বৃহস্পতিবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৩

বাঙালি দর্শনই শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক দর্শন


বাঙালি দর্শনই শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক দর্শন

 

 

শাহ্‌ মহিউদ্দীন মাস্‌উদ ॥

 

 

অন্য কোনো দর্শন নয় - আমি বাঙালি আমাকে বাঁচতে হবে বাঙালি সংস্কৃতির ধারক হয়ে”- উক্তিটি একজন সূফী সাধকের। অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে তিনি উচ্চারণ করেন - আজকের এই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দেউলিয়াত্ব থেকে মুক্তি পেতে বাঙালিকে মনেপ্রাণে বাঙালি হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। বাঙালির কাছে আজ আর বাঙালির দর্শন নেই। নেই তার জাতীয়তাবোধের আত্মশক্তি ও সাহস। যা দ্বারা একদিন সে শিরদাঁড়া সোজা করে বৈশ্বিক চেতনা ধারণ করতে পেরেছিল। আজকের বাঙালিকে আর ইতিহাসের ধারায় খুঁজে পাওয়া কিংবা চিনে নেয়া  কষ্টকর। তার ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের ব্যাপ্তি ক্রমাগত রাজনৈতিক বেনিয়াদের হাতে লুন্ঠিত হতে হতে আজ এক ক্ষীণ দীপশিখা মাত্র।

একদিন রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করেছিলেন এই বলে - রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি। সেদিন হয়তো আমরা বাঙালি ছিলাম, মানুষ ছিলাম না বৈশ্বিকতায়। আর আজ মানুষ তো নয়ই, বাঙালিও নই। এ জন্যেই সূফী সাধক উপদেশ দিলেন সর্বাগ্রে একজন বাঙালি হবার।

এই বাঙালি দর্শনই শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক দর্শন। একজন মানুষ তার নিজের মধ্যে আপন স্বকীয়তার অস্তিত্ব অনুভব করতে না পারলে, অন্যের উপস্থিতিটা তার কাছে অনুপস্থিতিই থেকে যায়। তখনই দেখা দেয় আমিত্বের সর্বস্ব গ্রাস করবার পাশবিক মনোবৃত্তি। যা আজ আমাদের রাজনৈতিক ধারাগুলোর মধ্যে প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। 

এখন আমরা কেউবা আওয়ামী লীগের কেউবা বিএনপির বা অন্য যে কোনো রাজনীতির ধারক। এর বাইরে বেরিয়ে বাঙালি দর্শন এবং তার সংস্কৃতির চেতনায় ধারক হতে চায় কজনা? সুতরাং দেশ এবং তার মানুষের জন্য আর কেউ কোনো দরদ অনুভব করে না। প্রতিটি রাজনৈতিক দলই দেশের মানুষকে ব্যবহার করে চলছে শুধুই তাদের লুটের সাম্রাজ্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে।

যদিও এদের অনেকেরই বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাইনবোর্ডটি যথাযথই ঝুলিয়ে রেখেছে, কিন্তু উদ্দেশ্য এক এবং অভিন্ন।

স্বাভাবিক প্রশ্ন এই জাতীয়তাবোধ যা আজ নির্বাসিত, তার প্রতিষ্ঠার পথ এবং পদ্ধতি কি? লুটেরা রাজনীতির প্রয়োজনে যে সন্ত্রাসের সৃষ্টি তা এখন গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত। তাকে কি লুটেরা রাজনীতির ভোটতন্ত্রের বর্তমান পথ এবং পদ্ধতিতে অক্ষত রেখে পরিবর্তনের আদৌ সম্ভাবনা  আছে?

যারা আজ পুরো দেশটাকে তাদের নিজেদের মত করে ইজারা নিয়েছে তাদের নির্লজ্জতা কত নগ্ন তার প্রমাণ পাই আমরা রাজনীতিকদের ও তাদের পোষ্য সন্তানদের সন্ত্রাসের পক্ষে তাদের বক্তৃতা বিবৃতি   প্রচারে। 

সমগ্র দেশব্যাপী এই স্বার্থবাদী শ্রেণীর দৌরাত্ম্য। এরা কেউই আর এই দেশ এই মাটি এই মানুষের কেউ নয়। এরা প্রত্যেকেই লুটের অংশীদার এবং বাঙালি ও তার জাতীয়তার আজন্ম শত্রু। এদের এক এবং অভিন্ন ইচ্ছা ও উদ্দেশ্যের কাছে বাঙালির জাতীয়তাবোধ বার বার উপেক্ষিত।

একদিকে আকাশ সংস্কৃতির ক্রমাগত আগ্রাসন অন্যদিকে সন্ত্রাসী রাজনীতির ব্যাপক বিস্তার, জাতির ভবিষ্যৎ তরুণ সমাজকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। এখন একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ শিক্ষা নিতে গিয়ে হয় নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে অথবা নিজেকে পরিবর্তিত করছে একজন রাজনৈতিক ধর্মান্ধ সন্ত্রাসের ক্যাডার হিসেবে। এই বাস্তবতায় বাঙালি জাতীয়তাবোধে দেশ গড়ার সহজ সাধারণ পথ - বাঙালি সংস্কৃতির ধারক হয়ে সত্যকে আঁকড়ে ধরা।

একদিকে রাজনৈতিক দস্যুদের প্রবল প্রতাপে প্রতিটি জনপদের অসহায় মানুষের নির্বিকার ক্রন্দন, অন্যদিকে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের জীবনবিমুখী বিভ্রান্ত চিন্তার দ্বারা মোহাবিষ্ট করে বাঙালিত্ব থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়া চলছে। এই সাড়াশি আক্রমণের প্রক্রিয়ায় বাঙালির সহজ সতেজ সবল চিন্তার সূত্রগুলো প্রতিদিন মরে যাচ্ছে। পৃথিবীর চিন্তা চিরন্তন প্রেরণা বাঙালি মানসে আর কোন আলোড়ন তোলে না। ভোগ, লোভ আর স্বার্থের আবর্তে প্রতিনিয়ত ঘূর্ণায়মান এই সত্তা থেকে বেরিয়ে আসতে প্রতিঘাতের সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণেই বাঙালি সত্তার পূণর্জাগরণ। ঐশী দয়া বা দাক্ষিণ্যের প্রত্যাশায় না থেকে সামাজিক বাস্তবতা, অর্থনৈতিক শোষণ, আধিপত্যবাদী আগ্রাসন এবং রাজনৈতিক মুক্তি প্রতিটি স্তরেই জাতীয়তাবোধের রাজনৈতিক সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার অদম্য ইচ্ছা এবং ঐতিহ্যবাহী প্রেমের প্রজ্ঞায় প্রজ্ঞায়িত হওয়ার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির বাস্তব নিরিখেই অগ্রসর হতে হবে।

প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও সচেতন আত্মীকরণ দুইয়ের সচেতন চেতনার ঐক্য গ্রথিত হতে পারে। চেনা, জানা এবং বুঝার তুলনামূলক সমন্বয়ের অহেতুক বিতর্ক সময়ের অপচয় মাত্র। বিশ্লেষিত সত্যের আপেক্ষিকতা অবচেতন ও ধূমায়িত নয় বলে বাঙালিত্বের অসীম ধারা চিরন্তন প্রবাহিত। তাকেই প্রতিষ্ঠিত করবার এই ডাক বর্তমান সময়ের বিচারেই সংজ্ঞায়িত।

নিজের রূপে বিশ্বরূপ প্রতিফলিত করবার অহংবোধ বাঙালিত্বের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের একমাত্র পথ।

মাত্র কয়েক হাজার উগ্রবাদী ধর্মান্ধ রাজনীতিক এবং তাদের পোষ্য সন্ত্রাসীদের জন্য সমগ্র দেশের মানুষ পালিয়ে বেড়াতে পারে না, সেটা একেবারেই এ মাটির মানুষের জন্য কলঙ্ক এবং কাপুরুষতা। সুতরাং বাস্তবতা হলো মাত্র কয়েক হাজারকেই দেশ থেকে বিতাড়িত করতে হবে অথবা সার্বিক দিক থেকে তাদেরকে পঙ্গু করে রাখতে হবে। সহজ কথায় বাঙালি ঐতিহ্যকে আবার তার স্বস্থানে প্রতিষ্ঠিত  ও বহমান রাখতে প্রতিরোধের কোন বিকল্প নেই।

সরকারি প্রশাসন পদ্ধতি এবং রাজনৈতিক সরকার ও সন্ত্রাস প্রত্যেকেই একে অপরের পরিপূরক বিধায় এরা প্রত্যেকেই আজ  সাধারণ মানুষের শত্রুতে পরিণত। বিজাতীয় শোষকরা এদেশ থেকে চলে গেলেও স্বজাতীয় অবয়বে তারা বিদ্যমান; আর সে কারণেই সাধারণ মানুষের শত্রু তারা। আর এই শত্রুর কাছ থেকে কোন অবস্থাতেই  সাধারণ মানুষের কোন অধিকারের কথাই চিন্তা করা যায় না, উচিতও নয়। তাই অধিকার আদায়ের গতানুগতিক আন্দোলনে বারবার সুবিধাবাদী চরিত্রের উদ্ভব ঘটবেই এবং তা বিগত ইতিহাসের মতই পুনরাবৃত্তি হবে মাত্র। লড়াইটা এখন ত্রিমুখী। ক্ষমতাসীন, ক্ষমতামুখী এবং প্রশাসন পদ্ধতির বিরুদ্ধে।

যদিও তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত এই শোষণের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তাদের শোষণের ব্যবস্থাদি। তারপরও ঐক্যবদ্ধ সাধারণ মানুষের সামনে তা অত্যন্ত নগণ্য।
সত্য প্রতিষ্ঠার দর্শনে জনতার ঐক্যবদ্ধ লড়াই অধিকার আদায়ের পথকে সুগম করতে পারে। আমরা বাঙালি’ - চির নতুন ও শাশ্বত এই সত্য ও  রাজনৈতিক দর্শনকে ধারণ করাই আজকের জীবন চলার পথে বাঙালির প্রাথমিক ও প্রধান কাজ। দেশবাসী তার চিন্তাপ্রবাহে কিছু সময়ের জন্য এই চিন্তাকে ধারণ ও লালন করুক এটাই সময়ের প্রত্যাশা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন