বুধবার, ২৮ মে, ২০১৪

ভয়কে করবো জয়

ভয়কে করবো জয়

দিগন্ত ॥ অধিকাংশ মানুষের জীবনে ভয় হচ্ছে ভবিষ্যতের কাল্পনিক বিপদ। মানুষ ভয়ের সাম্রাজ্যে বসবাস করে সর্বদাই। কখনও সম্পত্তি নাশের ভয়, কখনও অপমানের ভয়, কখনও আপন জনের সাথে বিচ্ছেদের ভয় জীবনের সকল সুখ কেড়ে নেয়।
ভয়ের জননী ভবিষ্যতের নেতিবাচক কল্পনা। আমরা যখন বাস্তবতাকে এড়িয়ে যেতে চাই, যখন সমস্যাকে মোকাবেলা করার বদলে কাল্পনিক সমস্যায় ডুবে থাকি তখন সৃষ্টি হয় ভয়। ভয় নিয়ে মানুষের জন্ম হয় না। পরিবেশ থেকে নিজের মধ্যে ধারণ ও লালনের মাধ্যমে ভয়ের উৎপত্তি হয়। মা শিশুকে তেলাপোকার ভয়, ভূতের ভয় শিখায়। বড় হয়ে শিশু বুঝতে পারে ভূত বলে কিছু নেই কিন' শিশুকালে স্থাপিত ও লালিত ভূতের ভয় সে ছাড়তে পারে না। একইভাবে মা-বাবা এবং শিক্ষকরা শিশুদের মধ্যে পরীক্ষার ভয় তৈরি করে। অন্যদিকে - অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা, ধর্মীয় উন্মাদনা, সামাজিক চাপ, রাজনৈতিক অসি'রতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি থেকেও ভয়ের সৃষ্টি হয়। নিঃসঙ্গতা এবং বহুকাল পুষে রাখা অসন্তোষও ভয় সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে।
রোগ ভয়, বার্ধক্যের ভয়, প্রিয়জন বিচ্ছেদের ভয়, নিরাপত্তার ভয়, ব্যর্থতার ভয়, দারিদ্রের ভয়, একাকীত্বের ভয়, সম্মান ও সম্পত্তি হারানোর ভয়, মৃত্যুভয়, চুরি হওয়ার ভয়, না পাওয়ার ভয়, ব্যাথা পাওয়ার ভয়, ঝড়-তুফানের ভয়, বাবার শাসনের ভয়, মায়ের অশ্রুর ভয়, যানজটের ভয় ইত্যাদি কোন না কোন সাধারণ ভয়ে প্রায় সকলেই আক্রান্ত। অনেকের মধ্যে লোক ভয়, সমালোচনার ভয় ইত্যাদি সামাজিক ভয় কাজ করে। সামাজিক ভয়ে ভীত ব্যক্তি একা একা থাকতে ভালোবাসে। বিয়ে, সেমিনার, বনভোজন ইত্যাদি সামাজিক অনুষ্ঠানে তারা অংশগ্রহণ করতে চায় না। মসজিদ, মন্দির বা উপাসনালয়ে যেতেও ভয় পায় তারা। মিটিং মিছিলের ধারে কাছেও তারা যেতে চায় না। সামাজিক ভয় যার মধ্যে প্রকট হয় সে একা ঘর থেকে বের হতেই ভয় পায়।
ভয় জীবনের সব সুখ কেড়ে নেয়। মনোবিজ্ঞানীরা ভয়কে আধুনিক প্লেগ হিসেবে গণ্য করেন। ভয় মস্তিষ্ক থেকে ছড়িয়ে পড়ে হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, পাকস্থলীসহ শরীরের সকল প্রধান অঙ্গসমূহে। ভয়ে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়, হৃদরোগ, বাত, পাকস'লীর পরিপাক জটিলতা, থাইরয়েড সর্দিকাশি আর ডায়াবেটিস বৃদ্ধি পায়। ভয়ে সৃষ্টি হয় বিষণ্নতা। ভয় এবং আনন্দ একসাথে থাকতে পারে না।
যত প্রকার ভয় আছে তার মধ্যে ব্যর্থতার ভয় সবচেয়ে ক্ষতিকর। ব্যর্থতার ভয়ে অনেকে কাজ শুরুই করতে পারে না। অনেকে পারদর্শী হয়েও সফল হতে পারে না কারণ ভয় বাঁধা হয়ে সফলতার পথ রুদ্ধ করে দেয়। অনেকে ভাবেন ব্যর্থ হলে লোকজন তাকে নিয়ে উপহাস করবে, সে সকলের সামনে ছোট হয়ে যাবে। এ সব কারণে অনেকে কাজ শুরু করার আগেই হার মেনে নেন। ব্যর্থতার ভয়ে কাজ শুরু করার আগেই মানুষ হেরে যায়। অথচ ব্যর্থতা ব্যতীত সাফল্য আসে না জীবনে। জীবন চলার পথ কুসুমাবৃত নয়, ব্যর্থতাকে অতিক্রম করেই যেতে হয় সফলতার দরজায়। ব্যর্থতার ভয় বরং ব্যর্থতাকে অনিবার্য করে। ব্যর্থতার ভয়কে জয় করার জন্য চাই আত্মবিশ্বাস। নিজেকে বিশ্বাস করতে হবে যে, আমিও পারব। যখন আমরা এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করি যে, আমি তাকে পরাজিত করব তখন শত্রুও বিশ্বাস করতে শুরু করে যে সে পরাজিত হবে, তখন নিজের শক্তি ও শত্রুর শক্তি উভয়ই বিজয় লাভে সহায়ক হয়। বিজয়ের বিশ্বাস থেকেই মানুষ বিজয় লাভ করে। আমরা যদি ভাবতে থাকি যে হেরে যাব তাহলে নিজেই নিজের মধ্যে শত্রুকে আশ্রয় দেই এবং পরিণামে আমাদের পরাজয় হয়। ব্যর্থতা আসলে সফলতার একটি স্তর মাত্র। প্রচেষ্টার মাধ্যমে ব্যর্থতার স্তর অতিক্রম করে সফলতা অর্জন করতে হয়। এমন কেউ নেই যার জীবনে ব্যর্থতা আসে না। ব্যর্থতার সম্ভাবনা আছে বলেই আমরা সফলতার মর্ম উপলব্ধি করতে পারি। জীবনে ব্যর্থতা আসতেই পারে এই বাস্তব সত্যটিকে মেনে নিলে ব্যর্থতার ভয় থাকবে না।
‘ছেলেটাকে যদি ভাল স্কুলে ভর্তি করতে না পারি কি হবে? যেভাবে বাড়িভাড়া, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে তাতে চলব কি করে? যদি চাকরি হারাই তাহলে কি হবে? যদি কঠিন কোন রোগে আক্রান্ত হই তাহলে কি হবে?’- ইত্যাদি ভয় এমনভাবে জীবনকে জড়িয়ে রাখে যে ভয়ের অস্তিত্ব সবার কাছে স্বাভাবিকই মনে হয়। কিন্তু আমরা সবাই জানি ভয় পেলেই ভবিষ্যতে দুঃখের নিবারণ হয় না! ভবিষ্যৎ সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা নিয়ে চিন্তা করে আমরা আমাদের বর্তমানের সুন্দর সময়গুলোকে কষ্টে ভরে দেই। আমরা ভবিষ্যত নিয়ে যত বেশি উদ্বিগ্ন হবো বর্তমানকে কাজে লাগাতে ও উপভোগ করতে ততই ব্যর্থ হবো। সময়কে নিয়ন্ত্রণের শক্তি আমাদের নেই। ভবিষ্যতে কি হবে তা আমরা কেউ জানি না। আমরা বর্তমানে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে থাকি ভবিষ্যৎ নিজেই নিজেকে নির্মাণ করবে। বর্তমানের কর্মতৎপরতায় ভয় থাকে না। যে বিপদকে আমরা ভয় করি বাস্তবে সে বিপদে পতিত হলে বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য আমরা প্রচেষ্টা করি। কর্মে একনিষ্ঠ থাকলে ভয় থাকে না তবে সাবধানতা থাকে। সাবধানতা আর ভয় এক নয়। যেমন, আগুনকে আমরা ভয় পাই না কিন্তু আগুনের ব্যবহারে আমরা সাবধান থাকি। ঠিক একইভাবে পথ চলতে, গাড়ি চালাতে আমাদের সাবধান থাকতে হয়। সাবধানতা আমাদেরকে যে কোন প্রকারের বিপর্যয় সম্পর্কে সতর্ক ও সজাগ রাখে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
অভিজ্ঞতা অজানা বিষয়ের ভীতির প্রতিষেধক। সাধারণ ভয়ের ক্ষেত্রে ভয়ের বস্তুটি সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরী করে তা দূর করা সম্ভব। ভয় উদ্দীপকটির ব্যাপারে সংবেদনশীলতা কমালে ভয় অবশ্যই কমবে। যার মধ্যে ভূতের ভয় আছে সে যদি যুক্তিসঙ্গতভাবে বুঝতে পারে যে ভূত বলে কিছু নেই তাহলে ভূতের ভয় প্রবল হবে না। জনতার সামনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে শুরুর দিকে অনেকেই একটি ভীতিতে আক্রান্ত হন, কিন্তু বার বার এই পরিসি'তি মোকাবেলা করার মাধ্যমে ভীতি কেটে যায়।
ভয়কে জয় করার উপায় হলো ভয়ের মোকাবেলা করা। যে ব্যক্তি যে কাজ করতে ভয় পায় সাহস নিয়ে সে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লে ভয় পালাবার পথ খুঁজবে। এমনও হতে পারে যে, ভয় কেটে যাওয়ার পর ঐ কাজটিই হয়ে ওঠবে আনন্দের উৎস। যে ব্যক্তি নৌকা ভ্রমনে ভয় পায়, সাহস করে নৌকা ভ্রমন শুরু করলে তাতেই সে পেতে পারে অপার আনন্দ।
ভয় থেকে মুক্তি পেতে হলে নিজের মধ্যে ভয়কে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ভয়ের উৎপত্তি ও উৎস খুঁজে বের করতে হবে। জলের জীব ডাঙ্গায় বাঁচে না। গভীর সমুদ্রের অতিকায় প্রাণীকেও যদি কোনভাবে ডাঙ্গায় তুলা যায় তবে তার মৃত্যু হয়। ঠিক তেমনি ভয় পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের আলো সহ্য করতে পারে না। ভয় হচ্ছে অন্ধকারের সৃষ্টি, আলোয় এলেই তা মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। তাই ভয়কে পর্যবেক্ষণের আলোতে স্পষ্ট করে তুলতে হবে। জানতে হবে ভয়ের উৎপত্তি ও চূড়ান্ত পরিণতি। অজানা যখন জানা হয়ে যায়, তখন আর ভয় থাকে না। অন্ধকারে রজ্জুকে সর্প ভেবে আমরা ভয় পেতে পারি কিন্তু রজ্জুতে টর্চের আলো ফেললে ভয় কেটে যায়।
যে ভয় পায় স্বয়ং সে-ই ভয়কে শক্তি দেয়। ভয়ের নিজস্ব কোন শক্তিও নেই, অস্তিত্বও নেই। ভয়কে অস্তিত্বমান করে ব্যক্তি স্বয়ং তার কল্পনা দিয়ে। সুতরাং যে কল্পনা ভয়ের সৃষ্টি করে সে কল্পনা না করলে ভয় শক্তিহীন হবেই। আমরা যদি ভয়কে কল্পনার জগতে আধিপত্য বিস্তার করতে দেই তাহলে আমাদের অজান্তেই ভয় লালিত পালিত হয়ে আরো শক্তিশালী হবে এবং ভয় থেকে মুক্তি অসম্ভব হয়ে ওঠবে। কল্পনার জগতে অবগাহণ করে যদি ভয়ের কারণগুলো খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে কারণের জন্য করণীয় বের করা সহজ হবে।
পাছে লোকে কিছু বলে! এই ভয় সবসময় আমাদের তাড়া করে। এক্ষেত্রে, লোকে কী বললো না বললো তা না ভেবে নিজস্ব মতামত, দৃষ্টিভঙ্গি ও বিবেককে প্রাধান্য দেওয়াই শ্রেয়। আমরা যদি নিজেরাই নিজেদের মূল্য না দেই তবে অন্যরা আমাদের মূল্য দেবে না। যে কাজে নিজ বিবেকের সমর্থন আছে তাতে লোকের সমালোচনাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যারা সমালোচনা ও নিন্দা করে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকলে তারাই একসময় প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবে। ভয় থেকে মুক্তির সহজ পন্থা হলো কর্ম। কর্মে ব্যস্ত থাকলে ভয় পাওয়ার সময়ই পাওয়া যাবে না। কর্মব্যস্ততার ফলে দেহ ও চিন্তা সবসময়ই থাকবে সজাগ ও সতর্ক।
          আমরা যদি কোন পরিবেশ বা পরিসি'তিকে এড়িয়ে চলি তাহলে বিবেচনা করে নির্ণয় করতে হবে এটা বাস্তবসম্মত নাকি ভয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভয় থেকেই সৃষ্টি হয় পলায়নমনস্কতা। ভয়ের পরিস্থিতি থেকে আমরা যতই পালাই ততই কমবে আত্মবিশ্বাস এবং বাড়বে ভয়। এভাবে চলতে থাকলে সমস্যার বোঝা ভারী হতেই থাকবে। এক্ষেত্রে ভয়ের কাল্পনিক মোকাবেলার মহড়া ফলদায়ক। কল্পনায় ভয় কেটে যাওয়ার পর বাস্তবে ব্যাপারটা সহজ হয়।
ভয়ের শেষ স্তর মৃত্যু। অথচ মৃত্যুভয়ের চেয়ে অযৌক্তিক ভয় আর কিছু নেই। মৃত্যুকে ভয় পাই বা না পাই, মৃত্যু হবেই এটাই সত্য। মৃত্যুর সময় হলে মরতেই হবে। সময় হয়ে গেলে মৃত্যুর হাত থেকে কেউ রক্ষা পাবে না। নবী-রসুল, দরবেশ, মুনি-ঋষি এমন কেউ নেই যার মৃত্যু হয়নি। স্টালিন, কেনেডি, হিটলার মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করেছিলেন কিন্তু তারা কেউ বেঁচে থাকতে পারেন নি। মৃত্যু জীবনের অবধারিত সত্য। সুতরাং মৃত্যুকে ভয় না পেয়ে জীবনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি মেনে জীবনকে উপভোগ করাই শ্রেয়।

ভয় আর কিছু নয়, কেবল ভবিষ্যৎ দুঃখের কল্পনা। বাস্তবের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। ভবিষ্যতের কথা কে জানে? আমরা কেউ সময়ের প্রভু নই। সময়তো চলে বিধাতার অধীনে। যারা বিধাতাকে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে গ্রহণ করে তাদের ভয় পাওয়ার কোন কারণই নেই। কেবল এইটুকু যে উপলব্ধি করতে পারে তার পক্ষে ভয় থেকে মুক্ত হয়ে নির্ভীক হওয়া কঠিন নয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন