বুধবার, ২৮ মে, ২০১৪

দেহ ও আত্মার সম্পর্ক

দেহ ও আত্মার সম্পর্ক

আরিফিন হক ॥ যে কোন ব্যক্তি যখন নিজের অস্তিত্ব নিয়ে অনুসন্ধিৎসু হয়, নিজের জীবন ও মৃত্যু নিয়ে ভাবতে শুরু করে, জীবন ও জগতের বিভিন্ন রহস্য উন্মোচনের বাসনা জাগে তখন সবার আগে আত্মার ধারণা তাকে উদ্বেলিত করে। মানুষ যেমন চারপাশের জড়জগতকে পর্যবেক্ষণ করে তেমনি পর্যবেক্ষণ করে জীবজগত। মানুষ উপলব্ধি করে যে জড়ের মধ্যে বুঝতে পারার ক্ষমতা নেই। কিন্তু জীবের মধ্যে আছে বুঝতে পারার ক্ষমতা। এই বুঝতে পারার ক্ষমতাকে মানুষ নামকরণ করেছে আত্মা। বুঝতে পারার ক্ষমতা থাকার কারণেই মানুষ যুক্তি, সচেতনতা, বোধ, এবং বুদ্ধির চর্চা করতে পারে। বস্তু মাত্রই আত্মার আধার। পরিবেশের প্রভাবে বস্তুর মধ্যে প্রকাশ ঘটে আত্মার। সমগ্র বস্তুজগৎ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা দিয়ে গঠিত। এ কণিকাগুলোর নাম পরমাণু। পানি, কাদা মাটি বা আবর্জনা থেকে যখন আত্মার উদ্ভব হয় তখন অজৈব পদার্থের অণুগুলো নির্দিষ্টভাবে সজ্জিত হয়ে জীবনের ভিত্তিভূমি রচনা করে।
আত্মা বা বুঝতে পারার ক্ষমতা বস্তু থেকে পৃথক কিছু নয় বরং বস্তুরই ধর্ম। পানির সিক্ততা পানি থেকে পৃথক নয় বরং পানির অণুরই স্বভাব ধর্ম। সিক্ততা নামে কোন নিবস্তু পানির মধ্যে প্রবেশ করে পানির মধ্যে সিক্ততা সৃষ্টি করে না। পানির অণুর বিন্যাসের কারণেই সিক্ততার উদ্ভব ঘটে। আত্মাও তাই। দেহের স্বভাব ধর্ম হিসেবেই আত্মার উদ্ভব ঘটে। দেহ শব্দটির পৃথক কোন ব্যবহারই নেই। দেহ শব্দটি ব্যবহার করতে হলে উল্লেখ করতে হবে কার দেহ। যদি বলা হয় মানব দেহ,  তাহলে নিশ্চয়ই এমন একটা কিছু আছে যা মানব এবং দেহ। করিম একজন মানব। করিমের দেহ বলতে বুঝায় করিম ও দেহ এক নয়। করিমের বাড়ি, গাড়ীর মতোই করিমের দেহ করিম থেকে পৃথক। কিন্তু বাস্তবে বাড়ী, গাড়ী যেভাবে করিম থেকে পৃথক করিমের দেহ সেভাবে পৃথক নয়। আবার করিম ও দেহ একও নয়। করিম দেহতেই অবস্থান করে। সুতরাং বলা চলে যে, আত্মা হচ্ছে সূক্ষ্ম দেহ, আর দেহ হচ্ছে স্থুল আত্মা। আত্মা আর দেহ আসলে একই সত্তার দুটি দিক। একই সত্তার দুটি দিক সমান্তরাল রেখার মতো সহগামী। একটির সাথে অপরটি চলতে থাকে সময়ের সাথে সমান্তরালভাবে। দেহের রূপান্তরে আত্মার বিকাশ ঘটে, আত্মার উদ্ধরণে দেহেরও রূপান্তর ঘটে।
দেহের ওজন আছে এবং স্থান দখল করে। বস্তুর বৈশিষ্ট্যই তাই। দেহ যেহেতু বস্তু সেহেতু তাকে বস্তুজগতের নিয়ম মেনে চলতে হয়। দৈহিক কর্ম এবং অবস্থা বাহির থেকে পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। জীবজন্তু, বৃক্ষাদি ও অন্যান্য বস্তুর মতো দেহ সকলের কাছেই দৃশ্যমান এবং বোধ্য ব্যাপার। কিন্তু বুঝতে পারার ক্ষমতা বস্তুজগতের নিয়মের অধীন নয়। কে কি বুঝে, কি বুঝে না তা তার দেহের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া থেকে প্রত্যক্ষীভূত হয় না। তা একান্তই ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার। কেবলমাত্র করিমই জানে করিম কি বুঝে আর কি বুঝে না। করিমের বুঝতে পারার ক্ষমতা তার নিজস্ব। করিমের জীবনে দুটি স্রোতধারা প্রবাহমান। আত্মা ও দেহের স্রোতধারা। দেহের স্রোতধারা সর্বজনের কাছে প্রকাশ্য কিন্তু আত্মার স্রোতধারা গোপনীয়। দেহে যে সব ঘটনা ঘটে তা বস্তু জগতের ঘটনাবলী। আর আত্মার জগতে যা ঘটে তা ভাব জগতের ঘটনাবলী। ব্যক্তি তার অপ্রকাশ্য গোপন কার্যাবলীর ইতিবৃত্ত সরাসরি জানতে পারে। করিমের কাছে করিমের কোন কিছু গোপন থাকার কথা না। বাহ্যিক জগতে কি ঘটছে এ সম্পর্কে জানার মধ্যে অনিশ্চিয়তা ও ত্রুটি থাকতে পারে কিন্তু করিমের অভ্যন্তরীণ জগতে কি ঘটছে তা সন্দেহাতীত ও নির্ভুলভাবে করিমের পক্ষে জানা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে করিম করিমকে জানে না কারণ সে আত্মসচেতন নয়, তার অন্তদৃষ্টি নেই। নিজের অভ্যন্তরে কি ঘটছে সে খবর করিম রাখে না।

মানুষ বাহ্য জগতকে জানতে প্রয়াসী হয়। বাহ্য জগতকে জেনে সে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে চলছে জগতের সর্বত্র। এরই ধারাবাহিকতায় মানুষ গহীন অরণ্যকে নিজের বাসভূমিতে পরিণত করেছে। সমুদ্রের বিশালতাকে অতিক্রম করেছে, চাঁদের বুকে পা রেখেছে। মানুষ এখন জগত সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে, কিন্তু নিজেকে জানে না, নিজের আত্মাকে চিনে না। মানুষ বস্তুকে জানছে, কিন্তু আত্মাকে জানতে চাইছেও না, জানছেও না। নিজের আত্মাকে জানতে পারছে না বলেই নিজের আত্মার চাহিদার কথাও জানতে পারছে না। মানুষ জানে কেবল দেহের চাহিদা তাই খাওয়া-দাওয়া আর কামনা-বাসনার দাসত্বে নিয়োজিত থাকে সর্বক্ষণ। যে কোনো মূল্যে মানুষ দেহের চাহিদাকে পূরণ করতে চায়। ফলে দেহের বস্তুগত চাহিদাগুলো তার বোধের জগতে রাজত্ব করতে থাকে। করিম শিক্ষিত হয় কিন্তু শিক্ষাকে কাজে লাগায় কেবল দেহের বাসনাসমূহ পূরণ করার কাজে। বস্তুজগতের নিয়ম অনুযায়ী করিম সবাইকে অতিক্রম করে সর্বোচ্চ আসনটি অধিকার করতে ব্যস্ত এবং প্রয়োজনে অন্য সবাইকে বঞ্চিত করে নিজে জগতের সবচেয়ে সেরা জিনিসটি ভোগ করতে উন্মত্ত। করিম তার শিক্ষাকে প্রয়োগ করে এ ক্ষেত্রে সফলতাও অর্জন করে। কিন্তু এ পথে সে যতই অগ্রগতি অর্জন করুক শান্তি সে পায় না। কারণ, আত্মা সমান্তরাল রেখার মতো দেহের সহগামী হয় না। শান্তি লাভের জন্য প্রয়োজন ভিতর ও বাহিরের সামঞ্জস্য। আত্মা ও দেহের সমান্তরাল উদ্ধরণ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন