে বিচার করার ক্ষমতা এবং এটা অর্জন করতে হয়। যে অর্জন নতুন কিছু সৃষ্টি করার সহায়ক শক্তি হয়। মূল্যায়ণ করি কাকে? আমাকে মানে অভিভাবককে? বিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাকে? শিক্ষকের ভুমিকাকে? রাজনীতির কুটচালকে? নাকি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের উর্বর মস্তিষ্কের নিষ্ফলা চিন্তাকে যেখানে নেই কোন গবেষণা?
আমরা সবসময় আশার বাণী পাই। সাধক নজরুল ইসলাম যেভাবে বলেছেন -
‘আবার কি আঁধি এসেছে, হানিতে
ফুলবনে লাঞ্ছনা?
দু’হাত ভরিয়া ছিটাইছে পথে
মলিন আবর্জনা।
করিওনা ভয়, হবে হবে লয়
আপনি এ উৎপাত।’

সিয়াম সাধনায় কুরআনের উপদেশ

সিয়াম সাধনায় কুরআনের উপদেশ

সংলাপ ॥ ‘হে আমানুগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে দেয়া হয়েছিল, সম্ভবত (এ দ্বারা) তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারবে।’ (সুরা বাকারাঃ ১৮৩)।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সিয়ামের বিধান দিয়েছেন আমানুদের জন্য। তাই এ আয়াতে সম্বোধন করা হয়েছে ‘ইয়া আইয়্যু হাল্লাযীনা আমানু - হে আমানুগণ!’ তাই প্রথমেই জানা দরকার আমানু কারা। কুরআন মতে জন্মগতভাবে কেউ আমানু হয় না। আমানুর ঔরসে আমানু জন্মের কোন প্রাকৃতিক ব্যবস্থা নেই। মানুষ তখনই আমানু হয় যখন গুরুর আনুগত্য গ্রহণ করে কুরআনের বিধানকে নিজ জীবনে রূপায়িত করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় এবং গুরুর প্রদর্শিত পথে কর্মে নিয়োজিত হয়। খাজা মঈন উদ্দিন হাসান চিশতি বলেন - ‘যে ব্যক্তির শায়েখ, মুর্শিদ বা পথ প্রদর্শক নেই তার দ্বীন নেই। যার দ্বীন নেই তার মারেফাতে এলাহি নেই। যার মারেফাতে এলাহি নেই সত্যপথের পথিকদের সাথে তার সম্পর্ক নেই। সত্যপথের পথিকদের সাথে যার সম্পর্ক নেই তার কোন শুভাকাঙ্খী নেই। যার শুভাকাঙ্খী নেই তার কোন বন্ধু বা মুর্শিদ নেই।’ যার মুর্শিদ নেই তার সিয়ামও নেই। সিয়ামের বিধান দেয়া হয়েছে আমানুদের জন্য, যে এখনও আমানু হয় নাই অর্থাৎ যার মুর্শিদ নেই সে প্রকৃত অর্থে সিয়াম করতে পারে না।
এরপর কুরআন বলছে - ‘কামা কুতিবা আলাল্লাযীনা মিন কাবলিকুম’ - যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে দেয়া হয়েছিল - এ অংশ থেকে বুঝা যায়, সালাতের মতো সিয়ামও কোন নব বিধান নয় যা কেবল মোহাম্মদ (সা.) -এঁর অনুসারীদের জন্য অবশ্য পালনীয়। কুরআনের মাধ্যমে সিয়াম অবশ্য পালনীয় হিসেবে নির্দেশ এসেছে দ্বিতীয় হিজরি সনে কিন্তু এর আগেও সিয়াম ছিল। হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে মোহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত যত নবী-রসুলগণ আবির্ভূত হয়েছেন প্রত্যেকেই সিয়াম ধারণ-লালন-পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। হিন্দু, খৃষ্টান, ইহুদি, বৌদ্ধ, প্রভৃতি সম্প্রদায়েও সিয়াম পালনের রীতি প্রচলিত ছিল, এখনও আছে। বেদ অনুসারীগণ সংযম ব্রত পালন করেন। প্রত্যেক হিন্দী মাসের ১১ তারিখে ‘একাদশীর’ সংযম পালনের রীতি রয়েছে। কার্তিক মাসের প্রতি সোমবারেও সংযম পালনের রীতি প্রচলিত আছে। বেদ অনুসারী সাধকগণ ৪০দিন পানাহার ত্যাগ করে ‘চল্লিশে ব্রত’ পালন করেন।
নূহ (আ.) ১লা শাওয়াল ও ১০ জিলহজ ছাড়া সারা বছর সিয়াম করতেন। ইব্রাহীম (আ.) এবং তাঁর ভক্তগণ বৎসরে এক মাস সিয়াম পালন করতেন। তওরাতে আছে, মূসা (আ.) তূর পাহাড়ে ৪০ দিন পানাহার না করে কাটিয়েছিলেন। তাই মূসা (আ.) -এঁর অনুসরণে ইহুদীরা ৪০দিন সিয়াম রাখা উত্তম মনে করেন। এছাড়াও ইহুদী ধর্মশাস্ত্রে অন্যান্য সিয়ামের স্পষ্ট হুকুম রয়েছে। দাউদ (আ.) এর যুগেও সিয়াম ছিল। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার নিকট সবচেয়ে প্রিয় ছিল দাউদ (আ.)-এঁর সিয়াম। তিনি একদিন অন্তর অন্তর সিয়াম করতেন। অর্থাৎ দাউদ (আ.) বৎসরে ৬মাস সিয়াম করতেন। কুরআনে আছে, ঈসা (আ.) - এঁর যখন জন্ম হয় তখন লোকেরা তাঁর মা মরিয়মকে তাঁর জন্ম সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আমি করুণাময়ের উদ্দেশে সিয়াম করছি। সুতরাং আজকে আমি কোন মানুষের সাথে কথা বলবো না।’ (১৯ সুরা মরিয়মঃ ২৬ আয়াত)। ঈসা (আ.) জঙ্গলে ৪০ দিন সিয়াম করেছিলেন। একদা ঈসা (আ.)-কে তাঁর অনুসারীরা জিজ্ঞেস করেন, আমরা অপবিত্র থেকে কিভাবে পবিত্র হবো? উত্তরে তিনি বলেন, প্রার্থনা এবং সিয়াম ব্যতীত অন্য কোন উপায় নেই।’
ইতিহাস থেকে জানা যায়, মোহাম্মদ (সা.) -এঁর পিতামহ আব্দুল মোত্তালেবও সিয়াম পালন করতেন। সিয়াম পালনকালে আব্দুল মোত্তালেব হেরা গুহায় আরাধনা করতেন বলেও জীবনীগ্রন্থে উল্লেখ আছে। তৎকালে মক্কার হানিফ সম্প্রদায় আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসী ছিল। হানিফগণ ৫৭০ খৃষ্টাব্দের পূর্ব থেকেই রমজান মাসে মদ্যপান, যৌনকর্ম বন্ধ রাখতেন এবং সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সিয়ামব্রত পালন করতেন এবং নির্জনবাসের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির সাধনা করতেন। কুরআনের আয়াত - ‘যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে দেয়া হয়েছিল’ - উক্ত ঐতিহাসিক তথ্যগুলোর সত্যতা প্রমাণ করে।
আয়াতের পরবর্তী অংশে বলা হয়েছে - ‘লা আল্ল্লাকুম তাত্তাকুন’, তাত্তাকুন শব্দের যেসব অর্থ পাওয়া যায় তা হলো - সংযম/সাবধান/সতর্ক থাকা, মুত্তাকীর গুণাবলী অর্জন করা, তাকওয়া অর্জন করা। কোন কোন অনুবাদক ‘তাত্তাকুন’ শব্দের অর্থ করেছেন তাকওয়া। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করাই লক্ষ্য। শুধু এক মাসের সংযমে তাকওয়া অর্জিত হয় না। আমানু থেকে মুত্তাকীর স্তরে উন্নীত হতে হলে সংযমের চর্চা হতে হবে জীবনব্যাপী। কুরআন যে সিয়াম দর্শন উপস্থাপন করেছে তাতে এক মাস উপবাসের কোন নিজস্ব মূল্য নাই। উপবাসের জন্য উপবাস নয়, তাকওয়া বা মুত্তাকীর গুণাবলী অর্জনের লক্ষ্যে উপবাস একটা পদ্ধতি মাত্র। পানাহার ও যৌনসঙ্গম থেকে বিরত থাকা কোন ইবাদত নয়, ইবাদতের বাহ্যিক রূপ বা আনুষ্ঠানিকতা।
‘তাকওয়া’ শব্দের অর্থ ব্যাপক। বাংলায় এর ব্যাপকতাকে ধারণ করতে পারে ‘সাবধানতা’ শব্দটি। আল্লাহ্কে সামনে রেখে বান্দা অতি সাবধানতার সঙ্গে তার যাবতীয় কর্ম সম্পাদন করবে। ফলে কর্মের মাধ্যমে আল্লাহর উপর ‘তাওয়াক্কুল’ বা পূর্ণ নির্ভরতা আসবে।
তাকওয়া আত্মার এমন এক শক্তি, যা ব্যক্তির আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। আত্মনিয়ন্ত্রিত ব্যক্তিই মুত্তাকী হয়। মুত্তাকী সব সময় নিজ শাসনাধীন থাকে। যে কাজ মাওলার নৈকট্য লাভে সহায়ক হবে বলে তার আত্মা অনুমোদন দেয়, কেবল সে কাজটিই সে করে। মুত্তাকী নিজেই বিধান। মুত্তাকীকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে কোন আইন-আদালত, বিধি-বিধান বা শাস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা নেই। এক শিষ্য রসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘হুজুর তাকওয়া কি?’ তিনি (সা.) নিজের বুকের দিকে ইশারা করে বলেছিলেন - ‘তাকওয়া এখানে, তাকওয়া এখানে, তাকওয়া এখানে। তাকওয়া এমন একটা শব্দ যা অনেকগুলো গুণকে ধারণ করে। সতর্কতা বা সাবধানতাও তাকওয়া। ওমর বিন খাত্তাব (রা.) উবাই বিন কা’ব -কে তাকওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। উবাই (রা.) বলেন, ‘আপনি কি কাঁটাযুক্ত পথে চলেছেন? ওমর (রা.) বলেন, ‘হাঁ’। উবাই বলেন, ‘কিভাবে চলেছেন’? ওমর বলেন, ‘গায়ে যেন কাঁটা না লাগে সে জন্য চেষ্টা করেছি ও সাবধানতার সাথে চলেছি’। উবাই বলেন, ‘এ সাবধানতাই তাকওয়া’। কুরআন একাধিকবার বলেছে ‘নিশ্চয় আল্লাহ্ সাবধানিদেরকে ভালোবাসেন’ (৩:৭৬, ৯:৭)। আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়াই সর্বোচ্চ প্রাপ্তি।
লোভ-লালসায় পূর্ণ বস্তুজগত যেন কণ্টকাকীর্ণ গিরিপথ। এ সরু গিরিপথের দু’ধারেই কাঁটা। প্রতিমুহুর্তে বাহিরের জগত থেকে লোভ-লালসা, কামনা-বাসনা অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। অন্যদিকে নিজের ভিতরেও চলতে থাকে শয়তানের কুমন্ত্রণা। ভিতরে এবং বাইরে চারিদিকে কাঁটা বিছানো পথে হাঁটতে হয় গুরুভক্ত শিষ্যকে। তাই সাবধানতার এত গুরুত্ব। সাবধান না থাকলে কেউ এ পথে হাঁটতে পারবে না। জগতের মায়ার কাঁটায় জড়িয়ে পথভ্রষ্ট হবে। নৌকা পানিতে চলে, নৌকার ভেতরে পানি ঢুকে গেলেই নৌকাডুবির আশঙ্কা থাকে। সমাজের পাপ-পঙ্কিলতা, বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণা-প্রবঞ্চনাপূর্ণ জগতে থেকে এসব হতে মুক্ত থাকতে আমানুকে সাবধানে দুনিয়াদারি করতে হয়। আমানু গুরুর আদেশে কলুষযুক্ত সমাজে থেকেও নিজে থাকেন কলুষমুক্ত। গুরুর আদেশে পথ চলেন স্রোতের বিপরীতে। তাই সাবধান না থেকে আমানুর পক্ষে সত্য পথে চলার আর কোন উপায় নেই। হুজুরে পাক (সা.) বলেছেন, ‘ক্ষুধা ও তৃষ্ণা দিয়ে তোমরা নিজের সাথে যুদ্ধ করো।’ সাবধান থাকার জন্য ক্ষুধা-তৃষ্ণার কষ্ট একটা কার্যকরী পদ্ধতি। ক্ষুধা ও তৃষ্ণা থাকলে ব্যক্তির চিন্তাজগতে একটা যুদ্ধ চলতে থাকে - সেভাবে, ‘আমি ক্ষুধা ও তৃষ্ণার কষ্ট ভোগ করছি - মিথ্যা, অকল্যাণ ও অন্যায় থেকে বেঁচে থাকার জন্য’। এই ভাবনা ভিতর থেকে বাইরে এবং বাইরে থেকে ভিতরের দিকে চাপ প্রয়োগ করে, ফলে ব্যক্তির মধ্যে সাবধানতা আসে। এভাবে যে নিজের সাথে যুদ্ধের কণ্টকাকীর্ণ পথের পথিক হয় সে প্রবৃত্তির ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ  প্রতিষ্ঠা করে। ফলে তার মধ্যে অশুভ শক্তিগুলো কার্যকারিতা হারায় এবং শুভ শক্তিগুলোর কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়, জাগ্রত হয় মনুষ্যত্ব বোধ। মনুষ্যত্ব বোধ জাগ্রত হলেই মানুষ প্রকৃত অর্থে ‘মানুষ’ হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। সুতরাং এক কথায় মনুষ্যত্বের পরিচর্যা, তাকে পল্লবিত-কুসুমিত ও সুষমামন্ডিত করা সিয়ামের উদ্দেশ্য।
উক্ত আয়াতে বলা হচ্ছে -‘সম্ভবত তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারবে’। অর্থাৎ, পানাহার থেকে বিরত থাকলেই যে তাকওয়া অর্জিত হবে তা নয়, অনেকের তা হয়ও না। অনেক লোকই আছে যারা কেবল ক্ষুধা-তৃষ্ণার কষ্ট ব্যতীত রোজা থেকে আর কিছুই পায় না। অনেকেই উপবাস করে কিন্তু কেন করে তা-ই জানে না। এমনকি রমজান মাসে উপবাস থেকেও তারা আল্লাহর আদেশ অমান্য করে - মিথ্যা বলে, ওজনে কম দেয়, পণ্যদ্রব্যে ভেজাল দেয়, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। তাই ‘সম্ভবত’ শব্দটির ব্যবহার।
সুরা বাকারার ১৮৪ থেকে ১৮৮ নং আয়াতে সিয়াম প্রসঙ্গে নির্দেশনা পাওয়া যায় যে, কেউ যদি অসুস্থ কিংবা সফরে থাকে তবে সে যেন সুস্থ হয়ে গেলে কিংবা সফর থেকে ফিরে এলে তা আদায় করে নেয়। কারণ, শারীরিক অসুস্থতা এবং সফর নিজের সাথে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। সফরের উদ্বিগ্নতা এবং শরীরের যন্ত্রনা থাকলে সেদিকে মনোযোগ আকৃষ্ট হবে ফলে ব্যক্তি তার মধ্যে বাহ্যিক জগত থেকে কি প্রবেশ করছে এবং নিজের মধ্যে কি ধরনের কুমন্ত্রণার সৃষ্টি হচ্ছে এ সম্পর্কে সাবধান থাকতে পারবে না। আত্মশুদ্ধির পথে কোন জোর-জবরদস্তি চলে না। তাই বলা হচ্ছে, কারো পক্ষে সিয়াম একান্ত কষ্টকর মনে হলে সে যেন একজন মিসকীনকে আহার্য্য দেয়। যদি কোন ব্যক্তি এর অতিরিক্ত সৎকর্ম করে তবে তাকে অবশ্যই পুরষ্কৃত করা হবে। তবে একথাও ঠিক যে, যারা সিয়াম করবে তারা এর উপকারিতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে এবং তারা নিশ্চয়ই সিয়াম করবে।
পরবর্তী আয়াতে রমজান মাসে কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার কথা বলা হয়েছে। শুধু কুরআনই নয়, অন্যান্য ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্যকারী কিতাবও রমজান মাসেই নাজিল হয়েছে। হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সহিফা রমজান মাসের ১ তারিখে অবতীর্ণ হয়েছিল। রমজান মাসের ৬ তারিখে তাওরাত, ১২ তারিখে যাবুর এবং ১৩ তারিখে ইঞ্জিল নাজিল হয়েছে। রমজানই কিতাব অবতীর্ণের মাস। আরবি ‘রমজ’ শব্দের অর্থ আগুন। রমজান ও সিয়াম উভয় শব্দের মধ্যেই দহন করার উপাদান বিদ্যমান। সংযমের আগুনে পুড়ে আত্মশুদ্ধ হয়ে মানস জমিন সত্যলাভের জন্য প্রস্তুত হয়। কদর অর্থ সম্মান। আত্মশুদ্ধির অনলে দগ্ধ হয়ে মানুষ যখন নিজে নিজেকে সম্মান করতে পারে তখনই সম্মান লাভের যোগ্যতা অর্জন করে। যোগ্যতা অর্জন করলে আল্লাহর রহমত প্রাপ্ত হয়। সিয়াম মানুষের মধ্যে ন্যায়-অন্যায় বোধ জাগ্রত করে। সিয়াম সাধনার নগদ প্রাপ্তি হচ্ছে, ন্যায় অন্যায়ের পার্থক্যকারী জ্ঞান প্রাপ্তি তথা ‘ফুরকান’ লাভ।
আল্লাহ্ বলছেন - ‘আমি যেহেতু আমার দাসের ডাকে সাড়া দেই সেহেতু তাদেরও উচিত আমার ডাকে সাড়া দেয়া’, অর্থাৎ সিয়াম পালন করা। ‘ফাআননি কারিবুন’ - ‘আমি আছি অতি নিকটে’ (সুরা বাকারাঃ ১৮৬)। এ নিকটবর্তী আল্লাহ্কে দেখাই সিয়ামের একমাত্র লক্ষ্য। মানবজীবনের আর কোন লক্ষ্য নেই। যারা সিয়াম পরিপূর্ণভাবে পালন করবে তারা অতি নিকটে অবস্থিত আল্লাহকে দেখতে পাবে। মানুষ তার অতি নিকটে অবস্থিত আল্লাহকে দেখতে পায় না কারণ তার দৃষ্টি দিন-দুনিয়ার মোহে আচ্ছন্ন। দ্বিনের আকাঙ্খা হচ্ছে - পরকালে বেহেশত লাভের আকাঙ্খা আর দুনিয়ার আকাঙ্খাগুলো হচ্ছে - সম্পত্তি, সঞ্চয় বৃদ্ধি, যশ-প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা লাভের আকাঙ্খা। এই উভয় প্রকার আকাঙ্খা নিকটবর্তী আল্লাহকে দেখতে পর্দার সৃষ্টি করে। দোজখের ভয় এবং বেহেস্তের লোভ থাকলে দোজখ বা বেহেস্ত লাভ হতে পারে কিন্তু আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ হয় না। সায়েমের সকল আশা-আকাঙ্খা, সকল চিন্তা ও কর্ম যখন তাঁর অন্তঃস্থিত আল্লাহ্ কেন্দ্রিক হয় তখনই সে তাঁর আল্লাহ্কে দেখতে পায় এবং সিয়াম সার্থক হয়। সাধারণ মানুষ রোজা রাখে, রোজা ভাঙ্গে। কিন্তু তিনিই প্রকৃত সায়েম যিনি তাঁর আল্লাহ্কে না দেখা পর্যন্ত সিয়াম ভাঙ্গেন না। এঁদের কাছে সিয়াম এক মাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।
দিন-দুনিয়ার মোহ থাকলে আল্লাহর  দাসত্ব করা হয় না। দাসত্ব করা হয় প্রবৃত্তির। সিয়াম প্রবৃত্তির ওপর আল্লাহ্কে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যম। সিয়ামের মাধ্যমে প্রবৃত্তির উপর আল্লাহর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলে নিজের মধ্যে সুপ্ত আল্লাহ্ প্রকাশিত হন। এ জন্যই রসুল (সা.) বলেছেন যে, সিয়াম হচ্ছে ‘ঢাল স্বরূপ’। ঢাল যুদ্ধ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত এমন একটা উপাদান যা শত্রুর আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করে। মানুষের মূল শত্রু তার নফস্। নফসের উপর ‘আমি’ রূপ রুহের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই সিয়াম। কথিত আছে - মহান আল্লাহ্ তায়ালা নিজ থেকে তাঁর নফসকে পৃথক করে প্রশ্ন করলেন - আমি কে? আর তুমি কে? নফস্ উত্তর দিল, তুমি - তুমি আর আমি - আমি। নফসের এ উত্তর শুনে আল্লাহ্ তায়ালা অসন্তুষ্ট হলেন এবং দীর্ঘদিন তাকে দহন করে পুনরায় প্রশ্ন করলেন, আমি কে? আর তুমি কে? নফস এবারও একই উত্তর দিল। এবার অসন্তুষ্ট হয়ে তিনি নফসকে দীর্ঘকাল বরফ চাপা দিয়ে রাখলেন। অতপর আবার একই প্রশ্ন করলেন। এবারও নফস একইভাবে উত্তর দিল - তুমি-তুমি আর আমি-আমি। এবার অসন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর নফসকে অনাহারে রাখলেন। অনাহারে থাকতে থাকতে নফস দুর্বল হয়ে পড়ল। এবার আল্লাহ্ তায়ালা নফসকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কে? আর তুমি কে? এবার নফস্ বশ্যতা স্বীকার করে বিনীতভাবে জবাব দিল  -‘তুমি আমার প্রভু এবং আমি তোমার দাস।’ কথনটি রূপক, এর মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয়টি হচ্ছে উপবাসের ফলে নফসের স্বেচ্ছাচারীতা দূর হয় এবং নফস্ ‘আমি’র বশ্যতা স্বীকার করে। নফসকে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করার একটি কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে উপবাস। নফস্ অর্থাৎ কামনা-বাসনা, আবেগ-উচ্ছ্বাস, কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-মদ-মাৎসর্য প্রভৃতি এমন কতগুলো প্রবৃত্তি রয়েছে যার তাড়নায় মানুষ তার ‘আমি’ সত্তার বিরোধী কাজে লিপ্ত হয়। সিয়ামের উদ্দেশ্য হচ্ছে এ সব প্রবৃত্তিকে ‘আমি’র নিয়ন্ত্রণে আনা। প্রবৃত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলে ব্যক্তি আল্লাহর ‘আমি’তে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং আল্লাহর কাছে মর্যাদার আসন লাভ করে। আল্লাহ্ বলেন, ‘আমার নৈকট্য অন্বেষণকারীদের মধ্যে সংযমী ব্যক্তির সমান নৈকট্য লাভ করা আর কারো দ্বারাই সম্ভব হয় নাই।’
পারিবারিক জীবনে, সংযম পালনের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক হবে পোষাকের মতো। আল্লাহ্ বলছেন  -‘তারা তোমাদের পোষাক এবং তোমরা তাদের পোষাক’ (সুরা বাকারাঃ ১৮৭)। এখানে ‘পোষাক’ শব্দটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। পোষাক ব্যবহারের যেসব তাৎপর্য রয়েছে সিয়ামের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কে সেই তাৎপর্য প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা রয়েছে এ আয়াতে। লজ্জা নিবারণ, শীত ও তাপ থেকে রক্ষা, সৌন্দর্য বৃদ্ধি মূলত এ তিনটি কারণে মানুষ পোষাক পরিধান করে। সিয়ামের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক যেন পোষাক তুল্য হয়। অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী যেন পরস্পরের মান-সম্মান ও ইজ্জত রক্ষা করে, বাইরের আঘাত থেকে পরস্পরকে রক্ষা করে এবং একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় সম্পর্কের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। কামনা থেকে প্রবৃত্তি এবং চিন্তাকে মুক্ত রাখা সিয়ামের অন্যতম উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্য অর্জিত হয় পারস্পরিক সম্পর্ক পোষাকের মতে হলে। কামনাকে বিনাশ করা নয়, একে মানবীয় মর্যাদায় উন্নীত করা সিয়ামের লক্ষ্য।
কুরআন বলছে - ‘ওয়া আনতুম আকিফুনা মাসাজিদি’ অর্থ - তোমরা যখন মসজিদে এতেকাফ-এ থাক’। সিয়ামের ফল পেতে হলে এতেকাফের গুরুত্ব অপরিসীম। এতেকাফের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, সংসার হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছুকালের জন্য ধ্যানে থাকা, কোন জিনিসকে আঁকড়ে ধরা এবং এর উপর নিজ সত্তাকে আটকে রাখা। নির্জনতা ও নীরবতার মধ্যে কিছুকাল একান্তভাবে আল্লাহর স্মরণে থাকার নাম এতেকাফ। যে যে সময় দুনিয়ার সকল কাজ ও ব্যস্ততা থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে শুধু মাত্র আল্লাহর স্মরণে থাকে সে সময়ই তার জন্য এতেকাফ। এতেকাফের উদ্দেশ্য হলো সৃষ্টির সাথে সংযোগ স্থগিত রেখে স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করা। আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক নির্ভর করে চিন্তার একরৈখিকতার ওপর। হাজার বিষয়ে বিচ্ছিন্ন চিন্তা করলে আল্লাহর সাথে সংযোগ হয় না। মানুষের মধ্যে চিন্তা প্রবেশ করে বাহ্যিক জগত থেকে তাই কিছুদিনের জন্য বাহ্যিক জগত থেকে নিজেকে পৃথক করে এক চিন্তায় প্রতিষ্ঠিত থাকার প্রচেষ্টা করাই এতেকাফের উদ্দেশ্য। রসুল (সা.) নিজেও এতেকাফ করতেন। ইন্তেকালের বছর তিনি একটানা ২০ দিন এতেকাফ করেছেন। এতেকাফ যত নির্জন হয় এবং এতেকাফের সময় লোকজনের সাথে মেলামেশা যত কম হয় ততই উত্তম। এতেকাফে থেকে প্রত্যেককে কদর রাতের সন্ধান করতে হয়। যে রাতে যার উপর আল্লাহর রহমত অবতীর্ণ হয় সে রাতই তার জন্য কদরের রাত।
অন্যদিকে, ন্যায় ভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নির্মাণের লক্ষ্যে সিয়াম অভ্যন্তরীণ তাগিদ সৃষ্টি করে। পানাহার ত্যাগের উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজেকে অনিয়ন্ত্রিত ভোগেচ্ছা থেকে রক্ষা করা। একমাস পানাহার থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে - যাদেরকে কখনোই খাদ্যের অভাবে ক্ষুধার্ত থাকতে হয় না, তারাও যেন অনুভব করতে পারে ক্ষুধার যন্ত্রণা। আশা করা যায় রমজানের পরে তারা ক্ষুধার্তদের প্রতি দয়াশীল হবে এবং ক্ষুধার্তদের খাদ্যের ব্যবস্থা করার জন্য নিজের দায়বদ্ধতা স্বীকার করবে। বিত্তবানদের মনে বিত্তহীনদের জন্য মর্মবেদনা জাগ্রত হবে এবং বিত্তবানেরা নিজেদের বিত্ত ন্যায়ভিত্তিক বন্টনে উৎসাহিত হবে। তাই অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান করাও  সিয়ামের অন্যতম একটা উদ্দেশ্য। কুরআনের বাণী - ‘আর যে ব্যক্তির পক্ষে সিয়াম করা দুঃসাধ্য তার একজন অভাবগ্রস্তকে অন্নদান করা কর্তব্য।’ (সুরা বাকারা : ১৮৪) ও এ দিকেই ইঙ্গিত করে।
সিয়ামের অন্যতম শর্ত হিসেবে সাবধান করে দেয়া হচ্ছে - ‘আর তোমরা একে অন্যের ধন অবৈধভাবে গ্রাস করো না। আর মানুষের ধনসম্পদের কিছু অংশ জেনে-শুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশে বিচারকদের ঘুষ দিয়ো না’ (সুরা বাকারাঃ ১৮৮)। যে ব্যক্তি অন্যের ধন-সম্পদ অবৈধভাবে গ্রাস করে সিয়াম করার কোন প্রয়োজন তার নেই। উপার্জন হালাল না হলে আত্মশুদ্ধির প্রচেষ্টা বৃথা। সম্পদ বা অর্থ উপার্জনে আল্লাহর আইনে নিষিদ্ধ সকল পন্থাই অবৈধভাবে গ্রাসের অন্তর্ভুক্ত। প্রতারণা, ঘুষ, জুয়া, মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশে গুদামজাত করা, কালোবাজারী এবং সুদসহ যাবতীয় নিষিদ্ধ বেচাকেনা এর আওতাভুক্ত। উল্লিখিত যে কোন পন্থায় হারাম ভক্ষণে শরীরে যে রক্ত, মাংস, শক্তি, বুদ্ধি উৎপন্ন হয় তা দিয়েই জ্বালানো হয় জাহান্নামের আগুন। হারাম থেকে বেঁচে থাকা সিয়ামের উদ্দেশ্য নয় - পূর্বশর্ত। এ শর্ত পূরণ না করে পানাহার থেকে বিরত থাকা আত্মপ্রতারণা।
মোহাম্মদ (সা) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যাচার ত্যাগ করেনি তার পানাহার ও স্ত্রী-সম্ভোগ ছেড়ে দেয়াতে আল্লাহ্র কোন প্রয়োজন নেই’। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, সিয়াম কেবল পানাহার ও যৌনসম্ভোগ থেকে বিরত থাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। কেবল পেটের সিয়ামই সিয়াম নয়। প্রতিটি  অঙ্গের সিয়াম আছে। তাই আমাদেরকে সিয়ামের প্রকৃত মাহাত্ম্য অনুধাবন করে সিয়াম পালনে ব্রতী হতে হবে।